“গ্রাফিতি” শব্দটি আমরা কমবেশি সকলেই শুনেছি। সারা বিশ্বে গ্রাফিতি মূলত প্রতিবাদের নিরব ভাষা হিসেবে পরিচিত। বাংলাদেশেও সাম্প্রতিক কালে এটি বেশ আলোচিত। জ্ঞান বিজ্ঞানের যুগে সমাজে কোন অনিয়ম, অন্যায়, অত্যাচার, দুর্নীতি হতে দেখলে এখন আর আগের মতো মিছিল মিটিং করে প্রতিবাদে সোচ্চার হতে দেখা যায় না বরং প্রতিবাদ হয় দেয়ালে দেয়ালে, নিরবে অনেকটা শৈল্পিক কায়দায়।
ছোটবেলায় শহরের বিভিন্ন অলিতে-গলিতে, বড় রাস্তার পাশে প্রচুর ব্যঙ্গ রসাত্মক ছবি কার্টুন, আঁকাআকি দেখে দেখে বড় হয়েছি। কিন্তু আদৌও কি বুঝতাম এর পেছনের কাহিনী, গূঢ় রহস্য আর অন্তঃনির্হিত মর্মার্থ।
চলুন, তবে জেনে নেওয়া যাক গ্রাফিতির আদ্যোপান্ত।
গ্রাফিতি কি, কিভাবে এলোঃ
গ্রাফিতি, ইটালিয়ান Graffiato শব্দ থেকে যার উৎপত্তি । এর অর্থ খচিত। সাধারণ, শিলালিপি, চিত্র অঙ্কণ বা এ ধরণের শিল্পকেই বুঝায়। খুব সাধারণভাবে বলতে গেলে, দেয়ালে লিখা লিখি,চিত্র অঙ্কণের মাধ্যমে সামাজিক অরাজকতা, অসামঞ্জস্যতা, রূপকার্থে জনসাধারণের সামনে ফুটিয়ে তুলাকে গ্রাফিতি বলে।
বহু প্রাচীন কাল থেকে সমাজে গ্রাফিতি নামের কাউন্টার কালচারের অস্তিত্ব ছিল। এর বর্ণময় ইতিহাস বিশ্লেষণ করে জানা যায়, প্রাচীন রোম ও পম্পেই নগরীর সমাধি স্থল গ্রাফিতির অস্তিত্ব জানান দেয়। এছাড়াও, প্রাচীন সিরিয়া,পূর্ব জর্ডান, উত্তর সৌদি আরবের শিলা ও পাথরের উপরে কিছু কিছু লিখা পাওয়া গিয়েছে যা স্যাফাইটিক ভাষা হিসাবে পরিচিত। মূলত এই স্যাফাইটিক ভাষার উৎপত্তি গ্রাফিতি থেকে।
তাছাড়া, প্রাচীন গ্রীক, রোমান,মিশরীয় সংস্কৃতিতে গ্রাফিতি অঙ্কণের প্রচলন ছিল বলে জানা যায়।
অধুনিক গ্রাফিতি
বর্তমান কালে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্য অনেক স্থানেই প্রতিবাদের অংশ হিসাবে গ্রাফিতি শৈল্পীক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। অধুনিক গ্রাফিতির কথা মাথায় আসলেই মনে পড়ে Banksy’র নাম । যিনি ব্রেক্সিট ইস্যুতে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের সমালোচনা করে গ্রাফিতি অঙ্কণ করে ব্যাপক আলোচনায় আসেন। আত্মপরিচয় গোপন রেখে তার প্রতিবাদের ধরন ছিল অন্য সবার থেকে আলাদা। সমাজিক অরাজকতা, কলুষিত রাজনীতি, মধ্যপ্রাচ্যে ইসরায়েলি দখলদারিত্ব, মানুষের স্বাধীনতা ইত্যাদি নিয়ে বিখ্যাত কিছু গ্রাফিতি আঁকেন তিনি ।
বাংলাদেশে গ্রাফিতি কালচার
বাংলাদেশে গ্রাফিতি সংস্কৃতি শুরু হয়েছিল অনেক আগে থেকেই। ৭১’এ মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তানি শাসক গোষ্ঠীর নিষ্ঠুর নির্যাতন, শোষণ বঞ্চনার চিত্র তখন স্থান পেয়েছিল শহরের দেয়ালে দেয়ালে। তখনকার সময় গ্রাফিতিতে উঠে আসে রাজনৈতিক স্লোগান, ঝাঁঝালো উক্তি, শাসকগোষ্ঠীর হিংস্ররূপ যা মানুষকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উদ্বেলিত করেছিল। বর্তমানের গ্রাফিতি অনেকটা ‘হিপহপ’ ধাঁচের। আমরা অনেকে ‘হিপহপ’ গানের সাথে পরিচিত। সমাজের বিপরীত চিত্র, অন্ধকার জগত, দ্বন্দ্ব-সংঘাত, অনিয়ম ও দুর্নীতি যে গানের তালে তালে পরিবেশিত হয়। এই একই ধারার সাথে মিল রেখে গ্রাফিতির প্রচলন।
জানা যায়, ২০১৭ সালে ” সুবোধ ” শিরোনামে ঢাকার রাস্তার অলিগলিতে স্থান পায় অদ্ভুত সব পেইন্টিং। কে বা কারা এসব প্রতীকি চিত্রকর্মের মাধ্যমে সমাজের বাস্তব চিত্র মানুষের নজরে আনেন তা আজও আজানা। অদ্ভুত
তাছাড়া, সমসাময়িক অনেক বিষয় যেমনঃ বিচারহীনতা, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি, ধর্ষণ বন্ধের প্রতিবাদ , মধ্যপ্রাচ্যে ফিলিস্তিনির উপর ইসরায়েলি নির্যাতন, চীনে উইঘুর মুসলিম নির্যাতন, আবরার ও ফারদিন হত্যার মতো বিষয়গুলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দেখা যায়।
গ্রাফিতি কি বিতর্কিত?
আপাতদৃষ্টিতে গ্রাফিতি নিয়ে বেশ বিতর্ক রয়েছে। কেননা একটা সময় গ্রাফিতি ছিল সন্ত্রাসীগোষ্ঠী ও মাদক চোরাকারবারিদের প্রচার প্রচারণার ও আধিপত্য বিস্তারের মাধ্যমে। অনেক দেশেই গ্রাফিতি অঙ্কণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে। অনুমতি ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের গ্রাফিতি অঙ্কণ নিষিদ্ধ। যুক্তরাষ্ট্রের বাল্টিমোরে “গ্রাফিতি ওয়্যার হাউস”নামে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান রয়েছে। যারা বিভিন্ন স্ট্রিট আর্টিস্টদের নিয়ে কাজ করে থাকে। এরা শহরের বিভিন্ন অলি গলির দেয়াল রাস্তা, লেম্পপোস্ট,মেইলবক্স,ডাস্টবিন, বিদ্যুৎ এর থাম, রেলগাড়ী, আন্ডারপাস, বাড়ির ছাঁদ, গাড়ি কোন কিছু বাদ দেন না। সর্বত্রই যেন নান্দনিক গ্রাফিতি ও রং তুলির ছড়াছড়ি।
বিশ্বকাপে গ্রাফিতির ছোঁয়া
বর্তমান সময়ে ব্যাপক জনপ্রিয়তা পাওয়া কাতার বিশ্বকাপে বিভিন্ন দলের সমর্থনে সারা বিশ্বে আঁকাআকি হয়েছে প্রচুর। বাংলাদেশও তার ব্যাতিক্রম নয়। বাংলাদেশের বিভিন্ন বড় বড় শহরে একটুখানি চোখবুলালেই দেখা মিলবে প্রিয় দলের খেলোয়াড়, জার্সি, পতাকা দিয়ে অসংখ্য ওয়াল পেইন্টিং। চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিল – আর্জেন্টিনা ফ্যানদের মধ্যকার দ্বন্দ্ব গ্রাফিতি হিসেবে শোভা পাচ্ছে বিভিন্ন স্থানে। তাছাড়াও সামাজিক সচেতনতা, বিভিন্ন কোম্পানির প্রচার প্রচারণা নিয়ে ওয়াল পেইন্টিং হরহামেশাই দেখা মেলে।
পরিশেষে, গ্রাফিতি নিরব ও শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদে জনমানুষের চাপা আর্ত্ননাদ ও আবেগের বহিঃপ্রকাশ মাত্র। রং তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলা গ্রাফিতির মনকারা সৌন্দর্য্য মানুষের মনোজগতে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করে।
Writer:–
Baitul Hikma,
Intern, Content Writing Department. YSSE.