বর্তমান সময়ে সমাজের নানা স্তরে পরিবর্তন আনতে গবেষণা, সচেতনতা ও কাজের জোরালো সমন্বয় অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। আর এমন কিছু মানুষের পথচলা আমাদের আশাবাদী করে, যারা নিজেদের কাজের মাধ্যমে অন্যদের জন্য পথ দেখাচ্ছেন। তেমনি একজন অনুপ্রেরণাদায়ী মানুষ সুমাইয়া আফরিন খান – Former Research Associate, Centre for Resilience & Youth। আজকের এই কথোপকথনে উঠে এসেছে তাঁর গবেষণা অভিজ্ঞতা, সমাজ নিয়ে ভাবনা, তরুণদের প্রতি আস্থা এবং নারীর ক্ষমতায়ন নিয়ে তাঁর গভীর উপলব্ধির কথা।

শৈশবের পাতা উল্টে দেখা

পুরান ঢাকার প্রাণবন্ত পরিবেশেই বেড়ে উঠেছেন সুমাইয়া। পড়াশোনা, খেলা আর ঘোরাফেরা – সবকিছু মিলিয়ে ছিল এক চঞ্চল শৈশব। শুরুতে রোল নম্বর ১ এর গর্ব থাকলেও পরে বুঝেছেন, ধারাবাহিকতা আর আগ্রহই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। পুতুল খেলার বদলে হাতে ছিল ব্যাট-বল, মাঠে দাপিয়ে বেড়ানোর আনন্দ।

পরে ধানমন্ডিতে এসে নিজেকে মানিয়ে নিয়েছেন। অগ্রণী স্কুল এন্ড কলেজ থেকে এসএসসি (২০১৬)এইচএসসি (২০১৮) শেষে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ২০২৪ সালে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেন। সবসময় চেষ্টা করেছেন একমাত্রিক না হয়ে বিতর্ক, সায়েন্স ফেয়ার, রাইটিং ও স্পোর্টসে যুক্ত থাকতে।

শব্দের জগতে যাত্রা

লেখালেখির প্রতি আগ্রহ আসে পারিবারিক অনুপ্রেরণা থেকে। ছোটবেলায় প্রথম প্রতিযোগিতায় বোনের উৎসাহে অংশ নেওয়া – এই সাফল্যই লেখার প্রতি ভালোবাসার শুরু। তারপর থেকে ডায়েরি লেখা, জার্নালিং, টু-ডু লিস্ট সব কিছুতেই ছিল শব্দের সঙ্গে গভীর সম্পর্ক। ধীরে ধীরে তা রূপ নেয় কনটেন্ট লেখার অভ্যাসে।

গবেষণার মাঠে শেখা

Centre for Resilience and Youth-এ Research Associate হিসেবে কাজ তাঁকে দিয়েছে জীবনের ভিন্ন স্বাদ। গবেষণা তাঁর কাছে কেবল তথ্য বিশ্লেষণ নয়, বরং মানুষের অনুভব বোঝার মাধ্যম। কাজ করেছেন বুয়েটের রেজিলিয়েন্স মডেল, ঘূর্ণিঝড় রেমাল রিপোর্টিং ও ল্যান্ডস্লাইড প্রজেক্টে। টিমওয়ার্ক, ধৈর্য ও সহমর্মিতা শিখেছেন এখানেই।

রকমারির গল্প

রকমারিতে কনটেন্ট রাইটিংডিজিটাল মার্কেটিং এর দায়িত্ব ছিল তাঁর হাতে। প্রথম দিন অফিসের বইয়ের সারি দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। আইরিন আপুর নেতৃত্বে শিখেন কিভাবে একটি কনটেন্ট দিয়ে পাঠকের মনে জায়গা করে নিতে হয়। অফিসের স্বাধীনতা আর বইয়ের ঘ্রাণ মিলিয়ে এটি ছিল তাঁর প্যাশনের প্রকৃত ঠিকানা।

অনেক পরিচয়ের মধ্যে নিজেকে খোঁজা

সুমাইয়া একাধারে ফিচার রাইটার, ভয়েসওভার আর্টিস্ট, বুক রিভিউয়ার। ২০১৯ সালে Writers Club BD থেকে শুরু হয় তাঁর পেশাগত লেখা। ভয়েসওভারে তিনি খুঁজে পান একান্ত শান্তি৷ নীরব রাত্রিতে মাইকের সামনে গল্প বলা তাঁকে গভীরভাবে ছুঁয়ে যায়। এখনো দেশের অনেক ভয়েস আর্টিস্টকে ফলো করেন, নিজের পডকাস্ট বা ইউটিউব চ্যানেলের স্বপ্ন লালন করেন।

যুবসমাজ ও নারীর ক্ষমতায়ন

তাঁর মতে, যুবসময়ই জীবনের সবচেয়ে কার্যকর সময়। এই বয়সে মানুষ সাহসী হয়, স্বপ্ন দেখে এবং সমাজ বদলাতে চায়। যদি তারা সঠিক দিকনির্দেশনা পায়, তাহলে তারাই সমাজ বদলের চালিকাশক্তি।

নারীর ক্ষমতায়ন নিয়েও তাঁর মত স্পষ্ট,

“ক্ষমতার আগে চাই শিক্ষা”

একজন শিক্ষিত নারী জানে নিজের পক্ষে কিভাবে দাঁড়াতে হয়। তাই পরিবার-সমাজের সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে নারীদের সচেতনতা অর্জনকে তিনি সর্বাগ্রে রাখেন।

চ্যালেঞ্জের মুখে এগিয়ে চলা

সময় ব্যবস্থাপনাই ছিল তাঁর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। লেখালেখি, পড়াশোনা, ভয়েসওভার – সব কিছু একসাথে চালানো সহজ ছিল না। তবে চা, গান আর ভ্রমণের মধ্যেই খুঁজে পেয়েছেন রিচার্জের উপায়। ২০২২-২৩ সালে ১৭টি জেলা ভ্রমণ করেছেন, যা তাঁকে দিয়েছে নতুন গল্প ও দৃষ্টিভঙ্গি।

সমাজের প্রশ্ন – “এত কিছু কেন করো?” বাধা তৈরি করলেও তিনি জানতেন, তাঁর কাজের একটি উদ্দেশ্য আছে। বড় কোনো অভাব বা নিরাপত্তাহীনতার সঙ্গে না লড়েও তিনি ভাগ্যবান মনে করেন নিজেকে।

পাঠকের প্রতিক্রিয়া ও অনুপ্রেরণা

২০২৫ সালে এক পেজ থেকে প্রোডাক্ট অর্ডার করলে একজন তাঁকে চিনে বলেন, “আমি আপনার লেখা পড়ি এবং আপনার লেখা আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে।” এমন ছোট্ট কথাগুলোই তাঁকে আশাবাদী করে তোলে। অনেকে বলেছেন, তাঁর কাজ দেখে এক্সট্রা-কারিকুলারে অংশ নিয়েছেন যা তাঁর জন্য বড় প্রাপ্তি।

তিনি নিজেকে এখনো শিক্ষার্থী ভাবেন এবং চান, যারা পরে আসবে তারা আরও ভালো করুক এবং বাংলাদেশের গণ্ডি ছাড়িয়ে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ছড়িয়ে পড়ুক।

তরুণদের জন্য পরামর্শ

তরুণদের উদ্দেশ্যে তার বার্তা সহজ ও বাস্তব:

  • কনসিসটেন্সি ধরে রাখো
  • প্রতিদিন একটু হলেও স্বপ্নের পথে কাজ করো
  • পড়ার অভ্যাস গড়ো – যা-ই হোক, কিছু না কিছু পড়তেই হবে
  • নিজের ফিল্ড ছাড়াও অন্য খাত নিয়ে ধারণা রাখো, এতে চিন্তার পরিধি বাড়ে

স্বপ্নের বাংলাদেশ

সুমাইয়া এমন একটি বাংলাদেশ কল্পনা করেন – যেখানে দুর্নীতি কম, শহর ট্রাফিকমুক্ত, পরিবেশ পরিচ্ছন্ন এবং প্রতিটি ছাদে ছাদবাগান ও প্রতিটি বাড়িতে ইনডোর প্ল্যান্ট। সেখানে তরুণরা হবে সচেতন নাগরিক। তারা প্রশ্ন করবে, জানবে, শিখবে এবং দেশের জন্য ভবিষ্যতে দায়িত্ব নেবে।

সুমাইয়া আফরিন খান শুধু একজন গবেষক নন, তিনি একজন গল্পকার, অনুপ্রেরণা এবং সমাজের নীরব কণ্ঠস্বর। তাঁর যাত্রা প্রমাণ করে আগ্রহ, সচেতনতা আর অধ্যবসায়ের সংমিশ্রণেই সম্ভব সত্যিকারের পরিবর্তন আনা।

YSSEএর পক্ষ থেকে তাঁকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জানাই তাঁর অভিজ্ঞতা এবং অনুপ্রেরণামূলক গল্প আমাদের সাথে শেয়ার করার জন্য। তাঁর সাহসী কণ্ঠ, বহুমাত্রিক অভিজ্ঞতা ও আত্মবিশ্বাস সত্যিই অনুপ্রেরণাদায়ক।

এই রকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন 

লেখক

সুদীপ্ত বণিক

ইন্টার্ন, কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট

YSSE