রমজান মাসের ১৫ তম দিন আজ।  ঘড়ির এলার্মের শব্দে মরিয়মের ঘুম ভাঙলো। গত ১৫ বছর ধরে মরিয়ম এই কাজটা করে যাচ্ছে;শেষ রাত্রে উঠে সবাইকে সেহরি খাওয়ার জন্য ডেকে দেয়া। পাশের  ঘরেই  মরিয়াম  এর অসুস্থ বাবা মা ঘুমাচ্ছে।  এখনো সেহরির অনেক সময় বাকি। খাবার গরম করতে করতে হঠাৎ সে খেয়াল করলো পাশের বাড়ির ছোট্ট স্টোর রুমের আলো এখনো জ্বলেনি । বেশ অবাক হয়ে খানিক্ষন  অপেক্ষা করে আবার  জানালা দিয়ে তাকালো ; কিন্তু না, আলো  এখনো জ্বলেনি। মরিয়াম এর মনটা খারাপ হয়ে গেলো। হঠাৎ খেয়াল করলো বাবা মা কে ডাকা হয়নি।  দৌড়ে গিয়ে তাদের ডেকে তুললো। সেহরি খাওয়া শেষ করে মরিয়াম এর মা ও  বেশ অবাক হয়ে খেয়াল করলেন আজ আলো জ্বলেনি । তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে নামাজে চলে গেলেন। 

পাঁচ বছর আগে  যখন মরিয়াম এর বাবা  বাড়ি নির্মাণ এর কাজ শুরু করেছিলেন, তখন প্রতিবেশীরা  প্রায়ই তাদের বলতো  “আফনাগো পাশে কিন্তু জ্বীনে ধরা রুগী থাকে’’ । আবার  কেউ বলতো “পাশের বাড়ি পাগল থাকে বুচ্ছেন? ঘুমাইবার পারবেন না , খালি চিল্লাইবো” এরকম নানান কথা। মরিয়ামরা  বাড়ি তে উঠার পর পাগল আর জ্বীনের রুগীর রহস্য পরিষ্কার হয়।

 মহিলার বয়স ৫৫ কি ৫৬ হবে, দুই ছেলে এক মেয়ে নিয়ে সংসার তাদের. স্বামী অনেক আগেই ক্যান্সার এ মারা গেছেন । সব কিছুই চলছিল ভালো মন্দ মিলিয়ে , হঠাৎ মহিলার ছোট ছেলের আকর্ষিক  মৃত্যু সব উলটপালট করে দেয়। মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন তিনি, আস্তে আস্তে ওনার অবস্থা এতটাই গুরুতর হয়,যে তিনি সারাক্ষণ বিলাপ আর চিৎকার করতেন। উনার বড় সন্তান একটা সময় ওনাকে বাড়ির শেষ মাথার সবচাইতে ছোট  রুমে ( স্টোর রুম) রাখার সিদ্ধান্ত নেন। এতে করে ওনার কান্নাকাটির বিলাপ পরিবারের বাকি সদস্যদের কম শুনতে হবে।  তিনি কিন্তু পাগল  নন, অত্যাধিক কষ্ট  আর যন্ত্রণা সইতে না পেরে মাঝে মাঝে ভারসাম্যহীন হয়ে যান। তবে একটা কাজ তিনি নিয়মিত করতেন, সেটা হলো দোয়া।  নিয়মিত রাত তিনটায় তিনি উঠতেন এবং তাহাজ্জুদের নামাজ পড়তেন।  ফজরের আজান  দেয়ার  আগ পর্যন্ত তিনি কান্না করতেন, দোয়া চাইতেন, বিলাপ করতেন।  গত পাঁচ বছর ধরে এভাবেই করে গেছেন । তিনি অসুস্থ হলেও কখনো  রাত জাগতে ভুল করতেন না, তার ছোট্ট সেই রুমে আলো জ্বলতো। কিন্তু আজ  আজান পার হয়ে গেলেও ওই ঘরে আলো জ্বলে নি। 

 

পরেরদিন সকাল ৮ টা নাগাদ কলিং বেল এর শব্দে মরিয়ম এর ঘুম ভাঙ্গে। একজন  প্রতিবেশী জানায় ,  সেই (তথাকথিত পাগল) মহিলা মারা গেছেন, খুব দ্রুত জানাজা পড়ানো হবে। মরিয়ামরা অবাক হয় নি , অনেক টা  বলা যায় নিশ্চিত ছিল এরকম কোন খবর শুনবে। 

 

এইদিকে মরিয়াম এর শরীরটা ভালো না,তার উপর সকালটাও শুরু হলো একটা মৃত্যু সংবাদ দিয়ে। ভীষণ মাথা ব্যথা থাকা সত্ত্বেও তড়িঘড়ি করে রেডি হলো কারণ তার বিশ্ববিদ্যালয় যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। কিন্তু কপাল খারাপ হলে যা হয়, কোন রিক্সা পাওয়া গেল না।  তাড়াহুড়ো করতে গিয়ে হোঁচট  খেয়ে পড়ল মেইন রোডের উপরে। কোনরকম বাসে উঠে বিশ্ববিদ্যালয়ে পৌঁছাতে পৌঁছাতে ক্লাস শুরু হয়ে গিয়েছিল। প্রচন্ড ক্লান্ত আর অসুস্থ মরিয়ম কেমন যেন বিষন্নতায় ডুবে গেল। যেই মেয়ে কোনদিন ক্লাস ফাঁকি দেয় না, আজ সে ঠিক করল ক্লাসে যাবে না।

করিডোর থেকে বের হয়ে,ক্যাম্পাস এর দোকানের দিকে যেতেই  হঠাৎ  ঝগড়াঝাটির আওয়াজ শুনতে পায় মরিয়াম ।  একটু এগিয়ে গিয়ে দেখে , টিনেইজ দুই বাচ্চা নিয়ে একজন মহিলা দাঁড়িয়ে আছে এবং তাকে কেন্দ্র করেই তর্ক বিতর্ক চলছে। মহিলা যে বহিরাগত সেটা দেখেই বোঝা যাচ্ছিল কিন্তু যারা উচ্চস্বরে ধমক দিচ্ছিল , তারা সবাই এই বিশ্ববিদ্যালয় এর ছাত্র-ছাত্রী। প্রায় ১০ থেকে ১৫ মিনিট তর্ক বিতর্ক চলার পর পরিস্থিতি  কিছুটা আক্রমণাত্মক হয়। শুরু থেকেই সব কিছু খেয়াল করছিলো মরিয়ম ,একটা সময় সে এগিয়ে যায় । সেদিন একমাত্র মরিয়াম  সেই মহিলার পক্ষ নিয়ে সবার সামনে দাঁড়ায়। 

 

বিকাল ৩ টা নাগাদ মরিয়াম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে  বাড়ি ফেরে । তবে আজকে তার মন ও মেজাজ ভয়ানক খারাপ। এসেই রুমের  দরজা বন্ধ করে শুয়ে পরে।  এই দিকে নীলু বেগম; মরিয়াম  এর আম্মা ডাকা শুরু করে, “মরিয়াম তাড়াতাড়ি কর! শুয়ে থাকিস না, আজকে কাজ বেশি তার ওপর আযান দিয়ে ফেলছে, ইফতার বানাতে হবে। জানিস ই  তো আমার শরীর ভালো না’’। অনিচ্ছা থাকা সত্ত্বেও মরিয়ম রুম থেকে বের হয় । অবাক হয়ে খেয়াল করল এখন পর্যন্ত সেই মহিলার দাফন  হয়নি!! তার বড় ছেলে নাকি এখনও বাসায় এসে পৌঁছায়নি।

খুব তাড়াহুড়ো করে ইফতার শেষ করল মরিয়াম। প্রচন্ড ক্লান্ত শরীর নিয়ে তার রুমে দরজা বন্ধ করে বসলো। কেমন যেন এক অস্থিরতায় দিন টা  সে পার করেছে। ড্রয়ার থেকে কালো মোটা ডাইরি টা বের করে টেবিলে  বসলো। অনেক পুরনো অভ্যাস এটা , যখন মন খারাপ থাকে মরিয়ম এর  তখন ডায়েরির পাতায় কষ্টগুলোকে জমা  রাখে সে ।  দীর্ঘশ্বাস ফেলে মরিয়ম লিখতে  শুরু করে ,

   

 ‘‘ আজ ১৫ তম রমজান।  আমার কেন যেন মনে হয়েছিল, আন্টির  হয়তো এটাই  শেষ রমজান। যখন উনার ঘরে লাইট বন্ধ দেখলাম তখন আমি নিশ্চিত ছিলাম উনি হয়তো চলে গেছেন না ফেরার দেশে।  কি ভীষণ একটা কষ্টের জীবন ছিল আন্টির ! শেষ পর্যন্ত তার আত্মা মুক্তি পেল।  উনি নিশ্চয়ই এবার ওনার সন্তানের সাথে দেখা করতে পারবেন। আচ্ছা, ওই খুনিরা কেমন আছে যারা সামান্য অজুহাতে আন্টির ছেলেটাকে মেরে ফেলেছিলো ? ওদের কি আদৌ কোন বিচার হয়েছে? 

 

অবশ্য আমি কিভাবে জানবো! আচ্ছা, মানুষ এত নিষ্ঠুর হয় কিভাবে? ১৭-১৮ বছরের একদল কিশোর কি করে তার সহপাঠী বন্ধুকে মেরে ফেলল? আচ্ছা তাদের বাবা- মা রাই বা কেমন, এরকম  খুনি সন্তানকে  নিয়ে  তারা কিভাবে  বাস করছে ? এই যে এতটা বছর আন্টি ঘুরে ঘুরে অনুনয়  বিনয় করে ছেলের লাশের সন্ধান  চেয়েছিল , দিল না কেন ? টাকার বিনিময় এ সব প্রমান মুছে দিলো? আসামিরা তো মামলাটা জিতেই গিয়েছিল, একবার বললে কি হতো, তার সন্তান কে কোথায় পুঁতে রেখেছে ? 

 

আহা! জীবন। সামান্য পিকনিকের আয়োজনের টাকা নিয়ে তর্ক, সেই তর্ক থেকে ঠান্ডা মাথায় একটা ছেলেকে পানিতে  ডুবিয়ে মারা, তারপর কাশ বনে লাশ পুঁতে  রাখা। এক অসহায় নিম্নবিত্ত মায়ের আহাজারি আর  কষ্ট । এরপর দুনিয়া থেকে চলেই গেলো সেই মা । আচ্ছা যারা  মিথ্যা সাক্ষী দিয়েছিলো তারা কেমন আছে , তারাও কি মানুষ !! তাদের ভিতরেও কি আত্মা আছে ! ওরা  কি জানে যে , তাদের ও দুনিয়া থেকে চলে যেতে হবে ? আচ্ছা , দুনিয়া কেন এত্ত নিষ্ঠুর ?? সব হারানোর পর  ও কেন মানুষ নামের প্রাণী গুলো এত্ত অপবাদ দিতো ? এই খুন, মিথ্যা অপবাদ এগুলোর বিনিময়ে কি পেলো তারা? কতটা  স্বার্থ ছিলো ,যা কিনা  একটা জীবনের বিনিময় এর সমতুল্য হতে পারে !”

 

ফোন কলের শব্দে মরিয়ম এর ভাবনায় ছেদ পড়লো। ডায়রি রেখে, ফোন হাতে নিয়ে তার মেজাজ  আরো খারাপ হলো। এক সহপাঠির কল ছিল ,সাথে অনেক  গুলো মেসেজ ও এসে জমা হয়েছে। একই বিষয় নিয়ে অনেক প্রশ্ন করেছে সহপাঠীরা। 

ওই যে ক্যাম্পাস এর তর্ক যুদ্ধে, মরিয়ম এর হত্তক্ষেপ, সবাই  বেশ অবাক হয়েছে । কৌতূহল এ সবার ঘুম হারাম। কিন্তু মরিয়ম  সিদ্ধান্ত নিলো আজ  সে  কাউকে এই বিষয়ে কোনো জবাব দিবে না।

 

প্রচন্ড বিরক্তি আর অবসাদ নিয়ে মরিয়াম…. (পার্ট-২)

স্টোরির বাকি পর্ব গুলো এবং আরো ব্লগ পড়ার জন্য এখানে ক্লিক  করুন। 

 

লেখিকা, 

জাকিয়া সুলতানা 

ইন্টার্ন ,

কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট

YSSE