সমরেশ মজুমদার বাংলা ভাষার একজন অগ্রগণ্য ও জনপ্রিয় লেখক। তার লেখায় ফুটে উঠেছে শহরকেন্দ্রিক জীবনের আলেখ্য। একারণে তাকে “আরবান লেখক” হিসেবেও বর্ণনা করা হয়। তিনি বহু জনপ্রিয় উপন্যাসের স্রষ্টা।
সমরেশ মজুমদার জন্মেছিলেন ১৯৪২ সালের ১০ই মার্চ, পশ্চিমবঙ্গের গয়েরকাটায় । তার পিতা কৃষ্ণদাস মজুমদার ও মাতা শ্যামলী দেবী। সমরেশ মজুমদারের শৈশব কেটেছে ডুয়ার্সের গয়েরকাটা চা বাগানে। ডুয়ার্সের চা বাগানের গল্প তার বহু গল্প ও উপন্যাসে ফুটে উঠেছে।
সমরেশ মজুমদারের প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয় ভবানী মাস্টারের পাঠশালায়। সেখানে একবার ছোট্ট সমরেশের হয়ে পরীক্ষায় লিখে দিলেন এক বড় দিদি। ধরা পরার পর ভবানী মাস্টার শিশু সমরেশ কে উপদেশ দিলেন, ‘তোমার তো অনেক দূর যাওয়ার কথা। আর কাউকে অ্যালাও করবা না।’ আর সমরেশ মাস্টারমশাইয়ের এই নির্দেশটিই তাঁর সৃষ্টির ক্ষেত্রে জীবনভর অক্ষরে-অক্ষরে পালন করেছেন।
এরপর বিদ্যালয়ের পাঠ হয় জলপাইগুড়ি জেলা স্কুলে । জলপাইগুড়ি থেকে তিনি কলকাতায় আসেন ১৯৬০ সালে। তিনি স্নাতক সম্পন্ন করেন কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে বাংলা বিষয়ে। তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন।
সমরেশ মজুমদার কর্মজীবনে আনন্দবাজার পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড এর সাথে যুক্ত ছিলেন। তিনি গ্রুপ থিয়েটার পছন্দ করতেন। “অন্যমাত্রা”, তার প্রথম গল্প লেখাই হয়েছিলো মঞ্চনাটক হিসাবে। ১৯৬৭ সালে “অন্যমাত্রা” দেশ পত্রিকায় ছাপা হয়েছিলো। ১৯৭৫ সালে সমরেশ মজুমদারের প্রথম উপন্যাস দৌড় ছাপা হয় দেশ পত্রিকাতেই।
তিনি শুধু গল্প উপন্যাস লিখেননি। তিনি বহু ছোটগল্প, ভ্রমণকাহিনি থেকে গোয়েন্দাকাহিনি, কিশোর উপন্যাস লিখেছেন। সাতকাহন, তেরো পার্বণ, স্বপ্নের বাজার, উজান, গঙ্গা, ভিক্টোরিয়ার বাগান, আট কুঠুরি নয় দরজা, অনুরাগ ইত্যাদি তাঁর উল্লেখযোগ্য উপন্যাস। তিনি ট্রিলজি ‘উত্তরাধিকার, কালবেলা, কালপুরুষ’ এর জন্য বাংলা সাহিত্যে অমর হয়ে থাকবেন। নকশাল আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে রচিত “কালবেলা” র অনিমেষ ও মাধবীলতা চরিত্র দুটি বহু মানুষের ভালোবাসা কুড়িয়েছে।
তার লেখনীর জুড়ি মেলা ভার। তার রচনার ভঙ্গি ও গতি পাঠক কে আন্দোলিত করে। তার প্রতিটি উপন্যাসের বিষয় বস্তু আলাদা। চা বাগানের মদেশিয়া সমাজ থেকে শুরু করে কলকাতার নিম্নবিত্তরাও তার লেখায় ফুটে উঠেছে।
সমরেশ কখনো কোনো ভৌগোলিক সীমাকে কেন্দ্র করে লেখেন নি। তিনি মানুষ নিয়ে ভেবেছেন, মানুষ নিয়ে লিখেছেন। তিনি মানুষকে নির্মম ও নির্মোহ ভাবে সাহিত্যিকের অন্তর্দৃষ্টি দিয়ে দেখেছেন, লিখেছেন। আর কিছু ‘অ্যালাও’ করেননি। মানুষের ভাষার ব্যবহার তীর্যক দৃষ্টিতে পর্যবেক্ষণ করেছেন। তিনি রাজনীতি নিয়ে লিখেছেন। প্রবন্ধ, সমালোচনাও লিখেছেন। তাইতো হেমন্ত মুখোপাধ্যায় একবার বলেছিলেন “এখন ওঁর উচিত গান না গেয়ে সুর দিয়ে যাওয়া।”সমরেশ কবিদের ব্যাঙ্গ করে দুএকটি কবিতাও লিখেছেন,
“এই যে আমি তোমাকে দেখছি
দেখে মন ভরে যাচ্ছে
না দেখতে পেলে বুক টনটন করে
বেঁচে থাকাটা বিবর্ণ হয়ে যায়
এই অনুভূতিটা কী?
ভালোবাসা নয়?”
তিনি তার অসাধারণ লেখনীর স্বীকৃতিস্বরূপ বহু সম্মাননা ও পুরষ্কার পেয়েছেন। তিনি আনন্দ পুরস্কার -১৯৮২, বাংলা চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার, দিশারী ও চলচ্চিত্র প্রসার সমিতি – শ্রেষ্ঠ স্ক্রিপ্ট রাইটার – ১৯৮২, সাহিত্য একাডেমী পুরস্কার, ১৯৮৪, বঙ্কিম পুরস্কার – ২০০৯, বঙ্গবিভূষণ – ২০১৮ পুরষ্কার লাভ করেন।
লেখক শেষ জীবনে সিওপিডি ও স্লিপ অ্যাপনিয়ার (ঘুমের মধ্যে শ্বাসকষ্টের সমস্যা) সমস্যায় ভুগছিলেন। ২০২৩ সালের ২৫ই এপ্রিল মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ জনিত সমস্যার কারণে একটি বেসরকারি হাসপাতালে ভর্তি হন। এবং সেখানেই ৮ই মে তিনি প্রয়াত হন। মৃত্যুকালে তার বয়স হয়েছিলো ৭৯ বছর।
সমরেশ মজুমদারের প্রয়াণে বাংলা সাহিত্য হারালো তার এক প্রাণপুরুষকে। যা বাংলা সাহিত্যের জন্য অপূরনীয় এক ক্ষতি। বাংলা সাহিত্যের নক্ষত্রের পতন!
Nishat Jahan Haque
Intern, Content Writing Department
YSSE