গত ১৮ নভেম্বর,২০২৩ অনুষ্ঠিত হয়েছে “জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড ২০২৩” যেখানে ওষুধ বিষয়ক ইনফরমেশন শেয়ারিং প্লাটফর্ম “ক্লিয়ার কনসেপ্ট” – ‘Innovation & Communication’ ক্যাটাগরিতে “জয় বাংলা ইয়ুথ অ্যাওয়ার্ড” অর্জন করেছে।
“ক্লিয়ার কনসেপ্ট” জনসাধারণের ওষুধ বিষয়ক নানা জিজ্ঞাসার জবাব এবং ভুলভ্রান্তি নিয়ে সচেতনতা তৈরিতে কাজ করে যাচ্ছে। এই পেজের প্রতিষ্ঠাতা মোহাম্মদ হিরোক শেখ সাথে একটি ইন্টারভিউ এর মাধ্যমে কথা বলার সুযোগ হয়েছিল। আজ আমরা তার সম্পর্কে এবং “ক্লিয়ার কনসেপ্ট” যাত্রার গল্প শুনবো তার কাছ থেকেই।
YSSE: প্রথমেই আপনার সম্পর্কে জানতে চাইছি। আপনার জন্ম, পড়াশোনা, বেড়ে উঠা, বর্তমানে কী কাজ করছেন ইত্যাদি।
আমার নাম মোহাম্মদ হিরোক শেখ। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগ থেকে বি.ফার্ম সম্পন্ন করেছি। আমার বেড়ে ওঠা ফরিদপুর জেলায় এবং স্কুল, কলেজের বিদ্যাপীঠ সেখানেই সম্পন্ন করেছি। আমার উদ্দেশ্য ছিলো মানবসেবা সেই থেকে স্বপ্ন ছিলো ডাক্তার হবো। কিন্তু মেডিকেলে ভর্তি হতে না পেরে আমি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ফার্মাসী বিভাগে ভর্তি হই।
YSSE : আপনার প্লাটফর্ম ”Clear Concept” সম্পর্কে জানতে চাইছি যেমন আপনি কী বিষয় নিয়ে কাজ করেন। কীভাবে এই উদ্যোগটির সূচনা হয়েছিলো?
২০১৯ সালে ‘ক্লিয়ার কনসেপ্ট’ যাত্রা শুরু হয়। আমি তখন অনার্স ২য় বর্ষে। আমরা ফার্মেসীর দুই বন্ধু চিন্তাভাবনা করলাম, মানুষের বিজ্ঞান, চিকিৎসা, নিউট্রিশন নিয়ে যে ভুল ধারণাগুলো দূর রয়েছে তা ‘Clear Concept’ এই নামের মাধ্যমে কিছু করি। ২০১৯ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি দিকে ফেসবুক পেজ এবং ইউটিউব চ্যানেল খোলা হয় যদিও কনটেন্ট নিয়ে কোনো অভিজ্ঞতা ছিলো না। তখন আমাদের স্লোগান ছিলো – ‘Dispel Your Misconception and Enlarge Your Knowledge’
YSSE: ‘Clear Concept’ এতদূর আসার পিছনের গল্পটা সম্পর্কে জানতে চাইছি।
তখন আমার ফার্মাকোলজি কোর্সে এক শিক্ষক এন্টিবায়োটিক ও এন্টিবায়োটিক রেসিসটেন্স নিয়ে খুব ভালভাবে পড়াচ্ছিলেন। সেই প্রথম এন্টিবায়োটিক রেসিসটেন্স নিয়ে একটা ভিডিও করি। তারপর গল্পে গল্পে ফাজ থেরাপি নিয়ে একটা কনটেন্ট লিখি, অনেকেই প্রশংসা করছিলো! তারপরেই Clear Concept পেইজ খুলা, ছোটখাটো লেখা দেওয়া।
‘COVID’ আসার পরে, আমরা ‘Clear Concept Family’ নামে গ্রুপ খুললাম যেখানে বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা হতো। ক্যাম্পাস বন্ধে সবাই বাসায় চলে যাই এবং বন্ধুরা কোভিড নিয়ে মানুষের ভুল ধারণা, ওষুধের প্রচুর ভুল ব্যবহার দেখেন। তখন আমরা ‘Clear Concept Family’ গ্রুপের জন্য মডারেটর নিলাম এবং বিজ্ঞানের কুসংস্কার, ভুল ধারণা নিয়ে ফ্যাক্ট চেইক করতাম ও মানুষকে সঠিকটা জানাতাম। এছাড়াও নিউট্রিশন, চিকিৎসা নিয়ে যে ভুল ধারণা সেগুলো নিয়ে কথা বলতাম।
আলহামদুলিল্লাহ, এভাবে ভালো নেটওয়ার্ক তৈরি হয় এবং আমরা প্রথম টিমে এ ১০০ জন ক্যাম্পাস এক্সেকিউটিভ নিলাম। ২০২০-২০২১ সালে অনেক স্টুডেন্ট যুক্ত হয়। আমাদের পেজে ৫-৬ হাজার ফলোয়ার হয়, নিয়মিত কনটেন্ট গ্রুপে দিতাম। কোভিডে সময়টা বন্ধে থাকায় বলা যায় তখনই আমাদের যাত্রা শুরু হয়। আমরা তখন কনটেন্ট লিখা, পোস্টার ডিজাইন শিখি। তখন ভিডিও কোয়ালিটি ভালো ছিলোনা। এভাবেই আমাদের হাতেখড়ি শুরু হয়।
২০২১ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারিতে আমরা একটা ওয়েবসাইট লঞ্চ করি। আমাদের
ক্যাম্পাস এক্সিকিউটিভরা নিয়মিত লেখা দিতে থাকে। সব কাজ ভালই চলছিলো তবে ক্যাম্পাস খুলে যাওয়ার পর স্টুডেন্টরা তেমন সময় দিতে পারেনি।
আমরা ২০২৩ সালের শুরুর দিকে সিদ্ধান্ত নিই আমাদের মূল বিষয় ‘মেডিসিন’ নিয়েই শুধু কথা বলবো।
আমার একটি আড়াই মিনিটের ভিডিও ‘‘কিছু ঔষধ সেবনের নিয়ম’’ ৩ মিলিয়ন ভিউ হয়। এই টাইপের কন্টেন্ট নিয়ে কেউ কাজ করছেনা, আমার ঔষধ নিয়ে কথা বলা এবং ইংরেজি কে বাংলায় সহজে বোঝাতে পারার যে স্ট্রেন্থ আছে তা আমি খুঁজে পাই। সেখান থেকেই ওষুধ নিয়ে আমাদের যাত্রা শুরু।
এরপর আমরা ‘এই ওষুধ কেন খাবো’ নামে একটা গ্রুপ খুলি। যেখানে রোগীরা ওষুধ নিয়ে আমাদের প্রশ্ন করতে পারবে।
YSSE: এই আইডিয়া আপনি কিভাবে পেয়েছেন?
যেহেতু আমার উদ্দেশ্য ছিলো মানবসেবা যা আমি ওষুধ নিয়ে কাজ করার মাধ্যমে করতে পারবো তাই মেডিকেলে ভর্তি না হবার হতাশা আমার ছিলো না। আমি পড়াশোনাকে এভাবে নিয়েছি কীভাবে জীবনের এর সাথে যুক্ত করা যায়, ইনশাআল্লাহ আমি ফার্মেসীতে পড়াশোনা করে ভালো কিছু করবো।
YSSE: আপনার কাজ কিভাবে স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে প্রভাব ফেলেছে বলে আপনি মনে করেন? কিছু উদাহরণ শেয়ার করবেন কি?
অবশ্যই। একটা দেশের স্বাস্থ্যসেবার উন্নতি হবে যখন জনগণের ওষুধের ব্যাপারে ধারণা থাকবে। আমি যে ওষুধটা নিচ্ছি, তার কারণ, কেন নিবো, সাইড ইফেক্ট, ব্রান্ড নাম, জেনেরিক নাম সম্পর্কে আমার অবগত হওয়া উচিত।
স্বাস্থ্যসেবার মূল বিষয় মেডিসিন নিয়ে আমরা কাজ করি। “এই ঔষধ কেন খাবো” গ্রুপে ৬০ হাজার মেম্বার এবং সেখানে প্রতিদিন ১০০-১৫০ মানুষজন তাদের জরুরি অবস্থা, ঔষধ খাওয়ার পূর্বে জিজ্ঞাসা, সাইড ইফেক্ট, প্রেস্ক্রিপশন নিয়ে প্রশ্ন করে থাকেন।
আমাদের টিমে ডাক্তার ফার্মাসিস্ট আছেন তারা উত্তর দিয়ে সরাসরি সাহায্য করে থাকে। অর্থাৎ প্রতিদিন আমাদের ফেসবুক, ইউটিউব, টিকটিক মিলিয়ে প্রায় ৩ মিলিয়ন মানুষের কাছে আমরা পৌঁছে যাচ্ছি। তাই বলবো অবশ্যই আমরা স্বাস্থ্যসেবায় ভূমিকা রাখছি।
একটি ঘটনা দিয়ে উদাহরণ বলি, যা এখনো আমার চোখে ভাসে, আমাদের পেজে একজন আপু রাতে মেসেজ দেন। তার বাবার ওষুধ খাওয়ার সময় ভুলে তিনি একই ওষুধ দু’বার দিয়ে ফেলেন। এতে তিনি নিজেকে অপরাধী ভাবেন, ক্ষমা করতে পারছিলেন না। আমরা ঔষধের থেরাপিউটিক ইনডেক্সে কতটা কনসেন্ট্রেশনের উপরে টক্সিসিটি হতে পারে তা সার্চ করি। জানার পর আমরা তাঁকে বলি যে এই ওষুধ দু’বার খাওয়ানোতে কোনো সমস্যা হবে না। এই কথা শোনার পর আপু অনেক খুশি হয়। এইভাবে আমরা বিপদের সময় আমরা মানুষকে সাহায্য করি এবং তাদের দোয়া ভালোবাসা আমার কাছে অসম্ভব ভালো লাগে। এভাবেই আমরা আগামীতে স্বাস্থ্যসেবায় বড় পরিবর্তন আনবো।
YSSE: আপনার অনুপ্রেরণা কারা বা কি ছিলো ?
