গ্রন্থ: শ্রাবণ মেঘের দিন।
লেখক: হুমায়ুন আহমেদ।
প্রকাশকাল: ৩০ নভেম্বর, ১৯৯৪ খ্রিষ্টাব্দে (প্রথম প্রকাশনা)
পটভূমি: মিউজিক্যাল রোমান্টিক, ট্র্যাজেডী
প্রধানচরিত্র: শাহানা, কুসুম, মতি, পুষ্প।
গ্রন্থালোচনা
“শ্রাবণ মেঘের দিন “হুমায়ুন আহমেদের এক অমর কীর্তি । এই উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিলো ৩০ নভেম্বর, ১৯৯৪ সালে। যা পাঠক জনপ্রিয়তার কারণে ১৯৯৯ সালে হুমায়ুন আহমেদ একে চলচ্চিত্রে রূপদান করেন।
সাহিত্য জগতে এই উপন্যাসটির কাহিনী ও চরিত্র গুলো সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলতে লেখক যথেষ্ট দক্ষতা দেখিয়েছেন। সেই সাথে কুঁড়িয়েছেন প্রশংসা, অর্জন করেছেন অসংখ্য পুরষ্কার।
সেই সময় থেকে শুরু করে বর্তমান কালে এসেও বাংলা সাহিত্যে মিউজিক্যাল রোমান্টিক ধারার উপন্যাস তেমন দেখতে পাওয়া যেত না বললেই চলে। যে কারণে সব শ্রেণি পেশার মানুষের কাছে আস্থার আরেক নাম হুমায়ুন আহমেদ।
যেহেতু তিনি রূপের পূজারী ছিলেন তাই বোধহয় তার শ্রাবণ মাসের প্রতি এতো দুর্বলতা কাজ করতো । আর এমনি এক শ্রাবণেই ২০১২ সালে আমাদের ছেড়ে তিনি না ফেরার দেশে পাড়ি দেন।
কাহিনি পর্যালোচনা
মূলত, লেখক ভাটি অঞ্চলের কিছু লোকজ সংস্কৃতিকে তুলে ধরেছেন। উপন্যাসের এমন কিছু চরিত্র আছে যাদের বিয়োগ গাঁথা ও দারিদ্র্য পিরীত জীবনযাপন চোখে জল আনতে বাধ্য করে । নিতু ও পুষ্পের বন্ধুত্ব বলুন কিংবা মতি মিয়ার প্রতি কুসুমের ভালোবাসা, গল্পটি আমার কাছে এক কথায় হৃদয়গ্রাহী ।
এটি একদিকে যেমন ভালোবাসার মেলবন্ধনের গল্প; অন্যদিকে ঠিক তেমনি হাওরাঞ্চলে থাকা হতদরিদ্র মানুষের দুঃখ-কষ্টের কথা, অতি সরল গ্রামের মানুষের অকৃত্রিম ভালোবাসা, নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক পরিবেশ ও মন ভোলানো আঞ্চলিক গানের সমাহার । তাই বলা যায় “শ্রাবণ মেঘের দিন” হুমায়ুন আহমেদের একটি সুন্দর ও সাবলীল ধারার অনবদ্য রোম্যান্টিক উপন্যাস।
উপন্যাসটির উল্লেখযোগ্য কিছু উক্তি যা এখনোও মানুষকে প্রবল আকর্ষণ করে –
“মানুষের স্বভাব খানিকটা বোধহয় শামুকের মত। নিজের শক্ত খোলসের ভেতর মাঝে মাঝেই তাকে ঢুকে যেতে হয়। অতি প্রিয়জনের সঙ্গও সে সময় অসহ্যবোধ হয়”।
-শ্রাবণ মেঘের দিন(হুমায়ুন আহমেদ)।
“কিছু কিছু মানুষের সঙ্গে কথা বলতে ভালো লাগে।কারণ ছাড়াই কথা বলতে ইচ্ছা করে। তবে,মানুষটা বেশি সুন্দর হলে সমস্যা, বেশি সুন্দর মানুষকে আপন বলে মনে হয় না পর পর লাগে”
– শ্রাবণ মেঘের দিন(হুমায়ুন আহমেদ)।
ঘটনা পরিক্রমা:
