প্রচন্ড বিরক্তি আর অবসাদ নিয়ে মরিয়াম শুয়ে পড়ে । তার অসমাপ্ত ভাবনা টুকু আর ডাইরির পাতায় তুলে রাখা হয় না । সেদিন বিশ্ববিদ্যালয়ে সেই তর্ক যুদ্ধে যে ভয়ানক অভিজ্ঞতা তার হয়েছিল সেই স্মৃতি সে আর মনে আন্তে চাইছে না। এসব ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়েছিল মারিয়াম । হঠাৎ মরিয়ম এর স্বপ্নে , লোপা নামের সেই কিশোরী মেয়েটা আসে । মরিয়ম দেখলো মেয়েটা কাঁদছে , আর মায়ের হাত ধরে বলে চলছে ‘আম্মা চলো ,প্লিজ আম্মা চলো, আমার ভয় লাগতেছে। ’
খট খট! দরজার করা নাড়ার শব্দে মরিয়ম এর ঘুম ভাঙে । নীলু বেগম বেশ রেগে আছেন কারণ আজকে সেহরিতে উঠতে দেরি হয়েছে , একদম সময় নাই সেহরির ।
সকাল পযন্ত সেই কান্না আর স্বপ্ন বার বার মনে পড়ছে মরিয়ম এর । সেদিন ভদ্র মহিলাকে ফোন নম্বর দিতে বলেছিলো মরিয়ম কিন্তু মহিলা না দিয়েই একদম নীরবে চলে গিয়েছিলো। খুব রাগ হচ্ছে মরিয়ম এর তার নিজের উপরেই। একটু জোর করে বললেই হয়তো নম্বর দিতো,তাহলে জানা যেত কেমন আছে তারা । এসব সাত পাঁচ ভেবে যখন রেডি হতে যাবে, তখন তার মনে পড়লো,
ধুর !! আজ তো শুক্রবার।
নীলু বেগম , সব দেখছিলেন রুম থেকে। তার মেয়ে গভীর বিষষন্নতায় ডুবে গেছে । নীলু বেগম তার মেয়ের বিষন্নতার গভীরতা জানেন , কিন্তু কী করবেন তিনি তা ভেবে পান না ।
আজ ১৭ তম রমজান । মরিয়ম এর জন্মদিন । ২৪ এ পা দিয়েছে মরিয়ম । এক ভাই ,এক বোন তারা। বড় ভাই নিজের সন্তানদের নিয়ে আলাদা থাকেন চাকরি করেন ,পুরো পরিবার এর আর্থিক অবস্থা দেখেন।ছোট এই পরিবারে এতো হতাশা আর বিষন্নতা ছিল না । মরিয়ম এর এই বিষণ্ণতার গল্প শুরু হয় বেশ কয়েক বছর আগে ।
বছর সাতেক আগের ঘটনা, মরিয়ম এর বাবা রোড এক্সিডেন্ট করেন। তিনি বেসরকারি একটি প্রতিষ্ঠানে এরিয়া ম্যানেজার হিসাবে কাজ করতেন। একরকম গুরুতর অসুস্থ হওয়ার কারণেই স্বেচ্ছায় অবসরে চলে যান। কিন্তু বিপত্তি বাধে যখন তার মাথায় সমস্যা দেখা দেয়। প্রচন্ড রকমের এঙ্গার ইস্যু ছিল তার বাবার। উন্মাদ মাতাল এর মতো করতেন আবার ঠিক হতেন।
অবসরে যাওয়ার পর মারিয়াম এর বাবার একটাই লক্ষ্য , সেটা হলো মরিয়ম এর বিয়ে। দুনিয়ার সবাই আসে প্রস্তাব নিয়ে। আবাল বৃদ্ধ , বনিতা , মূর্খ,নেশা খোর , পাচারকারী সবই আসে পাত্র হিসাবে। সবাই নিজেকে আদর্শ পাত্র হিসাবে বর্ণনা করেন। আর মরিয়ম বাবা মনে করেন ছেলে একটা হইলেই হলো। এত দেখার কি আছে । যে যা বলে , যা বুঝায় , তিনি তাই বিশ্বাস করেন। ওনার কাছে সব প্রস্তাব ই ভালো । উল্টা কেউ যদি সত্যতা তুলে ধরে , তার সাথে রাগারাগি করেন। সব মিলিয়ে বাড়ি টা কে একটা দোজোখ বানিয়ে রেখেছে মরিয়ম এর বাবা। মরিয়ম এর বিষণ্ণতার বড় কারণ এটা।
তার বাবার এই মানসিক অবস্থার সুযোগে প্রায় সবাই তাকে ভয়ানক বিরক্ত ও বিব্রত করে ।
খুব শান্ত আর ইন্ট্রোভার্ট স্বভাবের মেয়ে মরিয়ম । পড়াশোনার খাতিরে বন্ধু বান্ধব থাকলেও ব্যক্তিগত বিষয় বা মনভাব বিনিময় করার মতো কোনো বন্ধু হয় নি তার । নিজের ভিতরেই বিষন্নতা আর কষ্ট গুলো বয়ে বেড়ায় মরিয়ম।
চারপাশে ঘটে যাওয়া বিভিন্ন ঘটনা মরিয়ম এর বিষণ্ণতাকে দিন দিন আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। বিশেষ করে বিয়ের বিষয় আসলে এখন তার সেই ক্যাম্পাস এর ঘটনা ঘুরে ফিরে মনে আসে । সেদিন মরিয়ম এগিয়ে না গেলে হয়তো আরো অপমানিত হতেন সেই মহিলা তার সন্তানদের সামনে।
ঝগড়া শেষে মরিয়ম কথা বলেছিলো সেই মহিলার সাথে। জানতে পেরেছিল, মহিলাকে তার স্বামী ব্ল্যাকমেল করে যাচ্ছে অনেক দিন ধরে। পরকীয়ায় আসক্ত সেই ব্যাক্তি আত্মগোপনে , নানা ভাবে কৌশলে অনাচার করে যাচ্ছে। এখন সেটা তার সন্তানদের উপর ও খারাপ প্রভাব ফেলছে ।
কোনো উপায় না পেয়ে শেষ পযন্ত সেই পরোকিয়া প্রেমিকার খোঁজে এই বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। উদ্দেশ্য একটাই যেকোনো ভাবে স্বামীর সাথে যোগাযোগ করে বিষয়টা সমাধান করা।
মরিয়ম খুব অবাক হয়ে ভাবছিলো কতটা নিকৃষ্ট হলে নিজের সন্তান ও পরিবার কে এতটা জুলুম করতে পারে। মহিলার স্বামী টাকা আর জমি নিয়ে এতটাই জটিল অবস্থা তৈরি করে রেখেছে , যাতে ডিভোর্স দিলেও স্ত্রী ঝামেলা থেকে মুক্তি না পায় । সেদিন সেই প্রেমিকার পরিকল্পনাতে যখন মহিলাকে এমন হেনস্থা করা হচ্ছিলো , তখন মহিলার মেয়ে লোপা ভয়ে কাঁদছিলো , এই বুঝি তার মা কে কেউ আঘাত করে বসে! এই দৃশ্য দেখেই মরিয়ম এগিয়ে গিয়েছিলো পরিস্থিতি সামাল দিতে, তাকেও অনেক তর্ক করতে হয়েছিল ।
সেদিন পৃথিবীর হিসাব নিকাশ এর খাতায় কে লাভবান হয়েছিল জানি না ,তবে লোকসান এর খাতায় প্রথম সারিতে নাম লিখিয়েছিল মহিলার সন্তানেরা । নিজের বাবার সম্পর্কে কতটা ঘৃণা নিয়ে তারা ফিরে যাচ্ছিলো সেটা কেবল পৃথিবীই জানে।
আজ শনিবার। মরিয়ম এর মা হঠাৎ রুম এ এসে বললেন , আজ যেন সে কোথাও না যায়। মেহমান আসবে তাকে দেখতে। শুনেই মাথায় রক্ত উঠে গেলো মরিয়ম এর। আজকাল তার মাইগ্রেন এর ব্যথাটা বেড়েছে। এতটাই তীব্র আকার ধারণ করে সেই ব্যথা যে বমি আর খিঁচুনি শুরু হয়ে যায়। ওষুধ খেলেও আজকাল তার সেই ব্যাথা খুব একটা কমে না। মানসিক চাপ বাড়ার সাথে সাথে এই ব্যাথা ও বেড়ে যাচ্ছে দিন দিন।
প্রতিদিন ই কেউ না কেউ আসে দেখতে তাকে।তবে এদের কেউ স্বাভাবিক মানুষ না। সবাই মুখোশধারী ,ধোকাবাজ যা মরিয়ম এর বাবা ছাড়া সবাই বুঝতে পারে। রমজান মাস টাও বাদ গেলো না এসব থেকে। মেহমান চলে যাওয়ার পর মরিয়ম জানতে পারে তারা নাকি আবার আসবে , আংটি পরাতে। কী আজব! ছেলে কে তো মরিয়ম দেখলোই না,কেবল কোরবানির গরুর মত সেই দিন তার দৈর্ঘ প্রস্থ মাপা হয়েছিল। মরিয়ম এর বাবাই ছেলের বাড়িতে ছেলেকে দেখেছিলেন। সেইদিন বাড়ির কর্তার উপরে আর কেউ কথা বলেন নি। মরিয়ম সবার সাথে তর্ক করেছিল ,জানতে চেয়েছিলো তার কেন কোনো অধিকার নাই প্রশ্ন করার,কেন অধিকার নাই সব কিছু জানার!
মরিয়ম এর প্রচন্ড মাথা ব্যথা করছে। গা গুলিয়ে বমি আসছে। সারা জীবন মরিয়ম সবার কথা ভেবেছে সবাইকে কে আগলে রেখেসে, স্যাক্রিফাইস করেছে ,কিন্তু আজ তার প্রতিদান পাচ্ছে এভাবে। ভীষণ কষ্ট হচ্ছিলো মরিয়ম এর।সেদিন সে টের পেলো মানুষ হিসাবে তার কোনো অস্তিত্ব নেই এই পরিবারে। বমি করতে করতে খিঁচুনি উঠে মরিয়ম অজ্ঞান হয়ে যায়। মরিয়ম হালকা অচেতন অবস্থাতেও তার মায়ের কান্নার শব্দ পাচ্ছে।মরিয়ম এর নাক দিয়ে রক্ত পড়ছে। মরিয়ম এর অনেক স্মৃতি মনে পড়ছিলো। বেশি কিছু না , একটা স্বাভাবিক ছোট জীবন চেয়েছিলো, যেখানে থাকবে আত্মসম্মান। থাকবে না খুন, হিংসা,প্রতারণা। ব্যথা টা আরো তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। মরিয়ম এর স্মৃতিগুলো গভীর অন্ধকার এ তলিয়ে যাচ্ছে ।
নীলু বেগম ছেলে কে ফোন দিয়ে কেঁদে যাচ্ছেন ,কারণ তার মেয়ে আর কোনো শব্দ করছেনা একদম নিথর…..(পর্ব ৩)
গল্পের প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন
ব্লগ পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন
লেখিকা,
জাকিয়া সুলতানা
ইন্টার্ন ,
কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট। ( ব্যাচ ১০)
YSSE