স্বাধীনতা যুদ্ধ বাঙ্গালী জাতির এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। বহু ত্যাগ – তিতিক্ষার ফল এই স্বাধীনতা বাঙালির গৌরব, ঐতিহ্য ও চেতনার আরেক নাম। ‘৭১ এ মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলার মানুষ শত্রু মোকাবেলায় যে যার অবস্থান থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সে সময়টাতে বাংলার মানুষ ভুলে গিয়েছিল উঁচু-নিচু,ধর্ম-বর্ণ, জাতির ভেদাভেদ। তখন জন্মভূমির স্বাধীনতা অর্জনই ছিল একমাত্র মূখ্য বিষয়। মহান মুক্তিযুদ্ধে পুরুষ যোদ্ধাদের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে অকুতোভয়ে যুদ্ধ করে গেছেন গুটিকয়েক সংগ্রামী নারী যোদ্ধাও। যাদের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ অংশগ্রহণে নিশ্চিত হয়েছে অতি মূল্যবান স্বাধীনতা। তেমনি একজন সাহসী নারী যোদ্ধা ছিলেন পাবনার প্রীতিলতা খ্যাত শিরিন বানু মিতিল। আমরা খুব কম মানুষই তার সম্পর্কে জানি। তিনি প্রচলিত সমাজব্যবস্থা,বিধিনিষেধ, নিয়ম-শৃঙ্খলাকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে বীরদর্পে রণাঙ্গনে যুদ্ধ করে এক অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন।
চলুন জেনে নেয়া যাক এ মহীয়সী নারী সম্পর্কে।
শৈশব ও বেড়ে ওঠা:
শিরিন বানু মিতিল এক সংগ্রামী, তেজস্বী ও প্রথিতযশা বঙ্গনারী যার জন্ম পাবনা জেলায়, ১৯৫০ সালের ২রা সেপ্টেম্বর। তাঁর বাবা খন্দকার শাহজাহান মোহাম্মদ তৎকালীন কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য ও মা সেলিনা বানু ছিলেন পাবনা জেলার ন্যাপ সভানেত্রী এবং পরবর্তীতে ১৯৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট সরকারের এমপি। সুতরাং, বোঝাই যাচ্ছে ছোটবেলা থেকে কতোটা রাজনৈতিক আবহে বেড়ে উঠেছিলেন এই নারী।
বয়স বাড়ার সাথে সাথে সমাজসচেতন ও মুক্তচিন্তার অধিকারী এ নারী নিজের মধ্যে প্রবল দেশপ্রেম লালন করা শুরু করেন।
শিক্ষাজীবন:
তখনকার সময়ে মেয়েরা যেখানে থাকতো চার দেয়ালের অন্তরালে সেখানে শিরিন বানু ছিলেন এক প্রগতিশীল আধুনিক চিন্তাধারার মানুষ। রাজনীতির সাথে যুক্ত ছিলেন ছাত্রজীবন থেকেই। পাবনা এডওয়ার্ড কলেজের বাংলা বিভাগে পড়াকালীন এ মেধাবী ছাত্রী ১৯৭০-১৯৭১ সাল পর্যন্ত ছিলেন পাবনা জেলা ছাত্র ইউনিয়নের সভানেত্রী এবং পরে কিছু দিন পাবনা জেলা মহিলা পরিষদের যুগ্ম সম্পাদিকা ছিলেন।
যুদ্ধে যোগদান:
১৯৭১ সালে যখন যুদ্ধ শুরু হয় তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ২০ বছর। এ বয়সে যুদ্ধে যাওয়ার মতো একটা সিদ্ধান্ত নেওয়া ছিল নিছক পাগলামি ছাড়া কিছুই নয়। তবুও সব উপেক্ষা করে পরিবারের সম্মতি নিয়ে নেমে গেলেন যুদ্ধের ময়দানে। জানা যায় যে, ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের বিপ্লবী অগ্নিকন্যা প্রীতিলতা ওয়াদ্দেদারকে তিনি প্রবলভাবে অনুসরণ করতেন। তাঁর মতোই প্যান্ট শার্ট পড়ে চোখে চশমা, মাথায় ছোট চুল নিয়ে পুরুষের বেশ ধারণ করতেন। ভাইদের কাছ থেকে শিখে নিয়েছিলেন অস্ত্র চালানোর কৌশল। বজ্রকণ্ঠী এ নারীর একটি বিখ্যাত উক্তি ছিল ” মেরে মরবো “।
ইতিহাস ঘেঁটে জানা যায়, মুক্তিযুদ্ধের সময় পাবনা এক্সচেঞ্জে পাকসেনা ও মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ সংগঠিত হয় যেখানে তিনিই ছিলেন একমাত্র নারী বীরসেনানী। এ যুদ্ধে ৩৬ জন হানাদার বাহিনী নিহত হয় এবং ২ জন মুক্তিযোদ্ধা শহীদ হয়। এভাবে একের পর এক সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণের ফলে তাঁর বীরত্বের কথা চারদিকে ছড়িয়ে পড়ে। একপর্যায়ে ভারতীয় স্টেটসমেন্ট পত্রিকায় তার ছবি সহ সাক্ষাৎকার ছাপা হলে তাঁর পক্ষে আর পুরুষবেশ ধারণ করা সম্ভব হয়নি। এর কিছুদিন পর পাবনা শহর পাকসেনাদের দখলে চলে এলে শিরিন বানু সীমান্ত পেড়িয়ে ভারতে চলে যান। সেখানে নারীদের জন্য তৈরি একমাত্র প্রশিক্ষণ শিবির “গোবরা ক্যাম্প” এ যোগ দেন। কয়েক মাসের গেরিলা প্রশিক্ষণ শেষে আবারও দেশে ফেরেন এ সাহসী নারী। অতঃপর মেজর জলিল এর নেতৃত্বে ৯ নাম্বার সেক্টরে নিয়মিত যুদ্ধ করেন।
যুদ্ধ পরবর্তী শিরিন বানু:
দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে তিনি বীরবেশে ঘরে ফিরেন। পরবর্তীতে ১৯৭৩ সালে তৎকালীন সোভিয়েত ইউনিয়ন বর্তমানে রাশিয়ার পিপলস ফেন্ডশীপ ইউনিভার্সিটিতে নৃবিজ্ঞানে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জনের জন্য চলে যান। এরই মধ্যে ১৯৭৪ সালে মাসুদুর রহমানের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হোন তিনি। পড়াশোনা শেষ করে ১৯৮০ সালে আবার দেশে ফিরে আসেন।
কর্মজীবন:
কর্মজীবনে শিরিন বানু বেসরকারি সংস্থা পিআরআইপি ট্রাস্টের সাথে যুক্ত ছিলেন। ছিলেন এ সংস্থাটির “জেন্ডার অ্যান্ড গভার্নেস” বিষয়ে প্রধান পরামর্শক। এছাড়াও তিনি চাইল্ড অ্যান্ড মাদার কেয়ার নামে একটি সেবাকেন্দ্রের বিশেষজ্ঞ হিসেবে যুক্ত ছিলেন।
মৃত্যু:
দুই সন্তানের জননী এই মহিয়সি নারী ২০১৬ সালে ২১ জুলাই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান।
অনুপ্রেরণার আরেক নাম শিরিন বানু
আজ কোথায় নেই নারী? স্থলে, জলে, অন্তরীখে, রণাঙ্গনে সর্বত্র নারীর জয়জয়কার। যুগে যুগে এইসব নারীরাই প্রেরণাদায়ী হিসাবে কাজ করে যাচ্ছেন। আধুনিক যুগে নারীদের জন্য শিরিন বানু মিতিল হতে পারেন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। স্বাধীনতার জন্য লড়াই করা জাতির এই সূর্যসন্তানকে বাংলার মানুষ চিরকাল অসীম শ্রদ্ধায় স্বরণ করবে।
আরও ব্লগ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
Writer
Baitul Hikma
Intern,
Content Writing Department. YSSE