শহীদুল্লাহ কায়সার – আজও যে নামটি পাঠকসমাজে শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করা হয়। তিনি বাংলাদেশের সাহিত্যের এক অমর ক্ষ্যাতিমান ব্যক্তিত্ত। তিনি শুধুই একজন লেখক নন; তিনি ছিলেন একাধারে একজন সাংবাদিক, ঔপন্যাসিক ও বুদ্ধিজীবী। তিনি তার সাহিত্যকর্মের মধ্য দিয়ে পাঠকদের মনে স্থান করে নিয়েছিলেন। কেবল সাহিত্যই নয়, রাজনীতিতেও তার অবদান অনস্বীকার্য।
শহীদুল্লাহ কায়সার তার সাহিত্যে সমাজ ও মানুষের দৈনন্দিন জীবন, কষ্ট ও সংগ্রামকে তুলে ধরেছেন। তার লিখনীর গভীর মানবতাবাদী দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তিনি আজও পাঠকদের কাছে জনপ্রিয়।
ছাত্রজীবন থেকেই বিভিন্ন সামাজিক ও রাজনৈতিক আন্দোলনে ছিল তার স্বক্রিও অংশগ্রহণ। ১৯৪৭ থেকে ৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত সে বিভিন্ন আন্দোলনে সাহসী ভূমিকা পালনের জন্য একাধিকবার কারাদণ্ডও ভোগ করেছেন। কিন্তু তাতেও তিনি দমে যান নি। কারাগারে বসেই তিনি তার লেখালিখির কাজ চালিয়ে গিয়েছেন। তার বিখ্যাত কিছু উপন্যাস – সারেং বউ, সংসপ্তক, রাজবন্দির রোজনামচা তিনি কারাগারে বসেই লিখেছেন।
সারেং বউ:
১৯৫৮ সালে সামরিক শাসক কর্তৃক জননিরাপত্তা আইনে আইয়ুব সরকার তাকে গ্রেফতার করলে, জেলে বসেই শহীদুল্লাহ কায়সার সারেং বউ উপন্যাসটি রচনা করেন। জেল থেকে মুক্তি পাওয়ার এক মাস পরে ১৯৬২ সালের নভেম্বর মাসে প্রকাশিত হয় তার এই বিখ্যাত উপন্যাস। পরবর্তীতে ১৯৭৮ সালে তার এই উপন্যাসটিকে চলচ্চিত্রে রূপদান করা হয়। এ উপন্যাসে তিনি এক দেশ-বিদেশ ভ্রমণকারী সারেং ও তার বউ এর সমুদ্র উপকূলবর্তি গ্রামীণ ও সংগ্রামী জীবনের চিত্র বর্ণনা করেছেন। উপন্যাসের সারেং ও তার স্ত্রী মেঘলার প্রেম, সংগ্রাম ও ত্যাগের কাহিনি পাঠকদের মনকে সহজেই আকৃষ্ট করে।
সংশপ্তক:
১৯৬৫ সালে শহিদুল্লাহ কায়সারের ২য় উপন্যাস সংশপ্তক প্রকাশিত হয়, যার অর্থ “হয় জয়, না হয় মৃত্যু”। পরবর্তীতে এটিরও নাট্যরূপ প্রদান করা হয়। এ উপন্যাসে তিনি তৎকালীন পূর্ববঙ্গের গ্রামীণ সমাজব্যবস্থা ও সে সমাজের মানুষের শাসন-শোষণের কথা তুলে ধরেছেন। ১৯৪০-৬০ দশকের প্রেক্ষাপটে রচিত এই উপন্যাস।এখানে ভারতীয় উপমহাদেশে স্বাধীনতা আন্দোলন ও পাকিস্তানি শাসনামলে এদেশের মানুষের বৈষম্য ও অবিচারের কথা ফুটিয়ে তুলেছেন। সমাজের
এই শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করে নিজের অধিকার আদায় করা পাঠকদের জন্য প্রেরণার জোগান দেয়।
রাজবন্দির রোজনামচা:
রাজবন্দির রোজনামচা শহীদুল্লাহ কায়সারের একটি স্মৃতিকথা যা ১৯৬২ সালে প্রথম প্রকাশিত হয়। এখানে তিনি তার কারাগারে কাটানো দিনগুলোর কথা ও পাকিস্তানি শাসক কর্তৃক একজন রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে তার অভিজ্ঞতাগুলো বর্ণনা করেছেন। ১৯৫২ এর পর থেকে পাকিস্তানি সরকারের বিরোধিতা ও নিজ অধিকার আদায়ে আন্দোলনের জন্য তাকে দীর্ঘদিন কারাগারের পেছনে কাটাতে হয়েছে। বইটিতে তিনি রাজনৈতিক বন্দিদের জীবনসংগ্রাম ও পাকিস্তানি বাহিনীর অত্যাচার ও নিপীড়নের কথা উল্লেখ করেছেন। তার লেখা আজও বাঙালি জাতিকে মুক্তিযুদ্ধের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়।
শহীদুল্লাহ কায়সারের লেখা আরও কিছু উল্লেখযোগ্য উপন্যাস হলো- কৃষ্ণচূড়া মেঘ, তিমির বলয়, দিগন্তে ফুলের আগুন, সমুদ্র ও তৃষ্ণা, চন্দ্রভানের কন্যা ইত্যাদি। বাংলা সাহিত্যে তার গুরুত্বপূর্ণ অবদানের কারণে তিনি অনেকগুলো পুরস্কারে ভূষিত হয়েছেন। এ পুরস্কারগুলো হলো- আদমজী সাহিত্য পুরস্কার (১৯৬২), বাংলা একাডেমি পুরস্কার (১৯৬৯), অমর একুশে পদক (১৯৮৩) ও মন্বন্তর স্বাধীনতা পুরস্কার (১৯৯৮)।
জীবনের একটি দীর্ঘ সময় শহিদুল্লাহ কায়সারের কারাগারে বসে কাটাতে হয়েছে। ১৯৭১ এর ২৫শে মার্চের কালরাত্রির গণহত্যার পর যখন অন্যান্য লেখক ও সাহিত্যিকেরা নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে দেশ-বিদেশে পাড়ি জমান, তখনও তিনি দেশ ছেড়ে পালিয়ে যান নি। বরং তখনও তিনি দেশের ও দেশের মানুষের অধিকার ও স্বাধীনতা আদায়ে লড়াই করেছেন। তিনি শুধুমাত্র স্বশরীরে আন্দোলনে অংশগ্রহণই করেন নি; তার লেখা ও কলমকেও তিনি মুক্তিযুদ্ধের শক্তিশালী অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছেন। তার লিখনীর মধ্য দিয়ে তিনি জনগণকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন এবং স্বৈরচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছেন।
১৯৭১ সালের ১৪ই ডিসেম্বর রাতে পাকিস্তানি বাহিনী ও তাদের সহযোগী আলবদর বাহিনী তাকে আটক করে এবং ধারণা করা হয় যে তাকে হত্যা করে। শহীদুল্লাহ কায়সার আজ আর আমাদের মাঝে না থাকলে, তার সাহিত্যকর্ম ও সংগ্রামের গল্প আজও মানুষের মনে গেঁথে আছে। তার জীবনী এদেশের মানুষের মনে প্রেরণার জোগান দেয় ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে বাঁচিয়ে রাখে। তার লিখনীর মধ্য দিয়ে এভাবেই তিনি আজও তিনি সকলের মাঝে চিরতর জীবিত হয়ে থাকবেন।
এরকম আরো ব্লগ পড়তে – ক্লিক করুন
লেখক,
সারাহ মাহদিয়া
ইন্টার্ন,
কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE.