“ঢাকা শহর সামনে আছে,
গাড়ি ঘোড়া চলতে আছে,
কী চমৎকার দেখা গেল,
এইবারেতে আইসা গেল ”
কয়েক দশক আগেও গ্রামাঞ্চলের রাস্তা-ঘাটে, হাটে-মেলায় নিত্যদিনে বায়োস্কোপের নেশা জেঁকে ধরত ছেলে-বুড়োদের। গ্রামের পথে পথে এক সময় কাঁধে বাক্স নিয়ে ডুগডুগি বাজিয়ে বায়োস্কোপওয়ালা ঘুরতেন। গ্রামের শিশুরা ছুটত তাঁর পেছন পেছন। বাক্সের চারখানা ফুটোয় চোখ লাগিয়ে কল্পনার সিনেমা দেখতেন গ্রামের মানুষ।মাথায় ছোট লাল রঙের কাঠের অথবা টিনের বাক্স নিয়ে রংবেরঙের অদ্ভুত পোশাক পরে গ্রামের পথেঘাটে হেঁটে বেড়াত বায়োস্কোপ দেখানোর উদ্দেশ্যে। তাদের হাতে বাজতে থাকা খঞ্জনি বা করতালের শব্দ আর কণ্ঠে ছন্দোময় বাক্য জনতাকে আকৃষ্ট করত। আর পেছনে পেছনে ঘুরত একদল ছেলেমেয়ে।
বায়োস্কোপ বলতে বোঝায় এক ধরনের ভ্রাম্যমাণ সিনেমা প্রদর্শনী যন্ত্র। এটি ছিল বাচ্চাদের এবং গ্রামের মানুষের জন্য একটি আকর্ষণীয় বিনোদন মাধ্যম। ছোট্ট একটি বাক্সের মধ্যে বিভিন্ন ছবি সাজানো থাকত এবং দর্শকরা একটি ছোট লেন্স দিয়ে সেই ছবি দেখতে পেত। বায়োস্কোপ একটি যান্ত্রিক ডিভাইস যা দিয়ে এক ধরনের চলমান ছবি দেখা যেত। ছোট্ট একটি বাক্সের ভেতরে বিভিন্ন চিত্র একে একে প্রদর্শিত হতো, আর দর্শকরা এক চোখ দিয়ে সেই চিত্রগুলো দেখতে পেতো। বায়োস্কোপের অপারেটর সামনে দাঁড়িয়ে থেকে বিভিন্ন ধরণের গল্প শোনাতেন এবং ছবিগুলোর সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কণ্ঠস্বর ব্যবহার করতেন। এটা ছিলো এক ধরনের প্রাথমিক পর্যায়ের চলমান ছবি বা সিনেমার মতো। তবে সেটি সম্পূর্ণ ছিলো ম্যানুয়াল, যেখানে বিদ্যুৎ বা ইলেকট্রনিক ডিভাইসের ব্যবহার ছিলো না।
বায়োস্কোপের সঙ্গে বাঙালিকে পরিচয় করিয়ে দেয়ার কিছু নেই। বিশেষ করে গ্রাম বাংলার জনপদে বেড়ে ওঠা মানুষকে তো বটেই। বায়োস্কোপের শেকড় খুঁজলে আমরা জানতে পারি যে, এটি প্রথম ইউরোপে উদ্ভাবিত হয় এবং পরে ভারতীয় উপমহাদেশে আসে। এটি প্রথম দিকে প্রধানত গ্রামাঞ্চলে জনপ্রিয় হয় এবং মেলাগুলোতে বা উৎসবের সময় প্রদর্শিত হত।
বায়োস্কোপ দেখার মাধ্যমে গ্রামীণ মানুষেরা বিভিন্ন দেশের দৃশ্য, ঐতিহাসিক ঘটনা, এবং অন্যান্য সংস্কৃতি সম্পর্কে জানতে পারতেন। বিনোদনের অন্যতম মাধ্যম হিসেবে বায়োস্কোপ গ্রামীণ সমাজে বিশেষ স্থান অধিকার করে ছিল।
বর্তমান সময়ে গ্রাম বাংলায় বায়োস্কোপ এমনই বিরল যে, জাদুঘরে রেখে দেয়ার জন্যও অন্তত একটি বায়োস্কোপ কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। বায়োস্কোপ ধীরে ধীরে হারিয়ে যেতে থাকে। টেলিভিশন, সিনেমা হল এবং ইন্টারনেটের প্রসার বায়োস্কোপের জনপ্রিয়তা কমিয়ে দিয়েছে। আধুনিক বিনোদন মাধ্যমের সহজলভ্যতা ও বৈচিত্র্যের কারণে বায়োস্কোপ আর আগের মত আকর্ষণীয় মনে হয় না। শহরায়নের ফলে গ্রামীণ মানুষের জীবনধারা পরিবর্তিত হয়েছে এবং তারা আরও আধুনিক বিনোদন মাধ্যমের দিকে ঝুঁকেছে। বর্তমানে হাতে হাতে মুঠোফোন আর ইন্টারনেটের কারণে বায়োস্কোপের কদর অনেক কমে গিয়েছে। বিনোদনের সহজলভ্যতার কারণেই দিন দিন বায়োস্কোপের বিলুপ্তি ঘটছে।
বায়োস্কোপ, বাংলাদেশের চিরচেনা হারিয়ে যাওয়া একটি লোকজ ঐতিহ্যের নাম যা এক সময় ছিল গ্রাম বাংলার শিশুদের চিত্ত বিনোদনের মাধ্যম। ভেঁপু বাঁশি বাজিয়ে সবাইকে আহবান জানিয়ে দুলদুল ঘোড়া, মক্কা-মদিনা, আজমির শরীফ ও ক্ষুদিরামের ফাঁসির বায়োস্কোপ দেখিয়ে আজও শিশু-কিশোর-বৃদ্ধ সব বয়সের মানুষকে সমান তালে আনন্দ দিয়ে যায়। খঞ্জনি আর গানের তালে বাক্সের ভেতর পাল্টে যায় ছবি। আর তা দেখে যেন গল্পের জগতে হারিয়ে যায় ছেলে বুড়ো সবাই। বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মেলা, পূজা-পার্বণে তার বায়োস্কোপ প্রদর্শনী হয়ে থাকে।
কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে গ্রামবাংলার ঐতিহ্যবাহী এই বায়োস্কোপ। শহরাঞ্চল বা গ্রামীণ পথ কোথাও-ই আজকাল সাধারণ দিনে চোখে পড়ে না কোনো বায়োস্কোপওয়ালা। তারপরও কিছু মেলায় এখনো বায়োস্কোপওয়ালাদের দেখা মিলছে। তবে সেটা আর কত দিন, সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে বিকাশ ঘটেছে প্রযুক্তির; বায়োস্কোপ ছাড়িয়ে এলো সিনেমা হল এবং ঘরে ঘরে স্যাটেলাইট টিভি ও ইন্টারনেট সংযোগ। আর হারিয়ে গেল বায়োস্কোপ প্রদর্শন।
এ ধরনের আরও ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন
লেখক,
মো: শিহাব উল আযম চৌধুরী
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE