নীলু বেগম ছেলে কে ফোন দিয়ে কেঁদে যাচ্ছেন ,কারণ তার মেয়ে আর কোনো শব্দ করছেনা একদম নিথর ঠান্ডা হয়ে গেছে শরীর টা।
মরিয়াম এর জ্ঞান ফিরেছে । হসপিটালের ছোট্টো কেবিন টাতে মরিয়াম শুয়ে আছে । আবছা আলোয় ঝাপসা চোখে মরিয়াম অবাক হয়ে কি যেন দেখছে ।
“ আরে দাদা! তুমি এখানে কেমনে আসলা ? কখন আসছো? আমারে এবার সাথে নিয়ে যাইয়ো !’’
বিড় বিড় করে বলে যাচ্ছে ,মরিয়াম।
মরিয়াম , এগুলা কি বলিস তুই? এই মরিয়াম’’ মরিয়াম এর মা , মরিয়াম এর বিড় বিড় করা দেখে , তাকে ডাকছে। নীলু বেগম তাড়াতাড়ি ফোন দিয়ে ছেলে কে জানায় যে, মেয়ের জ্ঞান ফিরেছে। ডাক্তার ও আসলেন , দেখে গেলেন ,এবং সাবধান করে গেলেন যেন রুগীর সাথে বেশি কথা বলা না হয়।
মরিয়ম চোখ বন্ধ করে ঘুম এর ভান করে শুয়ে আছে হাসপাতালের বেড এ। বেডের একপাশে নীলু বেগম ফোন এ খুব মৃদু স্বরে কথা বলছেন । চাপা কণ্ঠে বলে যাচ্ছেন, “মেয়ে টাকে এবার বাঁচতে দেন, আল্লাহর ওয়াস্তে । আর কোনো দিন ওর মতের বিরুদ্ধে এসব কইরেন না। আমি ওরে নিয়ে বাসা থেকে চলে যাবো দরকার হলে।”
ওপর প্রান্ত থেকে বাবার ঝাঁঝালো কণ্ঠ মারিয়াম শুনতে পাচ্ছে, ‘এই অভিশাপ আর বাসায় আনার দরকার নাই, আমার লাখ লাখ টাকা নষ্ট করলো এই দুই দিনে । বয়স হয়ে গেছে , মানুষ কি বলবে বিয়ে না দিলে। এটা আমার জন্য অভিশাপ হয়ে গেছে’ । নীলু বেগম ফোন টা রেখে দিলো ।
মরিয়াম ভাবছে,উফফ! মরে গেলাম না কেন খোদা! আবার সেই দোযখে যেতে হবে । কত দিন সহ্য করতে হবে এসব?
হঠাৎ মরিয়াম এর দাদার কথা মনে পড়লো। খুব ছোট থাকতেই দাদা মারা যায় মরিয়াম এর , তবে ভীষণ ভালোবাসতেন মরিয়াম কে । আজ ও মরিয়ম এর কাছে দাদাই শ্ৰেষ্ঠ মানুষ যে তাকে সবচেয়ে আদর ও যত্ন করেছে । প্রায় ই মরিয়ম এর কল্পনা তে তার দাদা চলে আসে তাকে শান্তনা দিতে। কল্পনাতে কত বার যে, দাদার কাছে সেই ছোট বেলার মতো বায়না ধরেছে তাকে যেন সাথে নিয়ে যায় দাদাবাড়ি !
হাজারো এলোমেলো চিন্তা মাথায় ঘুরে পাক খাচ্ছে মরিয়ামের । ঘুমে আবার তলিয়ে যাচ্ছে সব ভাবনা গুলো ।
মরিয়ম কে বাসায় নিয়ে আসা হয়েছে । শুরু হয়েছে নতুন যন্ত্রনা। সবার জিজ্ঞাসা, ‘মেয়ে কি আত্মহত্যা করতে গেয়েছিলো?’ আর পুরানো সেই ঘটক এখনো হাল ছাড়েন নি । খোঁজ নিয়ে যাচ্ছেন কবে আবার নতুন ফাঁদ পাতা যাবে ।
মরিয়ম এর পড়াশুনা এখনো শেষ হয় নি, শেষ বর্ষ চলছে । অনেক বার ভেবেছে ; চাকরি করা যায় কিনা । কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ম মেনে করা যায় সেরকম কোনো সুযোগ পায় নি এখনো । একবার চেষ্টা করসিলো পার্ট টাইম চাকরি করার , কিন্তু এক মাস পর কো অর্ডিনেটর কড়া নোটিশ দেয় এই বলে যে, ক্লাস এর অনুপস্থিতির মাত্রা বেড়ে গেলে পরীক্ষার অনুমতি মিলবে না। বাধ্য হয়ে ছাড়তে হয়েছিল সেই সামান্য বেতনের চাকরি।
আবার কলিং বেল এর শব্দ শুনতে পেলো মরিয়াম । যা ভেবেছিলো মরিয়াম ; দোজখের হাবিলদার , তথাকথিত সমাজসেবক , ঘটক সাহেব !
ঘটক : “ভাইসাব!! খুশির খবর নিয়া আসছি । ওই ছেলের মা তো পাগল হইয়া গেছে । কবে পোলার বৌ এর মুখ দেকবে !! ওরা আইজকা বিকালে আইতে চাইতাছে । দেহেন; ঘরের মাইনষের সাথে তাল মিলায়া আবার ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েন না ।”
মরিয়াম এর বাবা : কিন্তু ভাই , বুঝলাম না সবাই যে বলে, ছেলে নাকি নেশা করে ,মদ খায়! বাসায় মারামারি করে!
ঘটক : কেডা কৈছে? নামডা কন । সে কি নিজের চোখে দেখছে?শোনেন, শোনা কোথায় কান দিয়েন না। কেউ কারো ভালা দেখতে চায় না ; বুঝছেন!! আইজকা আসুক ,কথা কন ।
মারিয়াম এর বাবা : ভাই , শোনেন! এখন রমজান মাস ,কয়টা দিন পর ঈদ । তারপর আবার এই ঝামেলা হইলো । ঈদ এর পর আসতে বলেন । আমার শরীর, মন কোনোটাই ভালো না ।।
খুব হতাশ হয়ে ঘটক সাহেব বিদায় নিলেন।।
দরজার ওপর পাশ থেকে সব শুনছিলো মারিয়াম । কিছুটা হাফ ছেড়ে বাঁচলো; অন্তত কয়টা দিন শান্তি মিলবে ।।
ঈদের দিনটা আর আগের মতো আনন্দ ঘন মনে হয়না মারিয়াম এর । কেমন যেন বিষাদময় হয়ে গেছে । ঠিক কবে দুনিয়ার সবার মতো আনন্দ করে ঈদ পালন করেছিল সেই স্মৃতি গুলো ও ঝাপসা হয়ে গেছে । একটা সময় মরিয়াম ভাবতো, বড় হলেই জীবনের সব সমস্যা শেষ হয়ে যাবে । কাউকে কৈফিয়ত দিতে হবে না , নিজের সহ সবার দায়িত্ব নিতে পারবে । কত বোকা চিন্তা ভাবনা ছিল এসব। মরিয়াম বিষন্ন মনে ভাবতে ভাবতে ভাবনার সাগরে ডুবে যাচ্ছে……
হঠাৎ ফোন কল বেজে উঠলো ! ফোনের শব্দে মারিয়াম এর তন্দ্রা ভাঙলো। অপরিচিত নম্বর। দেখতে দেখতে কল টা কেটে গেলো। মারিয়াম আর জীবনের প্রতি কোনো আগ্রহ অনুভব করে না। জীবনের খাতা থেকে একের পর এক বিষাদময় দিন চলে যাচ্ছে ।
আবার ফোন বেজে উঠলো সেই একই নম্বর থেকে , কিছু না ভেবেই কল টা রিসিভ করলো মরিয়াম । মিনিট পাঁচেক কথা হলো মারিয়াম এর । কেমন যেন একটা খুশির আমেজ তার মনের ভিতর ঢেউ খেলে গেলো। ঠিক যেন নির্জন দ্বীপে আটকে পড়া একটা জীবন, দূর সাগরে ভেসে উঠা কোনো নৌকা দেখতে পেয়েছে।
বছর খানেক আগে যখন পার্ট টাইম জব ছেড়ে যাচ্ছিলো মারিয়াম, তখন তার একজন সিনিয়র কলিগ তাকে বলেছিলো যোগাযোগ রাখতে যদি কখনো প্রয়োজন পরে যেন তাকে কল দেয়া হয় । মরিয়াম হাসপাতাল থেকে ফিরে অনেকবার সেই আপু কে ফোন দিয়েছিল কিন্তু রিসিভ করে নি কেউ । আজকে হঠাৎ নতুন নম্বর থেকে সেই আপু ফোন দিয়েছিলো । তিনি মারিয়াম এর অবস্থা কিছু টা জানতেন। তিনি মারিয়াম কে একটি ছোট্ট পার্ট টাইম কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন তার অফিসে ,তার রুম মেট হিসাবে থাকার সুযোগ টাও দিয়েছেন। বাকি টা মারিয়াম এর বিবেচনা আর সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দিলেন ।
আপাতত মারিয়াম এর আর পিছনে ফিরে তাকানোর সময় নাই , তাকে পড়াশোনা শেষ করতে হবে , সুস্থ থাকতে হবে । জলদি সেই আপুকে ফোন দিয়ে জানালো সে আপুর প্রস্তাব এ রাজি । চলে আসবে আপুর বাড়িতে রুম মেট হিসাবে ।
দিন যায় , সময় বদলায়। কিছু মানুষের জীবন খুব একটা বদলায় না । তাদের শিখতে হয় শুধু, বদলে যাওয়া সময়ের সাথে টিকে থাকা।কারো জীবনে আবার টিকের থাকার সুযোগ ও আসে না , কিন্তু মরিয়াম এর একটা সুযোগ পেয়েছে । এক মুহূর্তের জন্য নিশ্বাস নেয়ার সুযোগ। জীবন যুদ্ধে প্রস্তুতি নেয়ার সুযোগ।
বেঁচে থাকলে হয়তো সময় বদলাবে, আবার সেই ছোটবেলার বাবার আদর ফিরে পাবে। সমাজের শকুন গুলো ও বিলুপ্ত হবে । অন্তত শুরু হোক একটা নতুন সুন্দর দিনের ।
গল্পের প্রথম পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন,
গল্পের দ্বিতীয় পর্ব পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
ব্লগ পড়ার জন্য এখানে ক্লিক করুন
লেখিকা,
জাকিয়া সুলতানা
ইন্টার্ন ,
কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট। ( ব্যাচ ১০)
YSSE