বাংলা সাহিত্যের এক উজ্জ্বল নক্ষত্র হেলাল হাফিজ। তিনি শুধু একজন কবি নন, তিনি বিদ্রোহ, প্রেম, এবং মানবতার এক গভীর অনুভূতির প্রতীক। তার কবিতাগুলি আমাদের মন ও মস্তিষ্কে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে। প্রেম ও বিদ্রোহের অসামান্য মিশ্রণে তার কবিতা বাংলা সাহিত্যে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করে।
হেলাল হাফিজ ১৯৪৮ সালের ৭ই অক্টোবর নেত্রকোনা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। তার শৈশব কেটেছে নেত্রকোনার গ্রামীণ পরিবেশে, এরপর ১৯৬৫ সালে নেত্রকোনার দত্ত হাইস্কুল থেকে এসএসসি, ১৯৬৭ সালে নেত্রকোনা কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন তিনি। সেই বছরই তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলা বিভাগে ভর্তি হন। এখান থেকেই তার শুরু হয় গ্রামীণ আবহের চোখ দিয়ে শহুরে জীবনের পর্যবেক্ষণ আর এই প্রভাব তার অনেক কবিতার মাঝেই আমরা খেয়াল করতে পারি।
আমরা যদি হেলাল হাফিজকে বুঝতে চাই তবে তার জীবনবোধকে আগে বোঝার চেষ্টা করতে হবে, তার জীবনের তিনটি ঘটনা, তার কবিমন, চিন্তাশক্তি, সৃষ্টিশীলতা সবকিছু পুরোপুরি পরিবর্তন করে দিয়েছে। তার কবিতায় এনেদিয়েছে বিদ্রহের আগুণ আর প্রিয়তমাকে না পাওয়ার হাহাকার।
প্রথম ঘটনা ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের। তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকবাল হলে, বর্তমানে শহীদ সার্জেন্ট জহুরুল হক হলে তিনি থাকতেন । ওইদিন নিউ মার্কেটের থেকে আড্ডা শেষে হলে ফিরে দেখলেন ক্যান্টিন বন্ধ। খেতে গেলেন একটা রেস্টুরেন্টে। খাওয়া শেষে তার মনে হল, ফজলুল হক হলে বন্ধু হাবিবুল্লাহ থাকে, সেখানে গিয়ে বন্ধুর সাথে আড্ডা দেওয়া যায়। কিছুক্ষণ পর, রাত তখন পৌনে দশটা হবে, হঠাৎ গোলাগুলির বিকট শব্দ। নীলক্ষেত, নিউমার্কেটের দিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলছে।
২৭ মার্চ সকালে ইকবাল হলে গিয়ে দেখলেন , মাঠের মাঝখানে, এখানে ওখানে শুধু লাশ আর লাশ। নিজের কক্ষে গিয়ে স্যুটকেস গুছিয়ে দ্রুত বেরিয়ে পড়লেন । সেই বধ্যভূমি থেকে বড় ভাইয়ের বাসায় গিয়ে উঠলেন । এই ঘটনা তার হৃদয়ে ব্যাপকভাবে ছাপ ফেললো।
তিনি বলেছিলেন, ” ওই রাতে যদি আমি ফজলুল হক হলে না গিয়ে নিজের হলে ফিরতাম, তাহলে তো বাঁচতাম না। একটা বোনাস জীবন পেয়েছি—এই উপলব্ধি আমার ভেতরে বিরাট বৈরাগ্য এনে দিলো। এক ধরনের সন্ন্যাস জীবন যাপন শুরু করলাম আমি।”
পরের ঘটনা, ১৯৭৩ সালের জুনের। ১৯ জুন তার পিতা মারা গেলেন। তিন বছর বয়সে মা মারা যাওয়ার পর তার জীবনে তার পিতাই ছিল তার সবকিছু। সেই পিতার মৃত্যু তাকে প্রবলভাবে ধাক্কা দিলো। তার মনে হলো, জগৎসংসার তুচ্ছ। সব অর্থহীন। তার বৈরাগ্য আরও প্রগাঢ় হলো।
তৃতীয় ঘটনা সম্পর্কে কবি বলেন—আব্বার মৃত্যুর মাসখানেক পরই ঘটনা ঘটালো হেলেন। হেলেন আমার প্রেমিকা। হেলেন হঠাৎ আমাকে ডেকে বললো, ‘কবি তোমার সঙ্গে আমার জরুরি কথা আছে।’ আমরা গিয়ে বসলাম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লাইব্রেরির সামনে। হেলেন বললো, আমি বিয়ে করতে যাচ্ছি। বাবা মা আমার বিয়ে ঠিক করেছেন। ছোটবেলা থেকে আমি খুব সহনশীল ছিলাম। প্রচণ্ড সহ্যশক্তি আমার। তাই ভেতরের ঝড় বুঝতে দিলাম না হেলেনকে। ওখান থেকে উঠে রিকশা নিয়ে সোজা হলে চলে গেলাম। ওটাই হেলেনের সঙ্গে আমার শেষ দেখা ও শেষ কথা।
এই তিনটি ঘটনা তাকে চিরস্থায়ীভাবে সংসারবিমুখ করে ফেললো। বাংলা সাহিত্যে খুব কম কবি একটা কাব্যগ্রন্থ রচনা করেই খ্যাতির তুঙ্গে স্থায়ী আসন গেড়েছেন, তাদের মাঝে হেলাল হাফিজ অন্যতম একজন। এবং এটি শুধু বাংলা সাহিত্যে না বিশ্বসাহিত্যেও এটি খুবই বিরল। ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ কাব্যগ্রন্থটি প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৮৬ সালে। কিন্তু কাব্যগ্রন্থ প্রকাশের সতেরো বছর আগেই হেলাল হাফিজের ‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’ কবিতাটি বাঙালি পাঠকদের মনে আগুনের দাবানল ছড়িয়ে দিয়েছিল। পাড়ায়, মহল্লায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের আবৃত্তি মঞ্চে, বেতারে আবৃত্তি চলেছে হেলাল হাফিজের কবিতা- নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়-
এখন যৌবন যার মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়
এখন যৌবন যার যুদ্ধে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ১৯৬৯ সালের মহান গণঅভ্যুত্থানের পটভূমিতে লেখা কবিতার পেছনের রয়েছে অনন্য ইতিহাস। তিনি বলেছেন—উনসত্তরের গণ অভ্যুত্থানের সময়ে এক সন্ধ্যায় রিক্সায় ফিরছি, তখন সামনে মিছিল চলছে। তখন এক রিকশাওয়ালা বলে উঠলো, “মার শালাদের মার” ; কথাটা আমার মগজে গেঁথে গেল। আসলেও তো তাই। দেশপ্রেমের জন্যও তো মার্ডার করা যেতে পারে। ওই ঘটনা থেকে কবিতাটির জন্ম।
‘নিষিদ্ধ সম্পাদকীয়’র মতো ‘অগ্ন্যুৎসব’ কবিতাও শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে আগুন জ্বেলে দেয়। এ কবিতায় কবি বলেছেন,
ছিলো তা এক অগ্ন্যুৎসব, সেদিন আমি
সবটুকু বুক রেখেছিলাম স্বয়ংক্রিয় আগ্নেয়াস্ত্রে?
জীবন বাজি ধরেছিলাম প্রেমের নামে
রক্তঋণে স্বদেশ হলো, তোমার দিকে চোখ ছিলো না
জন্মভূমি সেদিন তোমার সতীন ছিলো।’
ঠিক এই কবি যখন আবার রোমান্টিক কবিতা লিখছেন তখন তা হয়ে যাচ্ছে নিটোল কোন প্রেমিক পুরুষের বাক্য, যার জীবনে দেশ সমাজ নিয়ে কোন চিন্তা নেই, আছে শুধু এক বুক ভালোবাসা আর সেই ভালোবাসার মানুষের কাছে পাওয়া এক বুক হতাশা। ‘ইচ্ছে ছিলো’ নিটল প্রেমের তেমনি এক রোমান্টিক কবিতা। সেখানে কবি বলেন –
ইচ্ছে ছিলো তোমাকে সম্রাজ্ঞী করে সাম্রাজ্য বাড়াবো
ইচ্ছে ছিলো তোমাকেই সুখের পতাকা করে
শান্তির কপোত করে হৃদয়ে উড়াবো
এই কবিতায় কবি তার প্রেমিকাকে সাজাতে চেয়েছেন নিজস্ব ঢংয়ে, নিজস্ব রঙ্গে। আবার ‘প্রস্থান’ কবিতায় কবি তার প্রিয়তমার কাছে পত্র চেয়ে পাঠিয়েছেন। কারণ, প্রিয়জনের চিন্তা সব সময় মনকে ব্যাথাতুর করে রাখে। সেখানে বলেন –
এখন তুমি কোথায় আছো কেমন আছো, পত্র দিয়ো।
এক বিকেলে মেলায় কেনা খামখেয়ালী তাল পাখাটা
খুব নিশীথে তোমার হাতে কেমন আছে, পত্র দিয়ো।
হেলাল হাফিজ প্রেম ও বিদ্রোহের এক অনন্য মেলবন্ধন। তার কবিতা আমাদের হৃদয়কে ছুঁয়ে যায় এবং আমাদের চিন্তার জগতে আলোড়ন সৃষ্টি করে। বাংলা সাহিত্যে হেলাল হাফিজের কবিতা শুধু পড়ার জন্য নয়, অনুভব করার জন্য। তিনি প্রমাণ করেছেন, কবিতা শুধুমাত্র সৌন্দর্যের প্রকাশ নয়, এটি সমাজের প্রতিচ্ছবি, এটি বিদ্রোহের হাতিয়ার, এটি ভালোবাসার প্রকাশ।
আরো ব্লগ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখক
শাহ মোহাম্মদ ফজলে এলাহী
ইন্টার্ন, কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE