এই আলাপচারিতায় মাহমুদুল হাসান এর অনুপ্রেরণামূলক গল্প উঠে এসেছে, জীবনের প্রতিটি মুহূর্তকে উদ্দেশ্য ও কঠোর পরিশ্রমের মাধ্যমে অর্থবহ করেছেন। তিনি স্বচ্ছ উদ্যোগের প্রতিষ্ঠাতা এবং রুটস অফ ইমপ্যাক্টের এলামনাই। তার কাজ প্রমাণ করে যে সঠিক উদ্দেশ্য এবং পরিশ্রমের মিশ্রণে যে কেউ সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে সক্ষম।
“স্বচ্ছ” প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশে পরিবেশবান্ধব এবং টেকসই পণ্য ব্যবহারকে জনপ্রিয় করার পথে কাজ করছেন। তার উদ্যোগ কেবল একটি সমস্যা সমাধানের জন্য নয়, বরং একটি টেকসই ভবিষ্যতের পথপ্রদর্শক।
মাহমুদুল হাসানের মতো উদ্যোগী এবং লক্ষ্যনিষ্ঠ মানুষরা কেবল নিজেদের সাফল্য অর্জন করেন না; তারা সমাজের উন্নয়ন, পরিবেশ রক্ষা এবং তরুণ প্রজন্মের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেন। তার গল্প আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে সঠিক উদ্দেশ্য এবং আপ্রাণ পরিশ্রম যেকোনো স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দিতে পারে এবং সমাজে গভীর প্রভাব ফেলতে পারে।
YSSE: আমাদেরকে আপনার সম্পর্কে বলুন—আপনার জন্ম, শিক্ষা, এবং “স্বচ্ছ” ছাড়াও আপনি আর কী কী কাজ করছেন?
মাহমুদুল হাসান : আমার জন্ম ময়মনসিংহের ভালুকায়, তবে আমার বেড়ে ওঠা শরীয়তপুরে। আমি চরভয়রা উচ্চ বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছি এবং ঢাকা উদ্যান সরকারি কলেজ থেকে ২০২৪ সালে বিজ্ঞান বিভাগে এইচএসসি সম্পন্ন করেছি। বর্তমানে, “স্বচ্ছ”-এর পাশাপাশি আমি এলিট ইয়ুথ ফাউন্ডেশন পরিচালনা করি, যা একটি সামাজিক উদ্যোগ এবং এসডিজি লক্ষ্যগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে টেকসই জীবনধারা প্রচার করে। এটি তরুণদের নেতৃত্ব গড়ে তুলতে এবং সামাজিক সমস্যাগুলো সমাধানে উৎসাহিত করে। এছাড়া, আমার একটি সফটওয়্যার এজেন্সি আছে যেখানে আমরা গেম ডেভেলপমেন্ট এবং ওয়েব প্রজেক্ট নিয়ে কাজ করি। এইসব উদ্যোগ আমার জীবনকে অনেক ব্যস্ত রাখলেও, এগুলো আমার লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যের সঙ্গেই কাজ করে।
YSSE: “স্বচ্ছ” উদ্যোগ সম্পর্কে বলুন এবং এটি কীভাবে শুরু হলো?
মাহমুদুল হাসান : “স্বচ্ছ”-এর শুরুটা ছিল আমার জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ উপলব্ধি। এক সকালে দাঁত ব্রাশ করার সময় “ডেইলি স্টার” পত্রিকায় পড়লাম যে রক্তকণিকায় মাইক্রোপ্লাস্টিক পাওয়া যাচ্ছে। এটা আমাকে অনেক নাড়া দিয়েছিল। আমি বুঝলাম, আমরা নিজেদের অজান্তেই পরিবেশ দূষণে কতটা অবদান রাখি। তখন ভাবলাম, ছোট ছোট অভ্যাসগুলো পরিবর্তন করে আমরা কীভাবে বড় প্রভাব রাখতে পারি। প্লাস্টিকের টুথব্রাশ নিয়ে চিন্তা করার পর আমি খেয়াল করলাম যে এর কোনো বায়োডিগ্রেডেবল বিকল্প আমাদের দেশে সহজলভ্য নয়।
বন্ধুরা মিলে তখন বিভিন্ন মার্কেট ও অনলাইন প্ল্যাটফর্মে খুঁজতে শুরু করি। দারাজে কিছু বিকল্প পেলেও বুঝলাম এগুলো আমদানিকৃত পণ্য এবং অত্যন্ত ব্যয়বহুল। তাই আমার মাথায় আসে, কেন আমরা নিজেরাই এর সমাধান তৈরি করব না? তখন থেকেই বীজ সংবলিত বায়োডিগ্রেডেবল টুথব্রাশ তৈরির আইডিয়া আসে। এটি শুধু একটি টুথব্রাশ নয়—এটি জীবন। কারণ, এই টুথব্রাশ ব্যবহারের পর যেখানে ফেলবেন, সেখানে থেকে বীজ গজাবে এবং নতুন গাছ জন্মাবে। এমনকি আমাদের পেইজের বায়োতে এমন লেখা ছিলো যে We sell life that nobody can do it. এটাই আমাদেরকে অন্যদের চেয়ে আলাদা করে
UNICEF-এর ইমাজেন ভেঞ্চারস প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করা আমাদের জন্য দারুণ একটি সুযোগ ছিলো । সেখানে আমরা প্রোটোটাইপ উপস্থাপন করে চ্যাম্পিয়ন হই। এটি আমাদের “স্বচ্ছ” উদ্যোগের যাত্রার কিকস্টার্ট ছিল। এখন আমরা আমাদের পণ্য বাজারে এনেছি এবং ক্রেতাদের মতামত নিয়ে এটি আরও উন্নত করার চেষ্টা করছি। সবচেয়ে চমৎকার বিষয় হচ্ছে, আমাদের টুথব্রাশের দাম মাত্র ২০ টাকা থেকে শুরু, যা মানুষের জন্য সহজলভ্য এবং পরিবেশবান্ধব।
YSSE: পড়াশোনার পাশাপাশি “স্বচ্ছ” এবং এলিট ইয়ুথ ফাউন্ডেশন কীভাবে পরিচালনা করেন?
মাহমুদুল হাসান : ছোটবেলা থেকেই আমি পড়াশোনার পাশাপাশি নতুন জিনিস এক্সপ্লোর করতাম। ৮ম শ্রেণী থেকে গণিত অলিম্পিয়াড ও রোবোটিকস অলিম্পিয়াডে অংশ নিয়েছি। নানান রিজিওনালে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ন্যাশনালে গিয়েছি। ন্যাশনালেও বিজয়ের নাম লিখিয়েছি। এগুলো আমাকে জীবন ও সমস্যা সমাধানের দৃষ্টিভঙ্গি দিয়েছে।
২০২০ সালে আমি এলিট ইয়ুথ ফাউন্ডেশন শুরু করি। প্রথমে এটি আমার এলাকায় একটি ছোট ভলান্টারি উদ্যোগ ছিল। এখন এটি ১৯টি জেলায় ছড়িয়ে পড়েছে এবং ৪০০-এর বেশি ভলান্টিয়ার রয়েছে। আমরা তরুণদের প্রশিক্ষণ দিয়ে তাদের দক্ষ করে তুলছি এবং কমিউনিটির সমস্যা সমাধানে উৎসাহিত করছি। আমার কাজ আমাকে শিখিয়েছে, “আমাদের সমস্যাগুলো আমাদেরকেই সমাধান করতে হবে।” আর এই জায়গা থেকেই আমি আমার উদ্যোগগুলো চালিয়ে যাচ্ছি।
YSSE: আপনার অনুপ্রেরণা কী?
মাহমুদুল হাসান : আমার নির্দিষ্ট কোনো অনুপ্রেরণা নেই। আমি মনে করি, অনুপ্রেরণা সাময়িক, কিন্তু উদ্দেশ্য দীর্ঘস্থায়ী। আমি সবসময় একটি কথা বিশ্বাস করি:
“Purpose drives to hard work, and hard work drives to success.”
আমার উদ্দেশ্য হলো বাংলাদেশের মানুষকে পরিবেশবান্ধব পণ্য ব্যবহারে অভ্যস্ত করা। আমি দেখতে চাই, একদিন বাংলাদেশ জিরো-প্লাস্টিক টুথব্রাশ ইন্ডাস্ট্রিতে পরিণত হবে । এই উদ্দেশ্যই আমাকে প্রতিদিন জাগিয়ে তোলে এবং কাজ করার জন্য উদ্দীপনা দেয়।
YSSE: আপনার ভবিষ্যৎ লক্ষ্য কী?
মাহমুদুল হাসান : আমি ২০৪০ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার একজন প্রভাবশালী সামাজিক উদ্যোক্তা হতে চাই। 1 Year Goal তৈরি করি এবং সেগুলোকে আবার ছোট ছোট গোলে রূপান্তরিত করি যাতে আমি আমার গোল সঠিকভাবে পূরণ করতে পারি।নেটওয়ার্কিং এবং মানুষের জীবনগল্প থেকে শেখা আমার জন্য অনেক বড় অনুপ্রেরণা। এগুলো আমাকে নতুন দৃষ্টিভঙ্গি দেয় এবং নিজেকে আরও ভালোভাবে প্রস্তুত করতে সাহায্য করে।
YSSE: অবশেষে, আপনি কীভাবে “স্বচ্ছ” এবং আপনার অন্যান্য উদ্যোগকে সম্প্রসারিত করার পরিকল্পনা করছেন?
মাহমুদুল হাসান : আমার লক্ষ্য কেবল একটি পণ্য বা উদ্যোগ চালানো নয়; বরং একটি সামাজিক বিপ্লব ঘটানো। “স্বচ্ছ”-এর মাধ্যমে আমি দেখাতে চাই, কীভাবে ছোট পরিবর্তন বড় প্রভাব ফেলে। আমরা আমাদের ম্যানুফ্যাকচারিং খরচ কমিয়ে সাশ্রয়ী মূল্যে আরও বেশি মানুষকে টেকসই পণ্য ব্যবহারে উদ্বুদ্ধ করতে চাই। পাশাপাশি, আমাদের পণ্য ও উদ্যোগের সীমানা শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো দক্ষিণ এশিয়া পর্যন্ত বিস্তৃত করার পরিকল্পনা করছি।
YSSE: আপনি একজন উদ্যমী উদ্যোক্তা, এবং আমরা জানাতে চাই, ভবিষ্যতে আপনার লক্ষ্য কী এবং আপনার উদ্যোগকে কীভাবে সম্প্রসারিত করবেন?
মাহমুদুল হাসান: আমার একটি পরিষ্কার লক্ষ্য আছে, যদিও আগে আমি এটাকে শুধু একটি স্বপ্ন বলতাম। আমি চাই ২০৪০ সালের মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ার সবচেয়ে প্রভাবশালী সামাজিক উদ্যোক্তা হতে। এই লক্ষ্যকে সামনে রেখেই আমি কাজ করছি।
আমি মূলত ছোট ছোট লক্ষ্য স্থির করি, যেমন ১ বছরের লক্ষ্য স্থির করি এবং সেগুলোকে মাসিকে ভাগ করি, যাতে আমি এগুলোকে একটি পরিকল্পিত পদ্ধতিতে অর্জন করতে পারি। ছোটবেলা থেকেই আমি “Hungry for Knowledge” মনের মধ্যে কাজ করেছি, তাই মানুষের জীবন কাহিনি এবং তাদের শেখা বিষয়গুলো নিয়ে কাজ করতে ভালবাসি। এতে আমি আমার দৃষ্টিভঙ্গি গুলো শেপ করতে পারি, যা আমাকে ভবিষ্যতেও সফল হতে সাহায্য করে। আমি এটিকে বলি নেটওয়ার্কিং টু গ্রো অ্যান্ড অ্যাচিভ আওয়ার ড্রিমস। আমার বিশ্বাস, সম্ভাবনাময় পরিবেশ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এটি আমাদেরকে নিজের উন্নতির দিকে ঠেলে দেয়।
YSSE: আপনি উদ্যোক্তা হিসেবে পাঠকদের উদ্দেশ্যে কি পরামর্শ দিবেন?
মাহমুদুল হাসান: আমি এটাই বলতে চাই, “আপনার জীবনের উদ্দেশ্য খুঁজে বের করুন।” নিজেকে জানুন এবং নিজের চারপাশের সমস্যাগুলো পর্যবেক্ষণ করুন। যে সমস্যাগুলো মানুষকে প্রভাবিত করছে, সেগুলোর সমাধান তৈরি করুন। আপনি যদি সমস্যার কার্যকর সমাধান তৈরি করতে পারেন, তবে মানুষ সেটার জন্য মূল্য দিতে প্রস্তুত থাকবে।
আমি নিজে এত বড় কিছু অর্জন করিনি, তবে আমি যা শিখেছি, তা বলতে পারি। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, নিজের উদ্দেশ্য জানা। আপনি যদি জানেন, আপনার জীবন কোথায় যাচ্ছে এবং আপনার উদ্দেশ্য কী, তাহলে সে অনুযায়ী আপনার কাজ করার তাগিদ পেয়ে যাবেন।
আমার মতে, প্রতিটি তরুণ উদ্যোক্তার প্রথম কাজ হলো নিজের উদ্দেশ্য এবং লক্ষ্য খুঁজে বের করা। নিজের কাজের মধ্যে প্যাশন থাকতে হবে, কারণ এটি আপনাকে চালিত করবে। আর সবচেয়ে বড় কথা, আপনি যদি এমন একটি সমস্যা সমাধান করতে পারেন, যা মানুষ সত্যিই অনুভব করছে এবং তাদের দৈনন্দিন জীবনে প্রয়োজন, তাহলে আপনার সমাধান তারা স্বেচ্ছায় গ্রহণ করবে।
কোনও প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করলে শুধু অংশগ্রহণ করা নয়, সেগুলো থেকে আপনি কী শিখলেন, কীভাবে সেগুলো আপনার কাজে লাগাতে পারেন, তা বুঝতে হবে। প্রথমে আপনাকে একটি কারণ খুঁজে বের করতে হবে, যেটা আপনার সমাজে পরিবর্তন আনতে পারে। আপনার কাজের মাধ্যমে আপনি মানুষের জীবনে কীভাবে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে পারেন, সেটাই গুরুত্বপূর্ণ।
আমি বর্তমানে একজন সর্বকনিষ্ঠ সামাজিক উদ্যোক্তা, একজন কলেজ পড়ুয়া ছেলে হিসেবে আমি অনেক কঠোর একাডেমিক প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে গিয়েছি এবং এই প্রক্রিয়া আমাকে শিখিয়েছে যে, একটি উদ্দেশ্য থাকলে সব কিছুই সম্ভব।
আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো স্কিল ডেভেলপমেন্ট । আমরা সবসময়ই স্কিল ডেভেলপমেন্ট এর কথা বলি, কিন্তু সেটাকে বাস্তবিকভাবে কাজে লাগানোটা গুরুত্বপূর্ণ। প্যাশন আপনাকে কঠোর পরিশ্রম করতে বাধ্য করবে, আর এর মাধ্যমে আপনি সবকিছু গড়ে তুলতে পারবেন।
মোটকথা, আপনার প্যাশন এবং প্রোগ্রেস এর উপর নির্ভর করবে আপনার সফলতা। তবে টাকা বা খ্যাতি অর্জন নয়, আমাদের লক্ষ্য হওয়া উচিত প্যাশন এবং প্রোগ্রেস। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো
“Passion drives to hard work, and through hard work, you can achieve everything.”
আপনার প্যাশনকে কাজে লাগিয়ে আপনার জীবনের লক্ষ্য পূরণ করুন।
এটি ছিল মাহমুদুল হাসানের সাথে আমাদের চমৎকার সাক্ষাৎকার। তাঁর অভিজ্ঞতা এবং লক্ষ্য আমাদের সবাইকে আরও উদ্যোমী হতে প্রেরণা দেয়। YSSE তাঁকে তার উদ্যোগ এবং ভবিষ্যতের পথে সফলতার কামনা জানায়।
ধন্যবাদ সবাইকে।
Linkedin: https://www.linkedin.com/in/mahmudul4business/
এই রকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন
লেখিকা
জেমি সাইলুক
ইন্টার্ন, কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE