নিত্যনতুন প্রযুক্তি আর উদ্ভাবন আমাদের সময় ও জীবনকে অনেক বেশি গতিশীল করেছে। সেই গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার উপযোগী হতে প্রতিনিয়ত নতুন নতুন বিষয় শিখতে হচ্ছে, সমৃদ্ধ করতে হচ্ছে নিজেদের। এর প্রভাব শিক্ষাক্ষেত্রেও পড়েছে ব্যাপকভাবে। পাঠ্যপুস্তকের বাইরের জগতের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে শিক্ষার্থীদের বইয়ের বাইরেও ভবিষ্যতে কাজে লাগবে এমন অনেক কিছু হাতে-কলমে শিখতে হচ্ছে। এ নিয়ে অভিভাবকদেরও দুশ্চিন্তার শেষ নেই।কোনো স্কুল বা কেমন কারিকুলাম থেকে শিক্ষার্থীরা নিজেদের ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তুত করতে পারবে, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় ভোগেননি এমন অভিভাবক খুঁজে পাওয়া মুশকিল।তারই পরিপ্রেক্ষিতে দেশে প্রথম আন্তর্জাতিক বোর্ডিং স্কুল হিসেবে যাত্রা শুরু করতে যাচ্ছে হেইলিবারি।

প্রায় ১ হাজার শিক্ষার্থীর আবাসিক সুবিধা থাকা যুক্তরাজ্যের নামকরা এ স্কুলটির শাখা শতাধিক ছাত্র নিয়ে আগামী বছরের জুনে যাত্রা শুরু করবে। 

৭০০ কোটি টাকা বিনিয়োগে গড়ে ওঠা প্রতিষ্ঠানটিতে শিক্ষার্থীদের বছরে খরচ হবে প্রায় ৩৪ হাজার ডলার বা ৩৭ লাখ টাকা। শিক্ষাবিদরা বলছেন, এমন উদ্যোগে বিশ্বমানের শিক্ষায় বিদেশে অর্থ খরচের চাপ কমবে।

রাজধানী থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরে ময়মনসিংহের ভালুকায় গড়ে উঠছে যুক্তরাজ্যের সুপরিচিত হেইলিবারি স্কুলের শাখা। এই বোর্ডিং স্কুলে ১ হাজার শিক্ষার্থীর জন্য রয়েছে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত আবাসিক সুবিধা। সুপরিসর শ্রেণিকক্ষ, বিশ্বমানের লাইব্রেরি ও ল্যাবসহ আছে সর্বাধুনিক সব সুবিধা। শিক্ষার্থীরা পাবে পাঁচ তারকা মানের খাবার আর খেলাধুলার উন্নত প্রশিক্ষণ।

এখানে ষষ্ঠ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত ইংরেজি মাধ্যমে লেখাপড়ার সুযোগ পাবে শিক্ষার্থীরা। অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত একজন শিক্ষার্থীর বছরে খরচ হবে সাড়ে ৩৪ হাজার ডলার বা প্রায় ৩৭ লাখ টাকা। ভর্তির ফি ৮ হাজার ডলার বা প্রায় ৮ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। তবে প্রথম ব্যাচের ভর্তি হওয়া শিক্ষার্থীদের দেওয়া হবে ৬ হাজার ডলারের ছাড়। 

হেইলিবারি ভালুকার চেয়ারম্যান আমিন আহমদের থেকে জানা যায় যে , ‘১৭৫ কোটি’ ওভার দ্যা ইয়ার্স তারা এখানে স্কলারশিপ দেবেন। এরমধ্যে যারা মেধাবি তাদের অনেকেই ৩০ থেকে ৪০ ভাগ স্কলারশিপ পেয়ে যাবেন। মেধাবিদের পড়ার আরও অনেক ব্যবস্থা থাকবে। এছাড়াও এখানে পড়তে আসা মেধাবী ও দরিদ্র শিক্ষার্থীদের জন্য বিভিন্ন বিদেশি ব্যাংক ও কোম্পানি আর্থিক সহায়তা প্রদানের জন্য প্রতিশ্রুতি বদ্ধ হয়েছেন। 

দক্ষিণ এশিয়ায় হেইলিবারির প্রথম এই শাখার মাধ্যমে বিদেশি অনেক শিক্ষার্থী বাংলাদেশে আসবে বলে আশাবাদী শিক্ষাবিদদের। 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য এস এম এ ফায়েজ বলেন, ‘আমাদের অনেক অভিভাবক তাদের বাচ্চাদেরকে বিদেশে পাঠাচ্ছে। মালয়েশিয়ায় পাঠাচ্ছে বা পশ্চিমা দেশগুলোতে পাঠাচ্ছে। আমার মনে হয় এই বিশ্বমানের একটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠান যদি আমরা গড়ে তুলি তাহলে আমাদের ছেলে মেয়েদেরকে আর বাহিরে যেতে হবে না। এখানেই তারা সেই মানের শিক্ষা পাবে যেটা কিনা গ্লোবাল সিস্টেমে দারুনভাবে গ্রহণযোগ্য।’ 

যুক্তরাজ্যের ১৬০ বছরের পুরনো স্কুল হেইলিবারি। বাংলাদেশে তাদের শাখা পরিচালিত হবে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অনুমোদনপ্রাপ্ত শিক্ষকদের মাধ্যমে।

এখানে আবাসিক স্কুলের বিশেষত্ব তুলে ধরার একটু প্রয়াস রইলো

বিশেষজ্ঞদের মতে , শিক্ষার্থীর ভবিষ্যৎ নির্মাণে বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে আবাসিক স্কুল। এ স্কুলের কিছু বৈশিষ্ট্য শিক্ষার্থীদের জীবন গঠনে বেশ সহায়ক ভূমিকা রাখে। সাধারণত নির্দিষ্ট এলাকাভিত্তিক স্কুলে ওই এলাকার শিক্ষার্থীরাই শিক্ষাগ্রহণ করে। পরবর্তীকালে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে তাদের বৃহত্তর পরিবেশ ও পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে অসুবিধা হয়। কিন্তু আবাসিক স্কুলগুলোতে বিভিন্ন অঞ্চল, আর্থ-সামাজিক অবস্থা থেকে শিক্ষার্থীরা পড়তে আসে। ফলে ভবিষ্যতে যে কোনো জায়গা বা পরিস্থিতিতে মানিয়ে চলার মানসিকতা তাদের মধ্যে স্বতঃস্ফূর্তভাবে গড়ে ওঠে।

আবাসিক স্কুলের আরেকটি বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, এখানকার শিক্ষার্থীদের মধ্যে ছাত্রাবস্থায়ই স্বাবলম্বী হওয়ার প্রবণতা গড়ে ওঠে। অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, দীর্ঘ সময় পর্যন্ত ছেলেমেয়েরা নিজের কাজ নিজে করতে পারে না। শিশুদের প্রতি বাবা-মায়ের স্নেহের প্রকাশ খুবই স্বাভাবিক, তবে সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে এই শিশুরা বাবা-মায়ের ওপর অতিনির্ভর হয়ে পড়ে। যখন তাদের নিজের দায়িত্ব নিজের নেওয়ার কথা, তখন এই নির্ভরতার নেতিবাচক প্রভাব লক্ষ করা যায়। আবাসিক স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিজের কাজ নিজেকেই করতে হয়। নিজের কাপড় গুছিয়ে যথাস্থানে রাখা, নিজের থাকার জায়গাটা পরিষ্কার করে নেওয়া, পড়ার টেবিল, খাওয়ার প্লেট নিজে ধুয়ে নেওয়ার মতো কাজগুলোকে সামান্য মনে হতে পারে। কিন্তু শিক্ষার্থীর মানসিক গঠনে এই সামান্য কাজেরই ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। এভাবে শিক্ষার্থীরা দায়িত্বশীল হওয়া শেখে। সিদ্ধান্ত নেওয়া ও তা বাস্তবায়ন করার মতো বিষয়ে পারদর্শী হয়ে ওঠে।

স্কুল শুধু পাঠ্যবইয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, বরং বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ শিক্ষার্থীর মানসিক গঠন ও মেধার বিকাশে খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। আর সেজন্যই আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থায় পড়াশোনার পাশাপাশি পর্যাপ্ত খেলাধুলা ও সহপাঠ্ক্রমিক কার্যক্রমের দিকে মনোযোগ দেওয়া হয়। এতে করে যেমন ওই শিক্ষার্থীর মধ্যে বিশেষ কিছু দক্ষতা তৈরি হয়, তেমনি তার কোন বিষয়ে আগ্রহ রয়েছে তাও বোঝা যায়। আবার শরীর ও মন ভালো থাকার কারণে পড়াশোনাতেও পুরো মনোযোগ দিতে পারে তারা। এক্ষেত্রে আবাসিক স্কুলগুলোই এগিয়ে থাকে। এখানে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলা, নাচ-গান, বিতর্ক, শিল্প-সাহিত্য বা সেবাদানের মতো কার্যক্রমে অভ্যস্ত হওয়ার সুযোগ পায়। এ ধরনের পাঠ্যক্রম তাদের মধ্যে নেতৃত্বের গুণাবলী বিকশিত করে।

এ ধরনের স্কুলের শিক্ষার্থীদের অনেকটা সময় একসঙ্গে কাটাতে হয়। ফলে তাদের মধ্যে বিশেষ বন্ধন গড়ে ওঠে, যা জীবনের পরবর্তী সময়ে অনেক কাজে লাগে। তারা স্কুল থেকে অনেক স্মৃতি নিয়ে বের হয়। এ কারণে এসব স্কুলের অ্যালামনাই সংগঠনগুলোও শক্তিশালী হয়ে গড়ে ওঠে। শিক্ষার্থীর মেধার পরিপূর্ণ বিকাশে এবং শারীরিক ও মানসিকভাবে উপযোগী হয়ে গড়ে ওঠার পেছনে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে পারে আবাসিক স্কুল।

 

এরকম আরও ব্লগ সম্পর্কে জানতে আমাদের সাথেই থাকুন।

 

লেখিকা

ফারিহা আলিফ

ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট

YSSE