স্কুলে টিফিন পিরিয়ডে ৭ম শ্রেণী পড়ুয়া আকাশ আজ শ্রেণি কক্ষের বাইরে না গিয়ে খুব গভীর মনে তার ছোট ভাই আতিক কে নিয়ে ভাবছে। আতিক, কোনো বিষয়েই মনোযোগ রাখতে পারে না। তার অতিরিক্ত চঞ্চলতার উৎপাতে অতিষ্ঠ হয়ে বাবা অনেক উত্তম মধ্যমও দিয়েছে, কোনো লাভ হয়নি। একবার এক ডাক্তার দেখে বলেছিলেন, তার ADHD আছে। কিন্তু বাবা বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয় নি। কিন্তু আজকে ক্লাসে স্যার যা জানালেন ADHD নিয়ে, সেভাবে চললে হয়তো আতিক অনেকাংশেই ভালো থাকতো। কেউ তাকে বাজে বলে আখ্যায়িত করতো না । আকাশ সিদ্ধান্ত নেয়, সে এবার সবার মাঝে ADHD নিয়ে সচেতনতা গড়ে তুলবে, উদ্বোগের শুরু হবে আকাশের নিজ ঘর থেকেই। এ সম্পর্কে আরো ভালোভাবে বোঝার জন্য আকাশ ADHD সম্পর্কিত একটি ব্লগ পড়া শুরু করলো যাতে লেখা…
ADHD কী?
ADHD (Attention Deficit Hyperactivity Disorder) শৈশবে মস্তিষ্কের বৃদ্ধি ও বিকাশের সাথে সম্পর্কিত সবচেয়ে সাধারণ ব্যাধিগুলোর একটি। এটি সাধারণত শৈশবে প্রথমে নির্ণয় করা হয় এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রাপ্তবয়স্ক হওয়ার পরও স্থায়ী হয়ে থাকে। ADHD এ আক্রান্ত শিশুর মনোযোগে সমস্যা, আবেগ প্রবণ আচরণ নিয়ন্ত্রণে সমস্যা (ফলাফল কী হবে তা চিন্তা না করেই কাজ করা) এবং অতি চঞ্চলতা লক্ষ্য করা যায়।
লক্ষণ ও উপসর্গ
ADHD সাধারণত মেয়েদের তুলনায় ছেলেদের বেশি হতে দেখা যায়। লিঙ্গ ভেদে লক্ষণেও কিছুটা তারতম্য থাকে। যেমন ADHD তে আক্রান্ত ছেলেরা যেখানে অতিরিক্ত চঞ্চল হতে পারে ,সেখানে মেয়েরা চুপচাপ ও অমনোযোগী হতে দেখা যায়।
ADHD তে আক্রান্ত শিশু,
- প্রায়ই কোনো বিষয়ে গভীর মনোযোগ দিতে ব্যর্থ হওয়া এবং স্কুলের কাজে কিংবা কর্মক্ষেত্রে নানা রকম অসতর্কতাজনিত ভুল হতে পারে।
- প্রায়ই খেলাধুলায় কিংবা যেকোন কাজে মনোযোগ ধরে রাখতে ব্যর্থ হওয়া ।
- নির্দেশনা অনুসরণে ব্যর্থতা এবং স্কুলে বা কর্মক্ষেত্রে নিজের দায়িত্ব পালনে যত্নশীল না হওয়া ।
- দীর্ঘ সময় ধরে মানসিক প্রচেষ্টার প্রয়োজন হয় এমন কাজগুলো করতে না চাওয়া বা এড়িয়ে যাওয়া যেমন, স্কুলের কাজ কিংবা বাড়ির কাজ।
- সহজে বিভ্রান্তিতে ভোগা ।
- কাজের জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জামগুলো প্রায়ই হারিয়ে ফেলা (যেমন, স্কুলের ব্যাগ, পেন্সিল,বই, মানিব্যাগ, চশমা, মোবাইল ফোন)।
- প্রায়ই দিবাস্বপ্নে ভোগা ।
- দৈনন্দিন কার্যকলাপ ভুলে যাওয়া ।
- প্রায়ই বসে থাকা অবস্থায় হাত বা পা দিয়ে কোনোকিছুতে টোকা দিতে থাকা বা প্রচুর অস্বস্তিতে ভোগা।
- কোনোকিছুর জন্য অপেক্ষা করতে না পারা ।
- প্রায়ই অতিরিক্ত কথা বলা।
- কোনো একটি প্রশ্ন শেষ হওয়ার আগেই তার একটি অস্পষ্ট উত্তর প্রদান করা ।
- কথা বলার সময় কিংবা খেলার সময় অন্যদের নানাভাবে বাধা দেয়া ।
ADHD তে আক্রান্ত শিশুর এই লক্ষণগুলো অনবরত চলতে থাকে, বড় হওয়ার সাথে সাথে এই লক্ষণগুলো গুরুতর হতে থাকে এবং স্কুলে, কর্মক্ষেত্রে সবার সাথে মিশে চলতে নানারকম অসুবিধা হওয়া ।
ADHD এর প্রকারভেদ
ADHD এর মূলত তিন ধরনের প্রকারভেদ রয়েছে,
- Predominantly inattentive: এই প্রকারের অন্তর্ভুক্তরা অধিকাংশ সময় কোনো কিছুতে মনোযোগ ধরে রাখতে পারে না।
- Predominantly hyperactive/impulsive: এই ধরনের অন্তর্ভুক্তরা বেশিরভাগ সময় অতি চঞ্চল স্বভাবের এবং কোনো কাজ করার আগে তার ভালো মন্দ বিচার করে না।
- Combined: উপরিউক্ত দুই প্রকারের মিশ্রণ এদের মধ্যে দেখা যায়।
ADHD হওয়ার কারণ
ADHD হওয়ার মূল কারণ সম্পর্কে এখনও জানা যায়নি, তবে এর কারণ জানতে এখনও গবেষণা চলছে। তবে কিছু ফ্যাক্টর রয়েছে যা ADHD কে ধীরে ধীরে বৃদ্ধি পেতে সহায়তা করে, এর মধ্যে বংশের জিনগত সমস্যা, পরিবেশগত সমস্যা এবং শিশুর মস্তিষ্ক বিকাশের সময় কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রজনিত সমস্যা বিদ্যমান।
ADHD হওয়ার জন্য কিছু বিপদজনক ফ্যাক্টর রয়েছে,
- মা-বাবা কিংবা ভাইবোনের কারো ADHD কিংবা অন্য কোনো মানসিক সমস্যা থাকলে
- পরিবেশ হতে বিষাক্ত কোনো পদার্থের সংস্পর্শে আসলে ,যেমন লেড যা সাধারণত পেইন্ট কিংবা পুরোনো ভবনের পাইপে পাওয়া যায়
- গর্ভাবস্থায় মাদক সেবন, ধূমপান কিংবা অন্য কোনো ড্রাগ ব্যবহার করলে
- বাচ্চা সময়ের পূর্বেই জন্ম নেয়া
অনেকে বেশি চিনি খাওয়াকে হাইপারঅ্যাক্টিভ হওয়ার কারণ বলে ধরে থাকেন, যদিও এর কোনো ভিত্তি নেই, কোনো গবেষণাতেই এমন তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে শৈশবে শিশুর অনেক অভিজ্ঞতাই তাদের মনোযোগ কমিয়ে আনে, এক্ষেত্রে শিশুর ADHD আছে বলে ধরে নেয়া যাবে না।
জটিলতা
ADHD একটি বাচ্চার জীবনকে জটিল করে তুলতে পারে, যেমন,
- প্রায়ই শিশু শ্রেণিকক্ষে কোনো কিছু বুঝতে পারে না, যার কারণে পরীক্ষায় ফেল করে এবং অন্যান্য শিক্ষার্থী ও বড়দের দ্বারা সমালোচনার শিকার হয়।
- স্বাভাবিক বাচ্চাদের চেয়ে বেশি দূর্ঘটনার শিকার হয়
- নিজেদের প্রতি আত্মবিশ্বাস কম থাকে
- বন্ধুমহল এবং বড়দের সাথে যোগাযোগে বাধাগ্রস্ত হয়।
- মাদক সেবন কিংবা ড্রাগ নেয়া বা অন্য যেকোন ঝুঁকিপূর্ণ কাজে জড়িত থাকতে পারে।
অন্যান্য যে সকল রোগের ঝুঁকি থাকে
ADHD কখনো অন্যান্য মানসিক রোগের সৃষ্টি করে না, তবে অন্যান্য স্বাভাবিক বাচ্চাদের চেয়ে ADHD তে আক্রান্ত বাচ্চারা যে সকল মানসিক রোগের ঝুঁকি বহন করে তা হলো,
- Oppositional defiant disorder (ODD), ব্যক্তির আচরণ নেতিবাচক, উদ্ধত এবং সমস্যাগ্রস্থ হতে পারে।
- Conduct disorder, একে Anti-social disorder ও বলা হয়, ব্যক্তি সাধারণত চুরি, মারামারি, সম্পত্তি বিনষ্ট এবং মানুষ ও প্রাণীর ক্ষতি করতে পারে।
- Disruptive mood dysregulation disorder, সর্বদা বিরক্তি ও হতাশা প্রকাশ করা।
- Learning disabilities, পড়া, লেখা, কোনকিছু বুঝতে পারা ও যোগাযোগের দক্ষতা জনিত সমস্যা।
- Substance use disorders, মাদক সেবন, ড্রাগ গ্রহণ ও ধূমপান করা।
- Anxiety disorders,উদ্বেগ ও নার্ভাসনেস ।
- Mood disorders, এক্ষেত্রে Depression, Bipolar disorder এবং Manic Behavior দেখা যায়।
- Autism spectrum disorder, মস্তিষ্কের বিকাশজনিত একটি সমস্যা যা একজন ব্যক্তি কীভাবে চারপাশকে উপলব্ধি এবং সমাজে অন্যদের সাথে ভারসাম্য বজায় রাখে তা বুঝতে না পারা।
- Tic disorder or Tourette syndrome, এমন একটা অবস্থা যেখানে ব্যক্তি নিজের নিয়ন্ত্রণ ছাড়াই নড়াচড়া করে কিংবা মুখ দিয়ে আওয়াজ করতে থাকে।
ADHD প্রতিকার
ADHD ব্যাধি দ্বারা শিশু যাতে আক্রান্ত না হয় সে জন্য যে বিষয়গুলো খেয়াল রাখতে হবে,
- গর্ভাবস্থায় ফিটাসের বিকাশে সমস্যা করতে পারে এমন কিছু সেবন না করা, যেমন, মাদক সেবন, ধূমপান কিংবা ড্রাগ।
- দূষিত এবং বিষাক্ত পদার্থ থেকে শিশুকে নিরাপদ রাখা, যেমন, সিগারেটের ধোঁয়া বা লেড পেইন্ট।
- পাঁচ বছর পর্যন্ত বাচ্চাদের স্ক্রিনিং টাইম কম রাখতে হবে, অর্থাৎ, টেলিভিশন দেখা কিংবা ভিডিও গেমস খেলা সীমিত রাখতে হবে।
একজন শিশুর কীভাবে ADHD হয়ে থাকে তার কারণ অজানা, কিন্তু ADHD তে আক্রান্ত শিশুকে কীভাবে সুস্থ রাখা যায় তা আমাদের সবার জানা প্রয়োজন। সাধারণ শিশুদের তুলনায় ADHD তে আক্রান্ত শিশুরা একটু ভিন্ন হয়, সে যেন তার আশেপাশের পরিবেশের সাথে সঠিকভাবে খাপ খাইয়ে নিতে পারে সে দিকে আমাদের বিশেষ নজর রাখা উচিত এবং একই সাথে ADHD মোকাবেলায় তাদের সাহায্য করা উচিত। এই দিক থেকে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে থাকতে হবে মা-বাবার, আর তাই এর পরবর্তী পর্বে কীভাবে মা-বাবা তার বাচ্চার সঠিকভাবে প্যারেন্টিং করতে পারে তা নিয়েই আলোচনা করা হবে।
এই ব্লগের মাধ্যমে ADHD সম্পর্কে জানার পর হয়তো আশে পাশে এ রোগে আক্রান্ত শিশুকে আর কেউ ভুল বুঝবে না, এ সম্পর্কে আপনি কী ভাবেন?
আরও ব্লগ পড়তে এখানে #ক্লিক করুন।
Writer,
Diderul Islam
Intern, Content Writing Department
YSSE