স্বপ্নটা যখন অন্যকে নিয়ে, তখন স্বপ্নের ব্যাখ্যাই বদলে যায়, স্বপ্নগুলো তখন লক্ষ্য হয়ে দাঁড়ায়। এমনই সব স্বপ্ন দেখেন নতুন প্রজন্মের এক মুখ জিয়াউল হক ভূঁইয়া, চিফ অব স্টাফ, শপআপ (ShopUp)।
ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজি (আইইউটি) থেকে ইলেকট্রিক্যাল অ্যান্ড ইলেকট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে গ্র্যাজুয়েশন শেষে তিনি হুয়াই (Huawei)-তে সিস্টেম ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে যোগ দেন। ছিল না কোনো প্রস্তুতি, তবুও আগাম ভবিষ্যৎ যেন পথ করে দিয়েছিল এগিয়ে যাওয়ার।
জিয়াউল হক ভূঁইয়ার ভাষ্যে, ‘টেলিকমিউনিকেশন নিয়ে আমার তেমন কোনো কোর্স করা ছিল না। আমি চেষ্টা করেছি, অনুশীলন করেছি আর অভিজ্ঞদের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়েছি। অবশেষে আমার ইন্টারভিউ খুব ভালো হয়।’
প্রতিষ্ঠানটিতে এক বছর কাজ করার পর তিনি গ্রামীণফোনে ম্যানেজমেন্ট ট্রেইনি হিসেবে ‘নেক্সট বিজনেস লিডার’ প্রোগ্রামে যুক্ত হন। ইঞ্জিনিয়ার হয়েও আইটি সেক্টর থেকে বিজনেস সেক্টরে চলে যান তিনি।
সে অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি বলেন, ‘এটা অনেক বড় ধরনের একটা পরিবর্তন ছিল আমার জন্য। এখন তো বহু ইঞ্জিনিয়ার বিজনেস সেক্টরে যায়। কিন্তু এক সময় সাধারণত ইঞ্জিনিয়াররা বিজনেস সেক্টরে কাজ করতে চাইতেন না। গ্রামীনফোনে আমি পরে প্রোডাক্ট ম্যানেজার হিসেবে কাজ করেছি।
এছাড়া বাংলাদেশ, পাকিস্তান আর মিয়ানমারের হয়ে টেলিনর (Telenor) পোর্টফোলিওর বড় একটা প্রজেক্টেরও প্রোডাক্ট ম্যানেজার ছিলাম। দুই থেকে তিন বছর পরে আমি ইনোভেশন টিমে জয়েন করি। সেখানেও আমি বেশ কিছু নতুন প্রোডাক্ট বাজারে আনা নিয়ে কাজ করি। ঠিক সে সময়ই আমি শপআপ থেকে একটা কল পাই।’
তিনি আরো বলেন, ‘আফিফ জামান, শপআপের সিইও (CEO of ShopUp) আমার সঙ্গে প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে আলোচনা করেন, তাঁর পরিকল্পনাগুলো শেয়ার করেন। শুরুর দিকে শপআপ এত বড় প্রতিষ্ঠান ছিল না। শুরুটা হয়েছিল মাত্র ৩ থেকে ৪টা রুমের অফিস নিয়ে। আমরা আলোচনা করি কীভাবে এটাকে আরো এগিয়ে নেওয়া যায়, মানুষের উপকারে কাজে লাগানো যায়। আমি তখন চিফ অব স্টাফ হিসেবে শপআপ জয়েন করি। সেসময় গ্রামীণফোন থেকে শপআপে এসে জয়েন করার সিদ্ধান্ত নেওয়াটা খুব কঠিন ছিল। আর শপআপ তখন তত বড় কিছুও ছিল না। কিন্তু এখানে কাজ করার মাধ্যমে সমাজে ভালো পরিবর্তন আনা আর ডিজিটালাইজেশন সম্ভব- দেখেই আমার জন্য সিদ্ধান্ত নেওয়াটা সহজ হয়েছিল। শপআপের মাধ্যমে আমার স্বপ্নের বাস্তবায়ন করাটা সম্ভব ভেবেই যাত্রাটা শুরু করা।’
জিয়াউল হক রেডএক্স (REDx)-এর সঙ্গেও যুক্ত ছিলেন। করোনাকালীন অন্যান্য লজিস্টিক সার্ভিস প্রোভাইডারগুলো চালু না থাকলেও রেডএক্স সবসময় মানুষের পাশে ছিল।
শপআপের আরেকটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান মোকাম (Mokam) নিয়ে জানতে চাইলে জিয়াউল হক বলেন, ‘সে সময় আফিফ ভাই আমাকে মোকাম নিয়ে কাজ করতে বলেন। মোকাম অ্যাপটি তখন শুধু হাতে গোনা কিছু খুচরা ব্যবসায়ীদের নিয়ে কাজ করতো, কিন্তু এখন এটি প্রায় পুরো দেশেই সার্ভিস দেয়। এটি দেশের বৃহত্তম বিটুবি (B2B) কমার্স। আমরা মুদির দোকানিদেরকে প্রয়োজনীয় সামগ্রী সাপ্লাই দিয়ে থাকি। আমরা চেষ্টা করেছি তাদের জীবনটাকে একটু হলেও সহজ করার। আমি বলবো আমাদের পথচলা কেবল শুরু, আরো অনেকদূর যাওয়া বাকি।’
এতো কিছু করার পেছনের অনুপ্রেরণা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘২০১৩-১৪ সালে আমি জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল (JCI – Junior Chamber International) যোগদান করি। সেখানে মেন্টরিং সেশন, বিভিন্ন ধরনের প্রজেক্টস, ইন্টারন্যাশনাল ইভেন্টস সম্পর্কিত সব কাজ আমাকে নতুন করে ভাবতে শেখায়। যেখান থেকেই সমাজের উন্নতি, মানুষের কর্মসংস্থান এগুলো নিয়ে ভাবতে শুরু করা। শপআপ আর মোকামের মাধ্যমে বহু মানুষের কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হয়েছে। তাই বলবো, জেসিআইয়ের কাজগুলো থেকেই আসলে স্বপ্নের শুরু কিংবা আমার কাজের পিছনের অনুপ্রেরণা বলা যায়।’
বাংলাদেশের খুচরা দোকানিদের কাজে একটা যুগান্তকারী পরিবর্তন এনে দিয়েছে শপআপ। আগে যেখানে বহুসংখ্যক সেলস রিপ্রেসেন্টেটিভ সামলাতে হিমশিম খেতে হতো মুদি দোকানদের, প্রোডাক্ট আনতে যেতে হতো অনেক দূরে দোকান বন্ধ রেখে। সেখানে এখন মোকামের মাধ্যমে দোকানে বসেই পাচ্ছেন সবকিছু, খরচও কমেছে আগের চেয়ে অনেক।
তবে জিয়াউল হকের পথচলা এতটা মসৃণ ছিল না। সমাজে প্রচলিত ধারার বাইরে গিয়ে কিছু করতে যেয়ে শুরুর দিকে অনেক বাধার সম্মুখীন হলেও পরবর্তীতে পেয়েছেন পরিবারের সম্পূর্ণ সমর্থন। বন্ধু-বান্ধব পরিচিত জনের কাছে কথা শুনতে হয়েছে, গ্রামীনফোন ছেড়ে ছোট একটা প্রতিষ্ঠানে জড়িয়ে যাওয়ার জন্য। কিন্তু তার এত কষ্টের পেছনের ফল ছিল সন্তোষজনক।
সমাজে অবদান সম্পর্কে জানতে চাইলে এই উদীয়মান তরুণ বলেন, ‘সমাজের পরিবর্তন আসার সঙ্গে সঙ্গে মানুষের জীবন বদলে গেছে, সবকিছু আরো অনেক বেশি উন্নত হয়েছে। কিন্তু মুদি দোকানগুলো সেই একইরকম থেকে গেছে। সময় যেন তাদের কাছে গিয়ে থমকে গেছে। আদমশুমারি অনুযায়ী আমাদের দেশের প্রায় ৪৫ লাখের মতো খুচরা ব্যবসায়ী আছেন এবং আমরা চেয়েছিলাম তাদের সবার ক্ষমতায়ন করার; অর্থনীতির পেছনে তাদের অবদানটাকে তুলে ধরার, তাদের মুখে হাসি ফোটানোর।’
অন্য অনেক কোম্পানির মত শপআপের জন্য বিনিয়োগ পাওয়া এত সহজ ছিল না। এ প্রসঙ্গে জিয়াউল হক বলেন, ‘আমরা সিরিজ A-তে ১৯০ কোটি টাকা আর সিরিজ B-তে প্রায় ১৬০০ কোটি টাকার তহবিল সংগ্রহ করেছি; যেটা আমার মনে হয় দেশের মধ্যে সর্বোচ্চ। আমাদের বিনিয়োগকারীদের মধ্যে অন্যতম হলো ভালার (Valar) আর সেকোইয়া (Sequoia)। নামকরা বিনিয়োগকারীরা যখন বিনিয়োগ করে, তখন আসলে এটা এক ধরনের প্রমাণ হিসেবে কাজ করে যে তারা শপআপে বিশ্বাস রাখে। বর্তমানে শপআপ একটি অতিপরিচিত নাম, যা সমাজে যথেষ্ট অবদান রাখছে।’
সাফল্যের পেছনে অবদানের কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘আমি জানিনা আমি সফল কিনা, তবে এতটা পথ আসার জন্য আমার মেন্টরস, কলিগস, সিনিয়র, ফ্যামিলি এবং সৃষ্টিকর্তা সবার কাছেই আমি কৃতজ্ঞ।’
তাঁর মতে সবসময় নতুন কিছু শেখার আগ্রহই তাঁকে অন্য সবার থেকে আলাদা করে। তিনি বলেন, ‘আমি সবসময় নতুন কিছু শিখতে চাই। প্রত্যেকটা মানুষের মাঝেই আমার মনে হয় কিছু না কিছু ভালো জিনিস থাকেই। আমি সবসময় চেষ্টা করি সেই অল্প হলেও ভালো জিনিসটা শেখার। আর আমি নানা ধরনের ভাষা শিখি। এগুলোর মাধ্যমে আমি বিভিন্ন জাতির চিন্তাধারা সম্পর্কে জানতে পারি। তাছাড়া আমি কোন কাজ শুরু করলে সর্বোচ্চ চেষ্টা করি সেটা সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করার। এগুলোই আমাকে সবার থেকে আলাদা করে বলে আমার ধারণা।’
জিয়াউল হক মনে করেন, উন্নয়নশীল দেশ হিসেবে আমাদের এখনো অনেকটা পথ যাওয়া বাকি। তাই দেশের অর্থনীতিতে অবদান রাখবে ও দেশের বঞ্চিত মানুষগুলোর জীবনে উন্নয়ন আনা যায়- এমন আরো কাজ করার ইচ্ছা রয়েছে তাঁর।
তরুণ প্রজন্মের প্রতি তার পরামর্শ, ‘ডিজিটালাইজেশনের পর থেকে এখন সুযোগ সুবিধা অনেক বেশি। সীমাবদ্ধতাগুলোও কমে এসেছে। সুযোগ যেমন বেশি, নতুন প্রজন্মও তেমনি অনেক দক্ষ। এখন ব্যাপারটা এমন যে, ইচ্ছা থাকলেই উপায় হয়। কিন্তু তার জন্য কষ্ট করতে হবে। ভাগ্য পরিবর্তনের জন্য চেষ্টা করতে হবে। খুব একটা সহজ হয়তো না, তবে অসম্ভবও না। নিজের সবটুকু দিয়ে নিজের আর দেশের মানুষগুলোর ভাগ্য পরিবর্তনের চেষ্টা করতে হবে।’
আজকের সমাজ অনেক এগিয়ে গেছে। জিয়াউল হক ভূঁইয়া ভাবেন তাদের কথা যারা এই সমাজ থেকে আজও পিছিয়ে রয়েছে। এই অমায়িক আর শিষ্ট ব্যক্তিগুণসম্পন্ন মানুষটি অনেকের কাছেই এক বিশাল অনুপ্রেরণা। তাঁর মতো উদ্যমী, দেশপ্রেমিক ও মানবিক মানুষরাই দ্রুত বৈষম্য ভেদ করে দেশকে উন্নতির শিখরে নিয়ে যেতে পারবেন।
To Read More blog, Click Below
Writer,
Nowrose Sharmin Mou
Intern,
Content Writing Department
YSSE