উপন্যাসের শুরু হয় নিতু নামের এক ছোট্ট বালিকা ও শাহানা নামে এক প্রাপ্ত বয়স্ক যুবতীর চরিত্র দিয়ে। হুমায়ুন আহমেদের শ্রাবণ মেঘের দিন উপন্যাসের অন্যতম কেন্দ্রীয় ও প্রধান চরিত্র এই শাহানা চরিত্র টি।
হাওরাঞ্চলে মাঝে অবস্থিত দ্বীপের মতো আধুনিক সুযোগ সুবিধা বিহীন গ্রাম। যেখানে দারিদ্র্যতা, কুসংস্কারের সাথে আছে অঢেল প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। আর সেই গ্রামটির নাম “সুখানপুর”।
ওস্তাদের আদেশ মোতাবেক বিয়ে করবে না বলে সংকল্পবদ্ধ হয়ে গানের প্রতি তীব্র অনুরাগী হয় এক যুবক। “শ্রাবণ মেঘের দিন” উপন্যাসটিতে এই প্রধান চরিত্রটি হলো “মতি মিয়া”। সে সুখানপুর গ্রামর এক অতিপরিচিত লোক। যে সবার বিপদে আপদে স্বার্থ ছাড়াই এগিয়ে যায়। গরীব হওয়ার সত্ত্বেও গানের প্রতি তার অনুরাগ একটুও কমেনি। বরং সে নিজেই গড়ে তোলে বাউল দল।
এই মতি মিয়াকে মনে মনে ভালবাসে “কুসুম” নামের মেয়েটি । কিন্তু পারিবার ও সামাজের ভয়ে কখনোই তা প্রকাশ করতে পারেনি কুসুম। বহুবার বলবে বলবে করেও বলা হয়ে উঠে না তার
একদিকে ডাক্তারি তে উচ্চশিক্ষা গ্রহণ করার পরিকল্পনা অন্য দিকে সুখানপুরে দাদার বাড়িতে ঘুরতে আসার পরিকল্পনা শাহানা ও তার ছোট বোন নিতুর। জমিদার দাদু ইরতাজুদ্দিন আহমেদের” সাহেবের সাথে দেখা করতে গ্রামে আসা। যদিও তাদের দাদুর বর্তমানে জমিদারী নেই তবে এখনো রয়েছে খানদানি বাড়ি আর ক্ষমতার দাপট।
অনেকদিন পর গ্রামের বাড়ি এসে ঘুরতে বের হয় শাহানা ও নিতু। শ্রাবণ মাসে কোন একদিন শাহানা বের হলো চারপাশে দেখবে বলে। হঠাৎ চোখে পড়ে কদমগাছে ঘেরা এক দীঘি,যার নাম হলো “অশ্রুদীঘি“।
শাহানার সহজ সরল বাচনভঙ্গি ও আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব গ্রামের সবাইকে বিমোহিত করে । ১৯৭১ সালে শাহানার দাদু জমিদার ইরতাজুদ্দিন পাকিস্তানিদের গোপনে সাহায্য করেছিল। যার কারনে গ্রামবাসীরা ইরতাজুদ্দিনকে ঘৃণা চোখে দেখে। তা সত্ত্বেও শাহানা গ্রামবাসীদের মন জয় করে নেই।
গ্রামের এক ঢোল বাদক পরাণের স্ত্রী বাচ্চা প্রসব কালে মরমর অবস্থা, শাহানা বাস্তব অভিজ্ঞতা না থাকলে তার নিজ পড়াশোনার জ্ঞানে বাঁচিয়ে তোলে মা ও বাচ্চাকে । তাতেই গ্রামের সকলের মনে জায়গা করে নেয় শাহানা।
একদিন শাহানা ও নীতুর জন্য আয়োজন করা হয় গ্রাম্য গানের। গানের আসরে মতি মিয়ার গলায় সুরালো কন্ঠে গান শুনে জীবন নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করে শাহানা।
এদিকে মতি মিয়া ধীরে ধীরে শাহানার প্রতি আসক্ত হয়ে পড়ে । সে ভুলে যায় তার দীন দরিদ্রতা ও শাহানার বংশের মধ্যে পার্থক্যের কথা।
একদিন শাহানা তার দাদুর কাছ থেকে তিনটি জিনিষ চেয়ে বসে – “(১) ইরতাজুদ্দিন কে তাদের সাথে ঢাকায় থাকতে হবে, (২) এই কাঠের মস্ত বড় বাড়িটাকে হসপিটাল বানাতে হবে। (৩) গ্রামবাসীদের ক্ষমা চাইতে হবে তাঁর ১৯৭১ এর কর্মকান্ডের জন্য।”
১ম দুটি শর্ত মেনে নিলেও ৩য় শর্তটি তাৎক্ষণিক প্রত্যাখ্যান করে বসেন শাহানার দাদু।
গল্পের শেষাংশে, “পাঠকের চোখে অশ্রু আনতে বাধ্য করবে, এক করুণ ট্রাজেডি সাময়িকসময়ের জন্য হলেও পাঠকের মনকে তীব্র ভেগে আন্দোলিত করে তুলবে”।
এদিকে কুসুমের বিয়ে ঠিক করে তার পরিবারের থেকে “সুরুজ” নামে এক যুবকের সাথে। কিন্তু সে মন প্রাণে চাই কেবল মতিকে। তাই সে বিয়ের আগে সাহস করে নিজের অনুভূতি খুলে বলে মতিকে।
কিন্তু শাহানার প্রতি দুর্বলতা ও গান বাজনা নিয়ে উদাসীনতায় তা খেয়াল করতে পারে নি মতি মিয়া। তাই বিয়ের দিন নিজের জীবন শেষ করে দিবে এই সীদ্ধান্ত নিয়ে বিষ পান করে বসে কুসুম।
শাহানা, নীতু,শাহানার হবু বর, মিতু (শাহানার মেজ বোন) তারা তাদের দাদু কে নিয়ে গ্রামবাসীদের কাছে বিদায় নিয়ে শহরের উদ্দেশ্যে রওনা। গ্রামের মানুষেরা ইতরাজুদ্দিনকে ঘৃণা করলেও শহরে চলে যাওয়ার বেলায় গ্রামবাসীরা সবাই তাকে বিদায় দিতে এগিয়ে আসে।
তাহলে কি ইরতাজুদ্দিন নিজের নাতনি শাহানার কথা মেনে নিয়ে ছিলেন, চেয়েছিল ক্ষমা গ্রামবাসীদের কাছে..? তাই কি গ্রামবাসীরা এসেছে তার বিদায়বেলায় বিদায় জানাতে? এটা না বলাই থাকুক, পাঠক নিজে পড়ে বুঝে নিবেন আশা করি।
এদিকে শাহানাদের নৌকার পিছু পিছু বিষ পান করা কুমুমকে নিয়ে রওনা হয় “মতি ও সুরুজ মিয়া”। হঠাৎ এক ঘোরে মতিন নিজে নিজে বলে উঠে, “তুই যদি আমার হইতি, আমি হইতাম তোর”।
এই সংলাপ মতিন কি কুসুমকে উদ্দেশ্য করে বলে নাকি শাহানার আবেগে বলে উঠে..? এটা লেখক লুকায়িত করে রেখেছেন। শেষ পর্যন্ত কুসুম কি বেঁচে ফিরেছিলো..? মতি মিয়া কি কুসুমের আবেগ অনুভূতি পরিষ্কারভাবে বুঝেছিলো…? মতি ও সুরুজ কুসুম কে নিয়ে শাহানাদের কাছে পৌছাতে পেরেছিলো কি..?
এইসব ব্যাপারে হুমায়ূন আহমেদ বরাবরের মত সকল উপন্যাসের মতই একটা ধোঁয়াশা রেখেছেন গল্পের শেষ ভাগে। হইতো তিনি চেয়েছেন পাঠক এই উপন্যাসটি পড়ে নিজের অনুভূতি ও সৃজনশীলতার মিশ্রন দিয়ে উপন্যাসটিকে আরো সুন্দর ভাবে ফুটিয়ে তুলুক।
চমৎকার এক গল্প নিয়ে লেখা এই শ্রাবণ মেঘের দিন উপন্যাসটি। কালজয়ী উপন্যাসটি এখনো যারা পড়েননি তারা দেরি না করে আজকেই পড়ে ফেলুন । আমাদের জানাতে ভুলবেন না যেন কেমন লাগলো আপনার উপন্যাসটি।
আরও ব্লগ পড়তে #এখানে ক্লিক করুন।
Joy Barua
Intern
Content writing Department, YSSE