গ্রন্থ : অপেক্ষা
লেখক : হুমায়ূন আহমেদ
প্রকাশ কাল : ডিসেম্বর,১৯৯৭ খ্রিস্টাব্দ
ধরণ : উপন্যাস
পটভূমি: পারিবারিক, রোমান্টিক, ট্র্যাজেডী
প্রধানচরিত্র: ইমন, মিতু, সুপ্রভা, সুরাইয়া
বাংলাদেশের জনপ্রিয় কথা সাহিত্যিকদের মধ্যে অন্যতম হলো হুমায়ূন আহমেদ। তিনি ছিলেন একাধারে ঔপন্যাসিক, ছোটগল্পকার, নাট্যকার এবং গীতিকার, চিত্রনাট্যকার ও চলচ্চিত্র নির্মাতা। বাংলা কথাসাহিত্যে তিনি সংলাপপ্রধান কথা শৈলীর জনক।
তাঁর উপস্থিত বুদ্ধিজাত প্রকাশ ও রসবোধের কারণে তাঁর রচনা সহজেই পাঠকের চিত্ত স্পর্শ করে। বাংলাদেশের কথা সাহিত্যের গতানুগতিক ধারাকে অতিক্রম করে হুমায়ূন আহমেদ নির্মাণ করেন এক স্বতন্ত্র ভুবন।
একজন সফল লেখক হিসেবে শিল্প-সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় একচ্ছত্র বিচরণ তাঁকে এনে দেয় বিপুল জনপ্রিয়তা। বহুমাত্রিকতা তাঁর রচনার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ।
তাইতো তাঁর মৃত্যুর এতো বছর পরেও তার সাহিত্য রচনা ও উপন্যাসগুলো পাঠকদের মনে জায়গা দখল করে আছে।
গ্রন্থালোচনা
অপেক্ষা, হুমায়ূন আহমেদের লেখা এক অমর সৃষ্টি। এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়েছিলো ১৯৯৭ সালে। যা আজও রয়েছে পাঠক জনপ্রিয়তার শীর্ষে।
একটি স্বার্থক উপন্যাসের মূল সার্থকতার অনেকাংশেই নির্ভর করে উপন্যাসের উল্লেখিত চরিত্র বর্ণনা ও তাদের চারিত্রিক কাহিনীগুলো সুষ্টু বিন্যাসের ওপর। এখানেও তার ব্যতিক্রম হয়নি। উপন্যাসের ছোট্ট একটা চরিত্র সুপ্রভার চারিত্রিক কাহিনী বিন্যাস উপন্যাসটিকে সাফল্যমন্ডিত করে তুলেছে।
গল্পের শুরুতে হাসানুজ্জামানের হারিয়ে যাওয়া, সুস্থ স্বাভাবিক সুরাইয়ার এমন বদলে যাওয়া, সুপ্রভার অকাল পরিণতি, জামিলুর রহমানের ভালোবাসা, ইমনের বেড়ে ওঠা, ছোট চাচার জীবনযাত্রা, সব মিলিয়ে অতি সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের চমৎকার দৃশ্যপট ফুটে উঠেছে।
এই উপন্যাসের বেশ ক’জায়গায় লেখক বেশ কিছু সুন্দর কথা বলেছেন। এই যেমন –
‘মানুষের বেঁচে থাকার জন্য অপেক্ষা নামের ব্যাপারটি খুব প্রয়োজন। অপেক্ষা হচ্ছে মানুষের বেঁচে থাকার টনিক।’
–অপেক্ষা ( হুমায়ূন আহমেদ)
” খুব খারাপ সময়ের পরপরই খুব ভাল সময় আসে। এটা জগতের নিয়ম”।
–অপেক্ষা (হুমায়ূন আহমেদ)
মূল কাহিনী
সুরাইয়া, উপন্যাসের একটি অন্যতম চরিত্র।
যার জীবনের অর্থ হচ্ছে শুধুই অপেক্ষা করা। প্রিয় স্বামীর জন্য আজীবনের অপেক্ষার কোন শেষ নেই। তার বিশ্বাস একদিন ঠিকই তার স্বামী হাসানুজ্জামান ফিরে আসবে।
আমরা প্রায় প্রতিদিন পত্রিকায় কতশত নিখোঁজ সংবাদ পড়ি। মাঝে মাঝে রাস্তায় শুনি মাইকিং কিংবা দেয়ালে লাগানো ছাপা পোস্টারে নিখোঁজের খবর দেখি। এসব দেখে বড়জোর এক কি দু’বার বড় বড় নিশ্বাস ফেলে আমরা দুঃখ প্রকাশের চেষ্টা করি।
কিন্তু যে পরিবারের কোন মানুষ এমনভাবে নিঁখোজ হয়ে যায়, সে পরিবারের মানুষের সামাজিক, আর্থিক, মানসিক অবস্থার কি পরিণতি হয়, সেটা হয়তো আমরা কেউ কল্পনায় আনতে পারি না।
হঠাৎ খুব ভালোবাসার, খুব কাছের কারো নিরুদ্দেশ হয়ে যাওয়াটা কি মেনে নেয়া ? একদিন অফিসে গেল তারপর আর ফেরার নাম নেই। হঠাৎ করে নিঁখোজ হয়ে গেলেন হাসানুজ্জামান। অনাগত সন্তানের আগামবার্তা তার আর শোনা হলো না।
স্বামী ফিরবে বলে শুরু হয় সুমাইয়ার অপেক্ষার। পুরো পৃথিবী তার কাছে ধীরে ধীরে বিরক্তিকর হয়ে উঠতে থাকে। নানা টানাপোড়েনের মাঝেও তার মনে কেবল বেঁচে থাকার একটি আশা, হাসানুজ্জামান। তার স্বামীর জন্য ‘অপেক্ষা’।
থানা, অফিস, হসপিটাল সবখানে খোঁজ খবর নিয়েও তার স্বামীর কোন সন্ধান পাওয়া যায়নি । সেই দিন থেকে অপেক্ষার শুরু।
হাসানুজ্জামানের নিরুদ্দেশ হওয়ার পর দুই সন্তান ইমন ও সুপ্রভাকে নিয়ে সুরাইয়া তার বড় ভাই জামিলুর রহমানের বাড়িতে আশ্রয় নেয়। সেখানে গিয়ে সুমাইয়া নিজেকে আরো বেশি গুটিয়ে নেয়, একটা ঘরে সারাক্ষণ নিজেকে বন্দী রাখে কেবল স্বামীর ফিরে আসার অপেক্ষায়।
তার বেঁচে থাকার সমস্তটুকুই যেন তার স্বামীর জন্য অপেক্ষা করার মাঝে সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। জগতের সব ব্যাপারেই সুরাইয়ার বিতৃষ্ণা চলে আসে।
ব্যক্তিগত হতাশা ও স্বামীর নিরুদ্দেশের কারণে তার মেজাজটাও হয়ে যায় প্রচন্ড বিক্ষিপ্ত ও রূঢ় । নিজের দুই সন্তান ইমন ও সুপ্রভার সাথেও তার আচরণ দিন দিন অসহনীয় হয়ে যেতে থাকে। সুরাইয়ার অপেক্ষাকে কেন্দ্র করেই পারিপার্শ্বিক জীবনের নানা ঘটনাকে উপজীব্য করে এগিয়ে যেতে থাকে উপন্যাসটি।
মূল গল্পের সাথে তাল মিলিয়ে অন্যান্য চরিত্রের পার্শ্ব গল্পগুলোও সমান্তরালে এগুতেই থাকে ‘অপেক্ষা’ উপন্যাসে। গল্পের নায়ক ইমন ও নায়িকা মিতুর অন্যরকম আবেগ অনুভূতিটিও বেশ সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে এই উপন্যাসে।
ইমনের কাছে পাঠানো মিতুর উড়ো প্রেমের চিঠি কিংবা বেবিটেক্সিতে বসে ভবিষ্যতে ইমনকে বিয়ে করার কথা বলে হকচকিয়ে দেওয়ার সংলাপগুলো পড়ে পুরো উপন্যাসের করুণ সুরের মাঝেও পাঠকরা একটু হেসে ফেলবেন।
উপন্যাসে সুরাইয়ার ভাই জামিলুর রহমানের পরিবারের গল্পটা কাহিনীর প্রয়োজনেই উঠে এসেছে। সাথে ছোট চরিত্র সুপ্রভার আত্মহত্যা, গল্পের মাঝখানে পাঠকে সামান্য আবেগপ্রবণ করে তুলবে।
গল্পে ইমনের এক ছোট চাচাও ছিল। ইমনের চাচা খুবই আদর করতেন ইমন, সুপ্রভা কে। চিঠি দিতেন ইমনকে, খোঁজ নিতেন তার অবস্থার । ইমন কল্পনায় তার চাচাকে দেখতে পায়। আমরা প্রিয়জন কে হয়তো এভাবেই কল্পনায় দেখতে পাই যখন তারা দূরে থাকেন। সুরাইয়া তার স্বামী কে দেখতে পায় কল্পনায়। সুপ্রভাকেও দেখতে পায়।
অবশ্য সুপ্রভার মা সুরাইয়াই বলেছিল, “ছাঁদ থেকে ঝাপ দিয়ে মরতে পারিস না “
সুপ্রভা মারা যাওয়ার পরে সুরাইয়ার প্রতি ভীষণ রাগ হয় আমার। কেনো সুপ্রভা কে মরার কথা বললো সুরাইয়া। সুরাইয়া এমন কথা না বললে হয়তো সুপ্রভা এমন টা করতো না।
সুপ্রভা মারা যাওয়ার পর যখন সুমাইয়া সুপ্রভাকে কল্পনা করতেন, সুপ্রভা কে দেখে সুরাইয়া ভয় পায় কারণ সুপ্রভা তো মৃত। মৃত মানুষকে সবাই ভয় পায়। অথচ মৃত মানুষ তো মানুষের কোন ক্ষতি করে না।
সুরাইয়ার সব অপেক্ষা তার স্বামীর জন্য। কারণ জীবিত মানুষের জন্যই তো মানুষের সব অপেক্ষা। সুরাইয়ার বিশ্বাস তার ছেলে ইমনের বিয়ের দিনই তার স্বামী ফিরে আসবে। কারণ জীবিত মানুষ ফিরে আসার জন্য অপেক্ষা করা যুক্তিযুক্ত। মৃত মানুষ কখনো ফিরবে না।
গল্পের অন্যতম মুল চরিত্র মিতু ও ইমন। তাদের গল্পটিও সুন্দর ভাবে ফুটে উঠেছে এই গল্পে। মিতু যে কিনা ভালোবাসতো ইমনকে। মিতু ইমনের বাসর রাত উপস্থিত। সুরাইয়া চিন্তিত তার স্বামী কি ফিরবে?
মিতু বের হয়েছে ঘর থেকে চা বানানোর জন্য। সুরাইয়ার মনে পড়ে যায় যে, সুরাইয়ার নিজেও বাসররাতে চা বানাতে গিয়েছিল।
তবে কি ইমন ও এমন হারিয়ে যাবে? সুরাইয়ার কাছে সব চক্রের মতো লাগে।
যেনো পুরো দুনিয়া একটা চক্র। এই চক্র ঘুরছে তো ঘুরছে। হঠাৎ বেজে উঠলো কলিং বেল। তবে কি ইমনের বাবা সত্যি সত্যিই ফিরে আসলো??
কিন্তু প্রকৃতি তাকে উজাড় করে অপেক্ষার ফল দিয়েছিলো কি না, সে ব্যাপারে হুমায়ূন আহমেদ বরাবরের মতোই একটা ধোঁয়াশা রেখেছেন গল্পের শেষে । সুরাইয়ার খুব আনন্দ বা আশাভঙ্গের বেদনার সিদ্ধান্তটি পাঠকদের হাতেই হয়তো ছেড়ে দিয়েছেন তিনি!
অপেক্ষা গল্পটি অপেক্ষা শব্দটির সঠিক অর্থ ফুটিয়ে তুলেছে। এক মধ্যবিত্ত পরিবারের সুখ দুখ, আনন্দ – বেদনা সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন হুমায়ুন আহমেদ।
চমৎকার এক কাহিনী দিয়ে লেখা এই অপেক্ষা উপন্যাসটি, দেরি না করে আজকেই পড়ে ফেলুন এই বইটি। আর আপনাদের পড়ে কেমন লাগলো জানাতে ভুলবেন না কিন্তু…..!
আরও ব্লগ পড়তে #এখানে ক্লিক করুন।
Joy Barua
Intern
Content writing Department, YSSE