আমার অনুপ্রেরণা বলতে যখন কোভিডে আমি বাসায় ওষুধ নিয়ে কাজ করতাম তখন আমার আম্মুর কয়েকদিন ধরে সাইনাসে সমস্যা হচ্ছিলো, এলার্জি-সর্দি ছিলো এবং রক্তচাপও কিছুটা বেশি ছিলো। ডাক্তারের কাছে গেলে, ডাক্তার সমস্যা অনুযায়ী ওষুধ লিখে দেয়। আম্মু দুপুরে বাসায় এসে প্রেসক্রিপশনের লেখা দেখে একসাথে যে কয়টা ওষুধ ছিলো সবকয়টা খেয়ে নেয়। ওষুধ খাওয়ার ১৫-২০ মিনিটর পর দেখি আম্মুর সারা শরীর ঘেমে যাচ্ছে, মাথা ঘোরাচ্ছে, দাড়িয়ে থাকতে সমস্যা হচ্ছে! এমন অবস্থা দেখে আমি ভয়ে আম্মুকে জিজ্ঞেস করি কী হয়েছে! প্রেসক্রিপশন দেখার পর ঘটনা বুঝতে আমার আর বাকি রইলো না। আম্মুকে ডাক্তার রক্তচাপ কমানোর যে ওষুধ দিয়েছে সেটার সাথে অন্য একটা ওষুধ খাওয়াতে রক্তচাপ অনেক বেশি কমে গিয়েছিলো (hypotension)। এই ঘটনার মুল কারণ হচ্ছে Drug-drug interaction আবার রক্তচাপ কমানোর ওষুধেও এটা কমন একটা সাইড ইফেক্ট। এরপর দ্রুত আম্মুকে স্যালাইন খাওয়ালাম। কিছুক্ষণ পর আম্মু সুস্থ হয়। আমি সেদিন অনেক ভাবেছিলাম, যদি আমি পাশে না থাকতাম আজ কি হতো আমার আম্মুর!
আমার আম্মুর মতো বাংলাদেশে প্রতিদিন এমন ঘটনা অনেকের সাথে ঘটছে। কে করবে এই সমস্যার সমাধান?
যখব দেখবেন আপনার কাছের মানুষ কোনো সমস্যায় পড়েছে, আপনি মন থেকে তার সমাধান করতে চাইবেন। এভাবেই অনেক ইনোভেটিভ জিনিসের শুরু হয়। একারণেই এই ঘটনা আমাকে অনুপ্রেরণা দেয়, একজন ফার্মাসিস্ট হিসেবে আমার দায়িত্ব এই বিষয়ে কাজ করা।
শুরুর দিকে সবুজ পর্দায় ফোন, মাইক্রোফোন দিয়ে ভিডিও করতাম। বড় লাইট যা ব্যাকগ্রাউন্ড রিমুভ করে, ট্রাইপড এর বাজেট ছিলোনা। আমি বাঁশ, কাঠ পেঁচিয়ে স্ট্যান্ড বানিয়ে লাইট সেট করি যেখানে আমার বাবা, মা সাহায্য করেছে। ভিডিও করে বাবা-মা কে দেখাতাম। যা আমাকে অনুপ্রেরণা দিতো। এভাবেই মানুষের ভালোর জন্য কাজ করছি যেখানে আমার বাবা-মা থেকে যাত্রার শুরুটা হয়েছে।
বর্তমানে আমার স্ত্রী ফাতেমা আমাকে সাহস ও অনুপ্রেরণা দিচ্ছে, সে R&D টীম সামলাচ্ছে। আমাদের টীমের সাকিব, রিয়াজ এবং সকল ক্যাম্পাস রিপ্রেজেন্টেটিভ ও ভলেন্টিয়ার তারা পাশে আছে বলে অনেকদূর যাওয়ার স্বপ্ন দেখি।
সাক্ষাৎকারের ২য় পর্বে আমাদের অতিথির বাকি গল্প সম্পর্কে জানতে পারবেন। এবং আরো কিছু প্রশ্ন উত্তরের মাধ্যমে অতিথির অভিজ্ঞতা সম্পর্কে এবং তার কাজ জানতে পারবেন। পরবর্তী পর্ব মিস করবেন না।
ধন্যবাদ সবাইকে।
ফেসবুক:
https://www.facebook.com/clearconceptmed?mibextid=ZbWKwL
ফেসবুকগ্রুপ:
https://m.facebook.com/groups/meditalks?wtsid=rdr_09NwGrTaa9jGK2kyQ
ইউটিউব:
https://youtube.com/@clearconceptmed?si=iGPYBPKrPxPMKQT9
লেখক :
তৌহিদা
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
Youth School for Social Entrepreneurs (YSSE)