“একটি জাতির ভবিষ্যৎ কেমন হবে, তা নির্ভর করে তার শিক্ষাব্যবস্থার ওপর। কিন্তু আমাদের শিক্ষা কি সত্যিই ভবিষ্যৎ গড়তে পারছে, নাকি শুধু সার্টিফিকেট তৈরির কারখানায় পরিণত হয়েছে?”
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা যেন এক রহস্যময় দ্বীপ—একদিকে অগ্রগতির আলো, অন্যদিকে হতাশার অন্ধকার। একদিকে ডিজিটাল শিক্ষা, আধুনিক পাঠ্যক্রম, বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যাগত বৃদ্ধি; অন্যদিকে দক্ষতাহীন গ্র্যাজুয়েট, কোচিং নির্ভরতা, বেকারত্বের দীর্ঘ সারি। প্রশ্ন হলো, এই শিক্ষাব্যবস্থা কি আমাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়তে পারবে, নাকি আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠী হবে কেবল একটি পরিসংখ্যান?
আলো: শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতির দ্যুতি
১. শিক্ষার হার বৃদ্ধি ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন
স্বাধীনতার পর শিক্ষার হার ছিল মাত্র ১৬.৮%, যা এখন বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৭৫.৬% (২০২৩ সালের হিসাব অনুযায়ী)। শহর থেকে গ্রাম—প্রতিটি জায়গায় স্কুল-কলেজ গড়ে উঠেছে। শিক্ষার জন্য উপবৃত্তি, বিনামূল্যে বই বিতরণ, স্কুল ফিডিং প্রোগ্রাম—এসব পদক্ষেপ শিক্ষাক্ষেত্রে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে।
২. ডিজিটাল শিক্ষা ও প্রযুক্তির ব্যবহার
আজকের শিক্ষার্থীরা শুধু ব্ল্যাকবোর্ড বা খাতায় আটকে নেই। অনলাইন ক্লাস, ভার্চুয়াল লাইব্রেরি, ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম—এসব প্রযুক্তি শিক্ষার দিগন্ত খুলে দিয়েছে। এখন একজন শিক্ষার্থী ঢাকা বা বরিশালে বসে বিদেশি কোর্স করতে পারছে, যা একসময় ছিল কল্পনাতীত।
৩. নারীশিক্ষায় বিপ্লব
একসময় মেয়েদের স্কুলে যাওয়া ছিল স্বপ্নের মতো। কিন্তু এখন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে ছাত্রীদের সংখ্যা ছাত্রদের চেয়েও বেশি! সরকারি ও বেসরকারি উদ্যোগে নারীশিক্ষা, বৃত্তি, নারী উদ্যোক্তা গড়ার প্রচেষ্টা প্রশংসার দাবিদার।
৪. বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষার প্রসার
১৯৭১ সালে দেশে মাত্র ৬টি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল, এখন আছে ১৬৫টিরও বেশি! বিভিন্ন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় উচ্চশিক্ষার সুযোগ বাড়িয়েছে, যা একসময়ের অভাবনীয় অগ্রগতি। কিন্তু এই আলো যতই উজ্জ্বল হোক, তার বিপরীতে আছে এক গভীর অন্ধকার—যা আমাদের পুরো শিক্ষাব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে!
অন্ধকার: শিক্ষাব্যবস্থার কঠিন বাস্তবতা
১. ডিগ্রি আছে, দক্ষতা নেই!
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো থেকে প্রতিবছর লাখ লাখ শিক্ষার্থী স্নাতক হয়ে বের হচ্ছে, কিন্তু চাকরির বাজারে যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যাচ্ছে না। কেন? কারণ আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা প্রতিযোগিতা শেখায়, কিন্তু দক্ষতা শেখায় না। তাত্ত্বিক জ্ঞানে গা ভাসিয়ে আমরা সৃজনশীলতা ও সমালোচনামূলক চিন্তাধারা হারিয়ে ফেলছি।
২. মুখস্থ নির্ভরতা ও পরীক্ষা কেন্দ্রিকতা
“লেখ, মুখস্থ কর, পরীক্ষায় দাও, ভুলে যাও”—এটাই কি আমাদের শিক্ষা?”
আমাদের শিক্ষা জ্ঞান অর্জনের জন্য নয়, সার্টিফিকেট পাওয়ার জন্য। তাই শিক্ষার্থীরা বোঝার চেয়ে মুখস্থ করায় বেশি আগ্রহী। এই কারণে বাস্তব জীবনের সমস্যা সমাধানে তারা দুর্বল থেকে যাচ্ছে।
৩. বেকারত্বের দুষ্টচক্র
ঢাকার রাজপথে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। বাংলাদেশে উচ্চশিক্ষিতদের বেকারত্বের হার প্রায় ৪৭%, যা চরম অস্বস্তিকর! সরকারি চাকরির পেছনে লাখ লাখ আবেদন, বেসরকারি খাতের সুযোগ সীমিত—ফলে একটি ভালো চাকরির জন্য অনিশ্চয়তা ও হতাশার মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে শিক্ষিত তরুণদের।
৪. কোচিং নির্ভরতা ও বাণিজ্যিক শিক্ষা ব্যবস্থা
স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয় থাকা সত্ত্বেও কেন শিক্ষার্থীদের কোচিং বা প্রাইভেট পড়তে হয়? কারণ ক্লাসরুম শিক্ষা প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার জন্য যথেষ্ট কার্যকর নয়। আর এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কোচিং ব্যবসা এখন বিলিয়ন ডলারের ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হয়েছে!
৫. গবেষণা ও উদ্ভাবনের অভাব
দেশে বিশ্ববিদ্যালয় বাড়লেও গবেষণা ও উদ্ভাবনের পরিমাণ আশানুরূপ নয়। উন্নত দেশে যেখানে গবেষণার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হয়, সেখানে আমাদের গবেষণার বরাদ্দ অত্যন্ত কম। ফলে বিশ্ব র্যাংকিংয়ে বাংলাদেশি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অবস্থান আশানুরূপ নয়।
ভবিষ্যৎ করণীয়:
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার এই অন্ধকার দূর করতে হলে আমাদের কিছু বাস্তবসম্মত পরিবর্তন আনতে হবে—
কারিগরি ও দক্ষতা ভিত্তিক শিক্ষা চালু করা—শুধু তাত্ত্বিক জ্ঞানের পরিবর্তে কর্মমুখী শিক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।
পরীক্ষার পরিবর্তে প্রকল্পভিত্তিক ও সৃজনশীল মূল্যায়ন চালু করা—শিক্ষার্থীদের নতুন চিন্তা ও উদ্ভাবনের সুযোগ দিতে হবে।
গবেষণায় বিনিয়োগ বাড়ানো—বিশ্বমানের গবেষণাগার ও অনুদান প্রদান করতে হবে।
শিক্ষা-বাজারের সংযোগ তৈরি করা—শিক্ষার্থীদের চাকরির বাজারের চাহিদা অনুযায়ী প্রস্তুত করা।
শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ ও মানোন্নয়ন—শিক্ষকদের আরও দক্ষ ও আধুনিক প্রশিক্ষণ দিতে হবে।
বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে। কিন্তু এই উন্নয়ন যদি মানসম্মত শিক্ষার আলোয় উদ্ভাসিত না হয়, তাহলে আমাদের স্বপ্নের সোনার বাংলা গড়ে ওঠা অসম্ভব। তাই শুধু গঠনমূলক সমালোচনা নয়, আমাদের সমাধানের পথ খুঁজতে হবে, শিক্ষাব্যবস্থায় পরিবর্তন আনতে হবে।
আমরা কি শুধু ডিগ্রিধারী মানুষ তৈরি করব, নাকি সত্যিকারের দক্ষ ও বুদ্ধিদীপ্ত প্রজন্ম গড়ে তুলব? সিদ্ধান্ত আমাদেরই!
এরকম আরো ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন।
লেখক
তানমিরা তাকওয়া
ইন্টার্ন, কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE