‘আরণ্যক’ বাংলা সাহিত্যের বিখ্যাত কথাসাহিত্যিক বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় (১৮৯৪-১৯৫০) রচিত চতুর্থ উপন্যাস। উপন্যাসটি ১৯৩৯ সালে গ্রন্থাকারে প্রকাশিত হয়। বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় বিহারে তাঁর কর্মজীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে উপন্যাসটি রচনা করেন। এমন কিছু বই আছে যেগুলো আমাদের জীবনে গভীরভাবে প্রভাব ফেলে, জীবনরস-সাহিত্যরসের সুরা পান করতে দেয়। ‘আরণ্যক’ তেমনি একটি উপন্যাস।
গভীর রহস্যময় অরণ্য,বিচিত্র নর নারীর সমাবেশ আর অচেনা অজানা কিন্তু এক বাস্তব জগতের গল্পগাঁথা– এই সব মিলিয়েই ‘আরণ্যক’ উপন্যাসের বিষয়বস্তু।অসংখ্য চরিত্রের সমাবেশ, তবু সব কিছু ছাপিয়ে অরণ্যই এর একমাত্র কেন্দ্রীয় চরিত্র।উপন্যাসটি লেখা হয়েছে উত্তম পুরুষে। কলকাতার শিক্ষিত যুবক সত্যচরণ। বেকার জীবনে এক বন্ধুর জমিদার বাবার জঙ্গল মহালে ম্যানেজারের চাকরি পায়। তরুণ বয়সে কলকাতার জৌলুষ ছেড়ে তিনি ঘন অরণ্যে চলে যান জীবিকার তাগিদে। সেখানে তিনি মুখোমুখি হন এক ভিন্ন পরিবেশের। যেখানে সাধারণ মানুষের বসবাস অসম্ভব। সেখানেই জঙ্গল পরিষ্কার করে ফসল উৎপাদন আর খাজনা আদায় করাই তাঁর কাজ। সেখানের বিভিন্ন ঘটনা, অভিজ্ঞতা, সেখানকার মানুষের জীবনযাপনের ধরণ তাঁর হৃদয়কে নাড়া দেয় বারবার। একসময় কলকাতায় ফিরে এলেও সেই বিচিত্র অভিজ্ঞতা রয়ে যায় তাঁর মনের অভ্যন্তরে। কলকাতায় ফিরে সেই অভিজ্ঞতার স্মৃতিচারণই হলো ‘আরণ্যক’।
এই উপন্যাসটি জুড়ে রয়েছে জঙ্গল জীবনের অভিজ্ঞতা এবং জীবনকে ঘিরে একরাশ মুগ্ধতা। একজন শহুরে মানুষ সে গভীর শুনশান অরণ্যে সহজভাবে বিশ্বাস করেন এই অঞ্চলের মানুষের লৌকিক ও অলৌকিক গল্পগুলিকে। অনেক জায়গায় এই মুগ্ধতা অলৌকিকতা তৈরি করে। খানিকটা উপন্যাসের খাতিরে পাঠকের কথা মাথায় রেখে তিনি তাকে গল্পের অংশ করে নেন। যেমন বন্য মহিষের দেবতা ‘টাড়বাড়ো’র কথা, একজন মহিলার রূপ বদলে কখনো ‘কুকুর’-এ পরিণত হওয়ার কথা বা রাতে জঙ্গলের মধ্যে হ্রদ ‘সরস্বতী কূণ্ডী’র কাছে পরীদের স্নান করার ঘটনা।
আষাঢ় মাসে ‘পুণ্যাহ ‘নামক এক অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়। এইদিন জমিদারেরা প্রজাদের কাছ থেকে নতুন বৎসরের জন্য খাজনা আদায় শুরু করেন। অতি দরিদ্র নিম্নবর্ণের মানুষেরা সামান্য চীনাদানা, গুড় এবং পাতলা জলের মত টক দই খাওয়ার জন্য যেভাবে উঠোনে বসে প্রবল বৃষ্টিতে ভিজল তা দেখে, সত্যচরণ দুঃখ পায়। এত গরিব দেশ এবং গরিব মানুষ যে থাকতে পারে তা তার জানা ছিল না। এদের প্রতি গভীর সমতা নিয়েই সে একদিন এই দরিদ্র মানুষগুলিকে নিমন্ত্রণ করে নানা সুখাদ্য পরিবেশন করায়। জীবনের সেরকম ভোজ খাওয়ার কথা তারা কল্পনাও করেনি।
সেই এলাকার প্রতাপশালী দেবী সিং রাজপুতের বিধবা স্ত্রী কুন্তার দুর্দশার কথা পাটোয়ারি তাকে জানায়। একদা যে চরম ভোগ-বিলাসের মধ্যে দিন কাটিয়েছে, সে এখন রাতের অন্ধকারে ম্যানেজারবাবুর পাতের এঁটো ভাত নেবার জন্য অধীর আগ্রহে দাঁড়িয়ে থাকে। ছেলেমেয়েদের জন্য লুকিয়ে ফুল চুরি করতে গিয়ে ইজারাদারের লোকজনের হাতে মার খায়। আবার প্রকৃতিও ক্রমশ সত্যচরণকে হাতছানি দেয়। বুনো মহিষের ভয় কাটিয়ে সে ঘোড়ায় চড়ে জঙ্গলের সৌন্দর্য আবিষ্কার করতে থাকে,গ্রাম্য মেলায় গিয়ে সেখানকার জনজীবন ও লোকসংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হতে থাকে। আবার এই মেলাতেই গিরিধারীলালের মতো ভালো মানুষের দেখাও সে পায়।
প্রকৃতির এরকম সৌন্দর্যও তার চোখে আগে ধরা পড়েনি,তেমনই যুগলপ্রসাদের মতো মানুষও সে আগে আর দেখেনি । নিজের পরিশ্রম এবং অর্থব্যয় করে যে সরস্বতী তুর্কীর চারধারে নানা দুষ্প্রাপ্য ফুলের গাছ বসিয়ে যাচ্ছে । সত্যচরণ সরস্বতী কূন্ডকে সুন্দর করার কাজে উৎসাহ দেয়।
জমি জরিপের কাজে প্রচন্ড শীতের মধ্যেও সত্যচরণকে জঙ্গলে তাঁবু খাটিয়ে থাকতে হয়।সেখানে কর্মচারীদের সঙ্গে তার যেমন ঘনিষ্ঠতা হয়েছে,তেমনই জঙ্গলের দরিদ্রতম অধিবাসীদের জীবনযাত্রা দেখে সে আহত হয় । ফসল উঠে যাওয়ার পর ফুলবিয়া বইহারের চেহারা পালটে যায়, বাইরে থেকে ব্যবসায়ীরা মাল কিনতে আসে । তাদের সঙ্গে সঙ্গে আসে নানা দোকানদার ও ফেরিওয়ালা। রং-তামাশা দেখানো লোকেরাও এসে ভিড় জমায় । সকলেরই দুপয়সা রোজগারের সময় তখন।এখানে নগদ পয়সার ব্যাপার বেশি নেই । ফসলের বিনিময়ে ফেরিওয়ালারা দরিদ্র মানুষের কাছে জিনিস বিক্রি করে এবং তাদের মারাত্মকভাবে ঠকায় । এখানেই আবার বৃদ্ধ নট দশরথের দেখা মেলে । আবার নক্ছেদীর বালিকা বধূর মধ্যে সত্যচরণ এক চিরন্তন নারীর সন্ধান পায় । সাঁওতাল রাজা ও তার পরিবারের সঙ্গে পরিচিত হওয়াটা ছিল সত্যচরণের অরণ্যজীবনের সবচেয়ে বড় পাওয়া। এই রাজবংশই এই অঞ্চলের প্রকৃত মালিক । তারা বীর এবং স্বাধীনতা সংগ্রামী । এদেরই পূর্বপুরুষেরা মোগল সৈন্যদের সঙ্গে লড়েছে , সাঁওতাল বিদ্রোহের সময় ব্রিটিশ বাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধ করেছে । সাঁওতাল বিদ্রোহের অন্যতম নেতা এখন অতিবৃদ্ধ এবং খুবই গরিব । তিনি এখন সপরিবারে খোলার চালের বাড়ির বাসিন্দা , গোরু – মহিষ চরানোই এখন তাঁদের জীবিকা । তবুও এই এলাকার বাসিন্দারা তাঁকে এখনো রাজার সম্মান দেয় । সত্যচরণও তাকে তার প্রাপ্য মর্যাদা দিয়েছে । তবে রাজার নাতির মেয়ে ভানুমতীই সত্যচরণকে মুগ্ধ করেছিল বেশি । আবার প্রাচীন রাজবংশের সমাধিস্থলে দাঁড়িয়ে সত্যচরণ এক নিষ্ঠুর ঐতিহাসিক সত্যের মুখোমুখি দাঁড়ায় ।
উপন্যাসের শেষে দেখা যায় সত্যচরণকে এই জমিদারির অধীন জমিগুলি বিক্রির বন্দোবস্ত করতে হচ্ছে, কিন্তু এই কাজটি তার মতো জঙ্গলের সৌন্দর্যে মুগ্ধ মানুষের পক্ষে করা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায় একজন প্রকৃতিপ্রেমী মানুষ ছিলেন। তিনি এক সৌন্দর্যে ভরা প্রকৃতির মধ্যে মানুষের বিচিত্র অবস্থান ও সম্পর্ক দেখাতে চেয়েছিলেন। এটিই এই উপন্যাসের মূল দর্শন।
এরকম আরও ব্লগ পড়তে ক্লিক করুন
লেখিকা,
নুপুর আক্তার
ইন্টার্ন
কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE