বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতে নেতৃত্ব দানকারী ব্যক্তিত্বদের মাঝে একটি গুরুত্বপূর্ণ নাম – তরুণ কুমার মিস্ত্রী। বর্তমানে তিনি এস্কয়ার গ্রুপ (Esquire Group) এর চিফ অপারেটিং অফিসার (COO) হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। শৈশবের কঠিন বাস্তবতা থেকে শুরু করে নেতৃত্বের আসনে পৌঁছানোর এই যাত্রা কেবল একজন ব্যক্তির ক্যারিয়ারের গল্প নয় – এটি একজন মানুষের সংগ্রাম, অধ্যবসায়, আত্মবিশ্বাস ও মানবিক দৃষ্টিভঙ্গির প্রতিচ্ছবি। তরুণ মিস্ত্রীর এই গল্প নিঃসন্দেহে আমাদের নতুন করে ভাবতে শেখায় – নিজেকে বদলানোর উদ্দেশ্যে দৃষ্টিভঙ্গিই হোক প্রথম পরিবর্তন।
সংগ্রাম থেকে স্থিরতায়: শৈশব ও শিক্ষাজীবনের বাস্তবতা
নদীবেষ্টিত সুন্দরবনের এক প্রত্যন্ত গ্রামে জন্ম তরুণ মিস্ত্রীর। শৈশব কেটেছে চরম অভাব ও অনাহারের মধ্য দিয়ে। এমনও দিন গিয়েছে, যখন পরীক্ষার ফি না থাকার কারণে পরীক্ষায় অংশ নিতে পারেননি। তবে মায়ের অদম্য ভালোবাসা ও ত্যাগ তাঁকে কখনো থেমে যেতে দেয়নি – রাস্তা থেকে কুড়িয়ে পাওয়া চারটি ডিম বিক্রি করে সেই ফি জোগাড় করেছিলেন তিনি।
পরবর্তীতে খুলনায় কাকার কাছে যাওয়ার সুযোগ মিলে, যিনি ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক এবং তাঁর জীবনের প্রথম মেন্টর। উচ্চশিক্ষার পথে এগোতে গিয়ে বারবার ব্যর্থতার মুখোমুখি হলেও বুয়েট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি না হওয়া সত্ত্বেও তিনি হাল ছাড়েননি। শেষ পর্যন্ত ২০০১ সালে বুটেক্সে ভর্তি হয়ে নিজের সম্ভাবনাকে নতুন পথ দেখান।
টেক্সটাইল জগতে প্রবেশের পেছনের প্রেরণা
তরুণ মিস্ত্রীর এই খাতে আসার মূল অনুপ্রেরণা ছিল পরিবারের আর্থিক অবস্থা পরিবর্তনের দৃঢ় সংকল্প এবং দেশের জন্য কিছু করার গভীর ইচ্ছা। তিনি আর.এম.জি খাতকে দেখেছেন সম্ভাবনার প্ল্যাটফর্ম হিসেবে – যা কেবল চাকরি নয়, বরং নেতৃত্ব ও প্রভাব তৈরির সুযোগ দেয়। একজন প্রোডাকশন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে ক্যারিয়ার শুরু করে ধাপে ধাপে নেতৃত্বের আসনে পৌঁছানো তরুণের জন্য ছিল মানসিক দৃঢ়তার অনুশীলন। এই যাত্রায় শ্রমিকের মুখে পাওয়া স্বীকৃতি ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় অনুপ্রেরণা।
নেতৃত্বের লীপ: The CEO Leap বইয়ের মূল অন্তর্দৃষ্টি
তরুণ মিস্ত্রীর লেখা বই “The CEO Leap” এক কথায় একজন ম্যানেজার থেকে ভিশনারি লিডারে রূপান্তরের সচেতন যাত্রার নকশা। তাঁর মতে, উপযুক্ত দিকনির্দেশনার অভাবে সবাই সবসময় সঠিক নেতৃত্ব দিতে পারে না। এই বই তিনটি স্তরে ফোকাস করে:
- আত্ম-উপলব্ধি
- প্রযুক্তিগত দক্ষতার বাইরের দক্ষতা মূল্যায়ন
- সঠিক সময় ও সঠিকভাবে লীপ নেওয়ার কৌশল
অপারেশনাল সাফল্যের মূল চাবিকাঠি: Lean & Discipline
তরুণ মিস্ত্রীর অপারেশনাল দর্শন কেবল দক্ষতাভিত্তিক নয়, বরং মাইন্ডসেট ভিত্তিক। তিনি সমন্বয়, ভিজ্যুয়াল ড্যাশবোর্ড, ইনসেনটিভ-ভিত্তিক ট্র্যাকিং চালু করে একটি ডিসিপ্লিনড অপারেশনাল কালচার গড়ে তোলেন। এমপাওয়ারমেন্ট ও স্কেলেবিলিটি হলো তাঁর নেতৃত্বের মূল দিক। এমনকি সংকটকালেও তিনি স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছেন।
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ এবং তার উত্তরণ
একটি ভেঙে পড়া মার্চেন্ডাইজিং টিমকে পুনর্গঠন করা ছিল তাঁর পেশাগত জীবনের অন্যতম কঠিন সময়। সেই দলকে বিশ্বাস, ওনারশিপ ও একাউন্টেবিলিটি এর মধ্য দিয়ে পুনরায় তিনি গড়ে তোলেন। নিজে শারীরিকভাবে অসুস্থ থাকাকালেও দায়িত্ব ছাড়েননি। তরুণ বিশ্বাস করেন, “We need people who believe”। এই বিশ্বাস থেকেই একটি ভেঙে যাওয়া টিমকে তিনি উচ্চ-কার্যক্ষমতাসম্পন্ন ইউনিটে রূপান্তর করেছেন।
তরুণ উদ্যোক্তাদের জন্য প্রয়োজনীয় গুণাবলি
তরুণের মতে, ভবিষ্যতের উদ্যোক্তাদের মধ্যে থাকতে হবে ভিশনারি চিন্তাভাবনা, মানুষকে আগে রাখার মানসিকতা, স্থিতিস্থাপকতা, অভিযোজন ক্ষমতা এবং বিনয় ও সততা। তিনি বিশ্বাস করেন, নেতৃত্ব মানে শুধুমাত্র পরিচালনা নয় বরং এটি একটি দায়িত্ব, যা ভবিষ্যৎকে প্রভাবিত করতে পারে।
গ্লোবাল ব্র্যান্ডের সাথে কাজের অভিজ্ঞতা
আন্তর্জাতিক ব্র্যান্ডের সঙ্গে কাজ করার অভিজ্ঞতা তাঁকে শিখিয়েছে নির্ভুলতা, স্বচ্ছতা এবং টেকসই এর গুরুত্ব। Kaizen, Root Cause Analysis ও Quality Thinking এর মাধ্যমে তিনি প্রতিটি পদক্ষেপে উৎকর্ষের চর্চা করেছেন। তিনি বিশ্বাস করেন, “Excellence is not an event, it’s a habit”.
বাংলাদেশের আর.এম.জি সেক্টরের জন্য দিকনির্দেশনা
তরুণ মিস্ত্রীর মতে, বাংলাদেশের গার্মেন্টস খাতকে বিশ্বসেরা করতে হলে প্রয়োজন মানবকেন্দ্রিক রূপান্তর। IoT, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও অটোমেশনসহ টেক ও ডেটা ইন্টিগ্রেশনকে গুরুত্ব দিয়ে একটি লীন কালচার গড়ে তোলা দরকার, যা শুধু একটি প্রজেক্ট নয়, বরং প্রতিদিনের চর্চা হবে। পাশাপাশি “Made in Bangladesh” থেকে “Designed & Delivered by Bangladesh” এর দৃষ্টিভঙ্গিতে রূপান্তর এবং ওনারশিপ মাইন্ডসেট গড়ে তোলা অত্যন্ত জরুরি।
টেকসইতা ও নৈতিক চর্চায় তাঁর নেওয়া উদ্যোগ
তিনি পরিবেশ এবং নৈতিক চর্চায় উদ্ভাবনী পদক্ষেপ নিয়েছেন – ইটিপি, ইনভার্টার মোটর, অটো ডায়িং সিস্টেম, ওয়েস্ট রিডাকশন, এবং জিরো টলারেন্স নীতি। কর্মীদের কল্যাণ, অভিযোগ নিষ্পত্তি প্রক্রিয়া, লিডারশিপ ডেভেলপমেন্ট এবং কাগজবিহীন পরিকল্পনা ব্যবস্থা তাঁর উদ্যোগের অন্যতম অংশ।
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বার্তা
ভবিষ্যৎ প্রজন্মের উদ্দেশ্যে তরুণ বলতে চান,
“Start small, think big, never stop”
Pain কে শক্তিতে রূপ দাও। Stay gentle, but be relentless। তোমার স্বপ্ন যদি ভয় না দেখায়, তাহলে সেটা যথেষ্ট বড় না।”
তরুণ কুমার মিস্ত্রীর জীবনগল্প শুধু সাফল্যের নয়, এটি বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে সামনে এগিয়ে যাওয়ার শক্তির গল্প। একজন শ্রমজীবী পরিবারের সন্তান থেকে একজন কর্পোরেট লিডারে রূপান্তরের এই যাত্রা আমাদের শেখায় আত্মবিশ্বাস, অধ্যবসায় আর মানুষের জন্য কিছু করার ইচ্ছা থাকলে কোনো কিছুই অসাধ্য নয়।
YSSE-এর পক্ষ থেকে তাঁকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই তাঁর অভিজ্ঞতা এবং অনুপ্রেরণামূলক গল্প আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য। তাঁর নেতৃত্ব, বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতা ও আত্মবিশ্বাস সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ক।
এই রকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন
লেখক
সুদীপ্ত বণিক
ইন্টার্ন, কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE