ডিজিটাল ডিটক্স বলতে আমরা প্রযুক্তি থেকে সাময়িক বিরতি নেওয়াকে বুঝি, যা আমাদের মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে মোবাইল, ল্যাপটপ, কম্পিউটার, ওয়াই-ফাই, ব্লুটুথ ইত্যাদি আমাদের জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে যেগুলো ছাড়া আমাদের কিছু মুহূর্তও কঠিন হয়ে যায়। আমরা ঘুম থেকে উঠেই ফোন খুঁজতে শুরু করি আবার শোবার আগে ফোন টিপতে টিপতে ঘুমিয়ে যায়। আসুরিয়ন নামে এক প্রযুক্তি সংস্থার জরীপ অনুযায়ী একজন মানুষ প্রতিদিন গড়ে ৯৬ বার ফোন চেক করেন। 

প্রযুক্তির অতিরিক্ত ব্যবহার আমাদের জীবনে নেতিবাচক প্রভাব ফেলছে যেমন: মনোযোগের অভাব, মানসিক চাপ এবং সামাজিক সম্পর্কের অবনতি। অপরপক্ষে ডিজিটাল ডিটক্স এমন প্রক্রিয়া যেখানে একজন ব্যক্তি নির্দিষ্ট সময়সীমা নির্ধারনের মাধ্যমে ইন্টারনেটের সাথে যুক্ত করা যায় এমন সব ডিভাইস থেকে দূরে থাকেন। ডিজিটাল ডিটক্স মানসিক ও শারীরিক স্বাস্থ্যের ওপর ইতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং প্রযুক্তির সাথে একটি সুস্থ সম্পর্ক বজায় রাখতে সহায়তা করে।

ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির টেকনোলজি অ্যান্ড অনলাইন রিসার্চ প্রধান জেসি ফক্সের মতে একজন ব্যক্তি যদি কাজের ফাঁকে ফাঁকে  প্রতি আধঘন্টায় ৫ বার করে মোবাইল চেক করে তাহলে কোনো কাজে কিভাবে তিনি নিজেকে মনোনিবেশ করার সুযোগ দিচ্ছেন?

সারারাত জেগে অনিয়মিত রিলস, মুভি, গেম, মেসেজিং ঘুমের ব্যাঘাত ঘটায়। ডেলয়েট পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, প্রায় ৫৯% মোবাইল ফোন ইউজার ঘুমাতে যাওয়ার ৫ মিনিটের মধ্যে এবং ঘুম থেকে ওঠার ৩০ মিনিটের মধ্যে মোবাইল ফোন চেক করেন। ডেইলি স্টার পত্রিকার তথ্য অনুযায়ী এক গবেষণায়  জানা যায় কম্পিউটার এর স্ক্রিন থেকে নির্গত আলো ঘুমের মেলাটোনিন নামক এক হরমোনের উৎপাদককে ব্যাহত করে। যা স্বাভাবিক ঘুমের চক্রকে ব্যাহত করে। ফলে চোখ ব্যাথা, চোখ দিয়ে পানি পরা, মাইগ্রেন, চোখে কম দেখা, এবং ইনসোমনিয়ার মতো সমস্যা দেখা দিতে পারে। 

ডিজিটাল ডিটক্সের মাধ্যমে ঘুমের মান উন্নত হয়, যেখানে ঘনঘন ফোন চেক করার অভ্যাস নিয়ন্ত্রণ করা হয়। প্রতিদিন ১০-১৫মিনিট ডিজিটাল ডিভাইস থেকে নিজেকে দূরে রাখার মাধ্যমে এটা শুরু করা যেতে পারে। এরপর ধীরে ধীরে সময়টাকে বাড়িয়ে দিয়ে অভ্যাসে পরিণত করতে হবে । ডিজিটাল ডিভাইস গুলোর অপ্রয়োজনীয় নোটিফিকেশন বন্ধ করার মাধ্যমে কাজে  মনোযোগ বৃদ্ধি করা যায়। এছাড়া প্রতিদিনের স্ক্রিন টাইম নির্দিষ্ট করে তা মেনে চললে এই পদ্ধতি আরও কার্যকর করা সম্ভব। এভাবে দৃঢ় সংকল্প নিয়ে একটি অভ্যাস গড়ে তোলার মাধ্যমে আমরা মানসিক শান্তি পুনরুদ্ধার করতে পারি।

ডিজিটাল ডিভাইসের অতিরিক্ত ব্যবহার শারীরিক কার্যকলাপ কমিয়ে দেয়, যা স্থূলতা ও হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ায়। শুয়ে বসে অতিরিক্ত মোবাইল, কম্পিউটার ব্যবহারে মেদ জমে যেতে পারে। এর সাথে অস্বাস্থ্যকর খাবার হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, স্থূলতার ঝুকি বাড়িয়ে দেয়। এক্ষেত্রে ডিজিটাল ডিটক্সের মাধ্যমে শারীরিক কার্যকলাপের সময় বাড়ানো যায়। মাঠে খেলাধূলা, ব্যায়াম, সম্ভব হলে অনলাইনে অর্ডার না দিয়ে নিজে যেয়ে বাজার করা ইত্যাদির মাধ্যমে আমরা সুস্বাস্থ্য ধরে রাখতে পারি এবং আমরা সরাসরি মানুষের সঙ্গে সময় কাটাতে পারি, যা সামাজিক সম্পর্ককে মজবুত করে। 

ইন্টারনেটের মাধ্যমে দূরত্ব, সময় ও সুযোগ জয় করা গেলেও আমাদের মানবিক অনুভূতিগুলো ভোতা হয়ে যাচ্ছে। দূরের মানুষের খোঁজ খবর নেওয়া হলেও একই ছাদের নিচে বসবাসরত মানুষের খোজ খবর নেওয়া হয়ে ওঠে না। এতে সম্পর্ক গুলোতে ফাটল, অভিমান ও ভুল বোঝাবুঝি তৈরি হচ্ছে। 

আমাদের সোশ্যাল মিডিয়ায় মিথস্ক্রিয়ার পাশাপাশি আশেপাশে থাকা পরিবার, বন্ধু, প্রতিবেশিদের  খোঁজখবর নেওয়ার অভ্যাস তৈরি করতে হবে। রাতে খাবার টেবিলে মোবাইল, ল্যাপটপ, টিভির ব্যবহারে নো এন্ট্রি জোন করতে হবে। সবাই সবার সাথে সারাদিনের গল্প বা বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে ডিজিটাল ডিটক্স গড়ে তোলা যেতে পারে। ছোটোবেলায় বাচ্চাদের হাতে মোবাইল ফোন না দিয়ে বই পড়ার অভ্যাস গড়ে তুলতে হবে। এছাড়া নিয়মিত সবাই একসাথে পর্যটন কেন্দ্র ঘুরতে যাওয়া, মাঠে খেলাধূলা, সকালে পার্কে হাটঁতে যাওয়া যোগাযোগ ক্ষমতা বৃদ্ধিতে সাহায্য করে। অবসর সময়ে মোবাইল ব্যবহার না করে আর্ট এন্ড ক্রাফট, ড্রয়িং, রান্না, সেলাই শেখা বা করা ইত্যাদি সুস্থ মন মানসিকতা গড়ে তুলতে সাহায্য করে। 

এছাড়াও সোশ্যাল মিডিয়ায় অতিরঞ্জিত পোস্ট বা ছবি দেখে হতাশা বা অসন্তুষ্টি তৈরি হতে পারে যা ব্যক্তিগত জীবনে প্রভাব ফেলে। ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদন অনুযায়ী, ৮২ জন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের ওপর গবেষনায় দেখা যায়, তারা যত বেশি সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করছেন তত বেশি অসন্তুষ্ট হচ্ছে।  এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে সোশ্যাল মিডিয়ায় যা দেখানো হয় তাই আমরা দেখি। সবাইকে দেখানোর জন্য মানুষ সবচেয়ে ভালো জিনিসটাই হাইলাইট করে থাকে। যা দেখানো হচ্ছে এর বাইরের গল্প আমাদের অজানায় থেকে যায়। সুতরাং আমাদের যা আছে তা নিয়েই সন্তুষ্ট থাকার চেষ্টা করতে হবে।

দিনকে দিন প্রযুক্তি আমাদের জীবনকে হতাশ এবং একঘেয়ে করে তুলছে। আমাদের ওপর  এর মারাত্মক প্রভাব  পরার পর ও অনেকে এখনও সচেতন নই। বর্তমানে তরুণদের মধ্যে একটা শব্দ বেশি শোনা যায় স্ট্রেস বা হতাশা। প্রযুক্তি থেকে বিরতি নেওয়ার মাধ্যমেই আমরা এসব হতাশা, বিরক্তিভাব সরিয়ে আবার স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারি। এক্ষত্রে ডিজিটাল ডিটক্স আমাদের জীবনে মানসিক শান্তি ও শারীরিক সুস্থতা নিশ্চিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রযুক্তির সাথে সুস্থ সম্পর্ক বজায় রাখতে নিয়মিত ডিজিটাল ডিটক্স অভ্যাস করা উচিত।

এই রকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন 

লেখিকা,

সিরাজুম মুনিরা  

ইন্টার্ন,

কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট

YSSE