যদি কাউকে প্রশ্ন করা হয় যে, পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ কোনটি ?
একদম এক শব্দে উত্তর আসবে “সুন্দরবন”
ঠিক তাই! পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বা লবণাক্ত পানির বন সুন্দরবন।
এটি মূলত বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে অবস্থিত। প্রতি বছর দেশি-বিদেশি পর্যটকরা এখানে আসেন ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থানটি দেখতে।
সুন্দরবন গঙ্গা নদীর মোহনায় অবস্থিত। বাংলাদেশের প্রায় ১০ লাখ হেক্টর এলাকা জুড়ে রয়েছে সুন্দরবন। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো এই স্থানকে বিশ্ব ঐতিহ্য ঘোষণা করে। এর প্রাকৃতিক পরিবেশ সবসময় প্রকৃতিপ্রেমী, বিজ্ঞানী, গবেষক ও পর্যটকদের আকর্ষণ করে। দেশ-বিদেশের ভ্রমণপিপাসুরা প্রতি বছর এখানে বেড়াতে যায়।
সুন্দরবনের প্রাণী বৈচিত্রের মূল আকর্ষণ রয়েল বেঙ্গল টাইগার। সুন্দরবনে গেলে রয়েল বেঙ্গল টাইগারের দেখা সবসময় না পাওয়া গেলেও এর অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, নীরবতা ও জীববৈচিত্র্য দর্শনার্থীদের মুগ্ধ করে। এ ছাড়া, দেখতে পাওয়া যায় হরিণ, বানর, বন্য শুকর, বন বেড়াল, ও প্রভৃতি।
প্রকৃতি ও বন্যজীবনের এক মেলবন্ধন
সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার, চিত্রল হরিণ, বন্যশুকর, বানর, কুমির, ডলফিন, কচ্ছপ, উদবিড়াল, মেছোবিড়াল ও বনবিড়ালসহ রয়েছে ৩৭৫ এর অধিক প্রজাতির বণ্যপ্রাণী। সেই সাথে সুন্দরবন জুড়ে জালের মতো থাকা প্রায় ৪৫০টি ছোট বড় নদী-খাল ভ্রমণের অপার সুযোগতো রয়েছেই ভ্রমণপিপাসুদের জন্য। সুন্দরবনের প্রধান বনজ বৈচিত্র্যের মধ্যে রয়েছে প্রচুর পরিমাণে সুন্দরী, গোলপাতা, গেওয়া, গামারি, ঝামটি গরান এবং কেওরাসহ সর্বমোট ২৪৫টি শ্রেণি এবং ৩৩৪টি প্রজাতির উদ্ভিদ রয়েছে।
বনের নাম “সুন্দরবন”কেন?
‘সুন্দরবন’ নামটির উৎপত্তি নিয়ে কিছু ভিন্নমত আছে। অনেকেই মনে করেন, এই নামটি এসেছে ‘সুন্দরী’ গাছের নাম থেকে, যা এখানে প্রচুর পরিমাণে পাওয়া যায়। আবার কেউ কেউ বিশ্বাস করেন, ‘সুন্দর’ এবং ‘বন’ শব্দ দুটি মিলিয়ে ‘সুন্দরবন’ নামকরণ করা হয়েছে। এ বনের নৈসর্গিক সৌন্দর্য এবং প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যই নামটির যথার্থতা প্রমাণ করে।
যেখানে ঘুরবেন: আশেপাশের কিছু দর্শনীয় স্থান
সুন্দরবন ভ্রমণের সময় আশেপাশের কিছু দর্শনীয় স্থানও দেখা যেতে পারে।
করমজল ও হাড়বাড়িয়া: এই দুটো জায়গা মোংলা থেকে সবচেয়ে কাছে। করমজল হরিণ ও কুমিরের প্রজনন কেন্দ্র। হাড়বাড়িয়ার মূল আকর্ষণ কাঠের ট্রেইল, পদ্মপুকুর ও ওয়াচ টাওয়ার। সুন্দরবনের পশুর নদীর তীরে অবস্থিত করমজল পর্যটন কেন্দ্র।
বন বিভাগের তত্ত্বাবধানে মংলা সমুদ্র বন্দর থেকে প্রায় আট কিলোমিটার দূরে ৩০০ হেক্টর জমির উপর পর্যটন কেন্দ্রটি গড়ে তোলা হয়েছে। প্রকৃতির শোভা বাড়াতে এখানে রয়েছে কুমির, হরিণ, বানরসহ নানা প্রজাতির পশুপাখি।
পর্যটকদের জন্য সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় হলো বিকেলে করমজল এলাকায় দল বেধে বন্য চিত্রল হরিণের আগমন এবং পর্যটকদের হাত থেকে খাবার গ্রহণ।
কটকা ও কটকা বীচ: কটকায় একটি কাঠের ট্রেইল রয়েছে, যেখান থেকে দেখা যায় হরিণের দল, নানা পশুপাখি আর কিছুদূর পরেই সমুদ্রসৈকত। দেখা মেলে লাল কাঁকড়ার। বঙ্গোপসাগরের কোলঘেষা এই কটকা সুন্দরবনের অন্যতম জনপ্রিয় জায়গা।
কটকা এবং কচিখালী সুন্দরবনের এই দুই স্থান বন্যপ্রাণী পর্যবেক্ষণের জন্য আদর্শ। এখানো প্রায় দেখা মেলে সুন্দরবনের অন্যতম প্রধান আকর্ষণ হয়ে থাকা রয়েল বেঙ্গল টাইগারের। তবে বনে বাঘের দেখা মেলা ভার। তবে বাঘ দেখা ও নিরাপদে থাকা-এ দুই-ই সম্ভব সুন্দরবনের চমৎকার পর্যটন কেন্দ্র কটকা অভয়ারণ্য থেকে।
দুবলার চর: এটি একটি ছোট দ্বীপ। হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের পূণ্যস্নান ও রাসমেলার জন্য এই জায়গাটি বিখ্যাত। প্রতি বছর কার্তিক মাসে তিন দিনব্যাপী এই মেলা অনুষ্ঠিত হয়। এখানে জেলেদের বসতি রয়েছে।
হিরণ পয়েন্ট: এটি সুন্দরবনের সংরক্ষিত অভয়ারণ্য। এখানে কাঠের তৈরি রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে অনেক ধরণের বন্য প্রাণীর দেখা পাওয়া যায়। ভাগ্য ভালো থাকলে রয়েল বেঙ্গল টাইগারেরও দেখা মিলতে পারে। বাঘ, হরিণ এবং নানা প্রজাতির পাখি দেখার সুযোগ পাওয়া যায়।
জামতলা, জামতলাবীচ: এখানে আকর্ষণীয় জায়গা হলো ওয়াচ টাওয়ার। এই টাওয়ার থেকেই বিস্তীর্ণ ছনক্ষেতে হাজার হাজার হরিণের ছোটাছুটি, এমনকি বাঘের দেখাও মিলতে পারে। জামতলা ঘাট থেকে পায়ে হাঁটা পথে প্রায় ৩ কিলোমিটার গেলে জামতলা সী বীচের অপরুপ দুশ্য উপভোগ করতে পারবেন।
মান্দারবাড়িয়া সৈকত: সুন্দরবনের দক্ষিণ-পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত সমুদ্র সৈকত। মান্দারবাড়িয়র কিছু অংশ এখনো আবিষ্কার করা সম্ভব হয়নি। অর্থাৎ এই অঞ্চলের কিছু অংশে মানুষ এখনো প্রবেশ করতে পারেনি। এখান থেকে সূর্যোদয় ও সূর্যাস্ত দেখা যায়।
চোখ জুড়ানো, শিহরন জাগানো অরণ্য সুন্দরবন। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সুন্দরবন। ম্যানগ্রোভ, গোলপাতার সুন্দরবন। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের প্রধান আকর্ষণ বাংলাদেশের সুন্দরবন। সুন্দরবন বাংলাদেশের গর্ব, বাংলাদেশের রক্ষাকবচও। ঝড়ঝঞ্ঝা নিজের শরীর দিয়ে আটকে দিয়ে পুরো দেশকে রক্ষা করে এই সুন্দরবনই।
প্রকৃতির ‘অনিন্দ্যসুন্দর সৌন্দর্য’ কথাটা অবলীলায় শুধু এই বনকে নিয়েই বলা যায়। নদী, খাল ও সমুদ্র আর রহস্যঘেরা বনভূমি এই সুন্দরবনকে আকর্ষণীয় করে তুলেছে। বনের মায়াবী রূপের ভূ-প্রাকৃতিক সৌন্দর্য মুগ্ধতা ছড়ায়, শিহরন জাগায় প্রকৃতিপ্রেমীদের মনে।
সুন্দরের রানি সুন্দরবন ক্ষণে ক্ষণে তার রূপ বদলায়। বলা হয়ে থাকে, সুন্দরবন দিনে চার বার তার রূপ বদলায়, যার সকালে এক রূপ, দুপুরে অন্যরূপ আর পড়ন্ত বিকালে নতুন রূপে উদ্ভাসিত হয়। আর রাতে গহিন অরণ্যের মধ্যে এক ভিন্ন শিহরন তৈরি করে সুন্দরবন। তাছাড়া অমাবস্যায় কিংবা চাঁদনি রাতে নানান রূপে পর্যটকদের কাছে ধরা দেয় সুন্দরবন।
এরকম আরো ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন
লেখক
মাফরুহা সুমাইয়া
ইন্টার্ন , কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE