শিক্ষাকে বলা হয় একটি জাতির মেরুদণ্ড। দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতির মাপকাঠি ধরা হয় শিক্ষাকে। দেশকে এগিয়ে নিতে হলে নাগরিকদের অবশ্যই সাক্ষর হওয়া প্রয়োজন। যে ব্যক্তি পড়তে এবং লিখতে সক্ষম তাকে বলা হয় সাক্ষর।
সাক্ষরতার গুরুত্ব সম্পর্কে মানুষকে সচেতন করতে এবং শিক্ষা গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করতে ১৯৬৬ সালের ২৬ অক্টোবর ইউনেস্কোর সাধারণ সম্মেলনের ১৪ তম অধিবেশনে ৮ ই সেপ্টেম্বরকে আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস ঘোষণা করা হয়। ১৯৬৭ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রতি বছর জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্র এই দিবসটি উদযাপন করে আসছে। কিন্তু কেন ইউনেস্কো সাক্ষরতা দিবস নামে এই বিশেষ দিবসটি পালনের সিদ্ধান্ত নেয়?
ষাটের দশকে বিশ্বব্যাপী শিক্ষা প্রসার লাভ করলেও অধিকাংশ অঞ্চলের মানুষ ছিল অক্ষরজ্ঞানহীন। বিশেষত কম উন্নত বা উন্নয়নশীল অঞ্চলের মানুষদের একটি বড় অংশের পড়তে এবং লিখতে পারার প্রাথমিক ধারণাটুকুও ছিল না। যা সমাজের অগ্রগতির ক্ষেত্রে একটি বড় বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এই সমস্যা ইউনেস্কোর নজরে এলে, বিশ্বব্যাপী সাক্ষরতা বৃদ্ধি এবং একে মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে চিহ্নিত করে সচেতনতা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে বিভিন্ন পদক্ষেপের একটি হলো সাক্ষরতা দিবস পালন।
আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ইউনেস্কো সামাজিক ন্যায়বিচারকে গুরুত্ব দিয়ে এমন ধারণা প্রচার করে যে, প্রতিটি ব্যক্তির শিক্ষা ও সাক্ষরতার অধিকার রয়েছে, তাদের পটভূমি বা পারিপার্শ্বিক অবস্থা ব্যতিরেকে। সাক্ষরতা দিবসকে কেন্দ্র করে বৈশ্বিক সচেতনতা সৃষ্টি এবং বিভিন্ন এডুকেশনাল ক্যাম্পেইন এর মতো পদক্ষেপ নিতে থাকে ইউনেস্কো যার ফলে বিশ্বের সাক্ষরতার হারও উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেতে থাকে।
ইউনেস্কোর প্রদত্ত ডেটা অনুসারে, ১৯৫০ সালে বৈশ্বিক সাক্ষরতার হার ৫৫ শতাংশ থেকে বৃদ্ধি পেয়ে ২০০০ সালে দাঁড়ায় ৮৬ শতাংশে। যা সাক্ষরতা প্রোগ্রাম এবং শিক্ষা সংস্কারের সফল বাস্তবায়নকে প্রতিফলিত করে। দক্ষিণ – এশীয় এবং আফ্রিকার সাব-সাহারান অঞ্চলগুলোতে সাক্ষরতার হার উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে।
প্রতিবছর সাক্ষরতা দিবসকে ঘিরে ইউনেস্কো বিভিন্ন উদ্যোগ ও কর্মকাণ্ড বাস্তবায়ন করে, এগুলোর মধ্যে আছে –
১. থিম নির্ধারণ ও প্রচারণা
প্রতি বছর, ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসের জন্য একটি বিশেষ থিম নির্ধারণ করে। এই থিমটি সাধারণত সেই বছরের বিশেষ প্রাসঙ্গিক বিষয়ে কেন্দ্রিত থাকে এবং সাক্ষরতার বিভিন্ন দিক এবং চ্যালেঞ্জগুলি তুলে ধরে। থিমটি বিভিন্ন প্রচারমূলক উপকরণ, ক্যাম্পেইন, এবং মিডিয়া কভারেজের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ২০২৩ সালের থিম ছিল “ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষার ডিজিটাল রূপ” যা ডিজিটাল শিক্ষা ও প্রযুক্তির গুরুত্বকে সামনে এনেছে।
আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস ২০২৪ – এর থিম – “বহুভাষিক শিক্ষার প্রচার: পারস্পরিক বোঝাপড়া ও শান্তির জন্য সাক্ষরতা”। যা বহুভাষিক শিক্ষার গুরুত্ব এবং কিভাবে এটি পারস্পরিক বোঝাপড়া ও শান্তি প্রতিষ্ঠায় অবদান রাখতে পারে তা তুলে ধরে।
২. বিশ্বব্যাপী ইভেন্ট ও সেমিনার
ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস উপলক্ষে বিভিন্ন ধরনের ইভেন্ট, সেমিনার, ওয়ার্কশপ এবং কনফারেন্স আয়োজন করে। এই ইভেন্টগুলোতে বিভিন্ন দেশের শিক্ষাবিদ, নীতিনির্ধারক, গবেষক, এবং সমাজসেবকরা অংশগ্রহণ করে এবং সাক্ষরতা উন্নয়নের জন্য নতুন পরিকল্পনা ও কৌশল নিয়ে আলোচনা করেন।
৩. সম্মাননা ও পুরস্কার
প্রতি বছর ইউনেস্কো আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবসে বিশেষ কিছু পুরস্কার প্রদান করে, যা ‘ইউনেস্কো সাক্ষরতা পুরস্কার’ নামে পরিচিত। এই পুরস্কারগুলো ব্যক্তি বা সংগঠনকে দেওয়া হয় যারা সাক্ষরতা ক্ষেত্রের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছে। এই পুরস্কার সাক্ষরতার ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখা কাজ এবং উদ্ভাবনী উদ্যোগগুলোর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে এবং অন্যদেরকেও অনুপ্রাণিত করে।
৪. সচেতনতা বৃদ্ধির ক্যাম্পেইন
ইউনেস্কো সামাজিক মিডিয়া, টেলিভিশন, রেডিও এবং অন্যান্য প্রচার মাধ্যমের মাধ্যমে সাক্ষরতার গুরুত্ব নিয়ে ক্যাম্পেইন চালায়। এসব ক্যাম্পেইন তথ্যপূর্ণ কনটেন্ট, গ্রাফিকস, ভিডিও এবং পোস্টারের মাধ্যমে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করে। এগুলোর লক্ষ্য হল সাক্ষরতার সুবিধা, প্রয়োজনীয়তা এবং সাফল্য সম্পর্কে জনসাধারণকে আরো অবহিত করা।
৫. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও অংশীদারিত্ব
ইউনেস্কো বিভিন্ন আন্তর্জাতিক অংশীদারদের সাথে সহযোগিতা করে এই দিবসটি উদযাপন করে। আন্তর্জাতিক সংস্থা, সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান এবং শিক্ষা সংস্থাগুলোর সঙ্গে যৌথভাবে উদ্যোগ গ্রহণ করে সাক্ষরতা উন্নয়নের জন্য নানা প্রকল্প ও কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়।
৬. গবেষণা ও প্রতিবেদন প্রকাশ
ইউনেস্কো এই দিবসে সাক্ষরতা সম্পর্কিত নতুন গবেষণা ও প্রতিবেদন প্রকাশ করে, যা সাক্ষরতার বর্তমান অবস্থান, চ্যালেঞ্জ এবং ভবিষ্যত লক্ষ্যের উপর আলোকপাত করে। এসব প্রতিবেদন নীতিনির্ধারকদের জন্য মূল্যবান তথ্য সরবরাহ করে এবং সাক্ষরতা সম্পর্কিত নতুন নীতিমালা ও কৌশল উন্নয়নের জন্য সহায়ক ভূমিকা পালন করে।
আন্তর্জাতিক সাক্ষরতা দিবস কেবল একটি প্রতীকী দিবস নয়; এটি বিশ্বের সাক্ষরতার অগ্রগতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম। সচেতনতা বৃদ্ধি, বৈশ্বিক বৈষম্য তুলে ধরা, সাফল্য উদযাপন, পদক্ষেপ ও প্রতিশ্রুতি উৎসাহিত করা এবং জীবনের প্রতিটি পর্যায়ে শিক্ষা প্রচারের মাধ্যমে এই দিবসটি শিক্ষা ও সাক্ষরতার উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করে। যার ফলে বৈশ্বিক শিক্ষা ও সাক্ষরতার ক্ষেত্রে সাধিত হচ্ছে বিপ্লব।
এ ধরনের আরও ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন
লেখক,
ঋষি বিশ্বাস
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE