খুলি ও মস্তকবিহীন শিশুর জন্ম!কিংবা কিছুটা ব্যাঙের মত দেখতে বাচ্চার জন্ম বা ব্যাঙ বাচ্চার মিথ! এধরনের অদ্ভূত কিছু ঘটনার কথা মাঝে মাঝেই আমরা শুনে থাকি। এধরনের ঘটনার কথা শুনে আপনাদের মনে হতেই পারে কোথাও কোনও একটা বড় ভুল হচ্ছে। মানুষের ঘরে ব্যাঙ হতে পারে না।
এ কথার পরিপ্রেক্ষিতে আমি বলবো “হ্যাঁ হয়, ব্যাঙ না, মানুষের বাচ্চাই হয়। তবে দেখতে কিছুটা ব্যাঙের মতো।”
আমার কথা শুনে বিস্ময়ে হয়তো আপনার চোখ কপালে উঠে গেছে! আপনাদেরকে কিছুক্ষণের মধ্যেই পুরো বিষয়টি বিস্তারিতভাবে ব্যাখ্যা করছি কিন্তু তার আগে এখন তো একটু কপাল থেকে চোখটা নামান। বলছিলাম এনেনসেফালির কথা। এটি অবশ্য অ্যানেন্সফালি নামেও পরিচিত।
অ্যানেন্সফালি হল একটি গুরুতর জন্মগত ত্রুটি যেখানে একটি শিশু মস্তিষ্ক এবং মাথার খুলির অংশ ছাড়াই জন্মগ্রহণ করে। এটি এক ধরনের নিউরাল টিউব ডিফেক্ট (NTD) যা ভ্রূণের বিকাশের সময় ঘটে।
নিউরাল টিউব গঠন এবং বন্ধ হওয়ার সাথে সাথে এটি শিশুর মস্তিষ্ক এবং মাথার খুলি (নিউরাল টিউবের উপরের অংশ), মেরুদন্ড এবং পিঠের হাড় (নিউরাল টিউবের নীচের অংশ) গঠনে সহায়তা করে।
এটি একটি সেফালিক ডিসঅর্ডার যা নিউরাল টিউব ত্রুটির ফলে ঘটে এবং সাধারণত গর্ভধারণের পরের 23 থেকে 26 দিনের মধ্যে ঘটে যখন নিউরাল টিউবের রোস্ট্রাল (মাথা) প্রান্তটি বন্ধ হতে ব্যর্থ হয়।
অ্যানেন্সফালি কতটা সাধারণ?
প্রতি ৫০০০ থেকে ১০,০০০ জন শিশুর মধ্যে প্রায় একজন অ্যানেন্সফালি নিয়ে জন্মায় এবং এই অবস্থাটি ছেলেদের তুলনায় বাচ্চা মেয়েদের বেশি প্রভাবিত করে।
অ্যানেন্সফালি সহ বেশিরভাগ গর্ভাবস্থা গর্ভপাত বা মৃত প্রসবের মাধ্যমে শেষ হয়।
যাদের এনটিডিতে (NTD) আক্রান্ত অন্য একটি সন্তান হয়েছে, যেমন স্পিনা বিফিডা(Spina Bifida), তাদের গর্ভজাত পরবর্তী শিশুটিরও অ্যানেসেফালিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে।
কারণ সমূহ:
গর্ভাবস্থায় পরিবেশগত কারণ, জিন এবং পুষ্টির সংমিশ্রণ সম্ভবত অ্যানেন্সফালির কারণ হয়। কিছু ওষুধ এবং ঝুঁকির কারণ অ্যানেন্সফালি বা অন্য এনটিডি সহ শিশুর জন্মের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয়, যার মধ্যে রয়েছে:
- ফলিক অ্যাসিডের অভাব:
যে মহিলারা গর্ভবতী অবস্থায় পর্যাপ্ত পরিমাণ ফলিক অ্যাসিড (ভিটামিন B9) পান না/গ্রহণ করেন না তাদের অ্যানেন্সফালিতে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। গর্ভাবস্থার আগে এবং গর্ভাবস্থায় মহিলাদের ৪০০ মাইক্রোগ্রাম (mcg) ফলিক অ্যাসিড সহ প্রসবপূর্ব ভিটামিন গ্রহণ করা উচিত।
- ডায়াবেটিস:
অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিস এনটিডির(NTD) ঝুঁকি বাড়ায়। এটি রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা (রক্তে চিনি) খুব বেশি বাড়িয়ে তোলে এবং ভ্রূণের বিকাশের ক্ষতি করে।
- শরীরের উচ্চ তাপমাত্রা:
গর্ভাবস্থার প্রথম দিকে জ্বর হলে আপনার শিশুর এনটিডি হওয়ার ঝুঁকি বাড়তে পারে।
- ওষুধ:
ফেনাইটোইন (ডিলান্টিন), কার্বামাজেপাইন (টেগ্রেটল) এবং ভালপ্রোইক অ্যাসিড (ডেপাকোট) এর মতো খিঁচুনি-বিরোধী ওষুধ সেবনের ফলে এনটিডি(NTD) হতে পারে। এর মধ্যে কিছু ওষুধ মাইগ্রেন এবং বাইপোলার ডিসঅর্ডারেরও চিকিৎসা করে।
- স্থূলতা:
গর্ভাবস্থার পূর্বে যাদের স্থূলতা ছিল তাদের অ্যানেন্সফালি বা অন্য এনটিডিতে (NTD) আক্রান্ত বাচ্চা হওয়ার সম্ভাবনা বেশি থাকে।
- ওপিওড ব্যবহার:
গর্ভাবস্থার প্রথম দুই মাসে ওপিওড গ্রহণ করলে এনটিডি (NTD) হতে পারে।
ওপিওডের মধ্যে রয়েছে হেরোইন (একটি অবৈধ ওষুধ) এবং প্রেসক্রিপশনজনিত ব্যথানাশক ঔষধ যেমন হাইড্রোকডোন।
রোগ নির্ণয়:
গর্ভাবস্থায়:
- এএফপি(AFP):-
এএফপি(AFP) এর অর্থ হল আলফা-ফেটোপ্রোটিন, একটি প্রোটিন যা অনাগত শিশু উৎপন্ন করে। সাধারণত রক্ত পরীক্ষা করে ডাক্তাররা পরিমাপ করেন কতটা এএফপি(AFP) শিশুর থেকে মায়ের রক্তপ্রবাহে প্রবেশ করেছে।
উচ্চ মাত্রার এএফপি(AFP) এর অর্থ হতে পারে যে শিশুটির এনেনসেফালি আছে। একটি AFP পরীক্ষা “ট্রিপল স্ক্রিন” নামক একটি পরীক্ষার অংশ হতে পারে যা নিউরাল টিউব ত্রুটি এবং অন্যান্য সমস্যাগুলি নির্ণয়ে ।
- আল্ট্রাসাউন্ড – প্রায়শই, এই পরীক্ষার মাধ্যমে অ্যানসেফালি দেখা যায়।
- অ্যামনিওসেন্টেসিস – এই পরীক্ষায়, ডাক্তার গর্ভের শিশুর চারপাশে থাকা অ্যামনিওটিক তরলের একটি ছোট নমুনা নেন। তরলে অ্যামনিওসেন্টেসিস এফপি(AFP)-এর গড় মাত্রার চেয়ে বেশি হওয়ার মানে হতে পারে যে শিশুটির অ্যানেন্সফালি আছে।
- এম.আর.আই– অ্যানেন্সফালি শনাক্ত করতে বা নির্ণয় করতে ডাক্তার সম্ভবত একটি ম্যাগনেটিক রেজোন্যান্স ইমেজিং (MRI) স্ক্যান করতে চাইবেন।
এনেনসেফালি কি চিকিৎসা করা যেতে পারে?
স্বাস্থ্যসেবা প্রদানকারীরা এনেনসেফালির চিকিৎসা করতে পারেন না। অ্যানেন্সফালি নিয়ে জন্ম নেওয়া প্রায় সব শিশুই জন্মের কয়েক ঘণ্টা বা দিনের মধ্যে মারা যায়। জন্মের পর বেঁচে থাকা শিশুরা স্পর্শ বা শব্দে সাড়া দিতে পারে বলে মনে হতে পারে, কিন্তু এই প্রতিক্রিয়াগুলি অনিচ্ছাকৃত। অ্যানেন্সফালি আক্রান্ত নবজাতক অচেতন, অন্ধ এবং বধির। অ্যানেন্সফালি আক্রান্ত শিশুরা ব্যথা অনুভব করতে পারে না।
আমি কিভাবে এনেনসেফালি প্রতিরোধ করতে পারি?
যদিও অ্যানেন্সফালি প্রতিরোধ করা সবসময় সম্ভব নয়, তবে আপনি নিম্নলিখিত নিয়মাবলী মেনে চলার মাধ্যমে এই ঝুঁকি কমাতে সক্ষম হতে পারেন।
- প্রচুর পরিমাণে ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ করুন :
প্রতিদিন ৪০০ মাইক্রোগ্রাম ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ করুন, এমনকি যদি আপনি এখনই বাচ্চা নেওয়ার পরিকল্পনা না করেন।
নিউরাল টিউব ডিফেক্ট (NTDs) গর্ভাবস্থার প্রথম মাসে ঘটে, তাই আপনি গর্ভধারণের পরিকল্পনা করার আগে ফলিক অ্যাসিড গ্রহণ শুরু করা অপরিহার্য। যদি আপনার একটি এনটিডি(NTD) আক্রান্ত সন্তান থাকে, তাহলে আপনার চিকিৎসকের সাথে ৪০০ মাইক্রোগ্রাম ফলিক অ্যাসিড গ্রহণের বিষয়ে কথা বলুন।
- নির্দিষ্ট কিছু ওষুধ এড়িয়ে চলুন:
যেসব ওষুধ খিঁচুনি নিয়ন্ত্রণ করে, মাইগ্রেন এবং বাইপোলার ডিসঅর্ডারের চিকিৎসা করে সেগুলির দ্বারা এনটিডি হতে পারে। গর্ভধারণের আগে আপনি যে ওষুধগুলি গ্রহণ করছেন সে সম্পর্কে আপনার চিকিৎসককে জিজ্ঞাসা করুন। আপনি যদি মনে করেন আপনি গর্ভধারণ করতে পারেন বা চান তাহলে ওপিওডস গ্রহণ করবেন না।
- শরীরের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণে রাখুন:
গর্ভাবস্থায় যদি আপনার জ্বর হয়, তাহলে আপনার শরীরের তাপমাত্রা কমাতে অ্যাসিটামিনোফেন নেওয়ার বিষয়ে আপনার চিকিৎসককে জিজ্ঞাসা করুন।
- আপনার স্বাস্থ্য ঠিক রাখুন:
আপনার স্থূলতা থাকলে গর্ভধারণের আগে ওজন কমানোর চেষ্টা করুন এবং গর্ভাবস্থায় স্বাস্থ্যকর ওজন বজায় রাখুন। আপনার যদি ডায়াবেটিস থাকে তবে গর্ভাবস্থায় কীভাবে নিরাপদে ডায়াবেটিস পরিচালনা করবেন সে সম্পর্কে আপনার চিকিৎসকের সাথে কথা বলুন।
এনেনসেফালি একটি দুর্লভ রোগ হলেও আমাদের উচিত এ ব্যাপারে ব্যাপক সচেতনতার সৃষ্টি করা সেইসাথে নিয়মাবলী মেনে চলার মাধ্যমে এ রোগকে প্রতিহত করার চেষ্টা করা।
আমাদের আরও ব্লগ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
Writer
Kulsuma Bahar Bethi
Content Writing Intern
YSSE