সময় ও স্রোত কারো জন্যই অপেক্ষা করেনা, বয়ে চলে আপন গতিতে কিন্তু কিছু ঐতিহাসিক নিদর্শন দাঁড়িয়ে থাকে কালের সাক্ষী হয়ে। ঠিক তেমনি খুলনা যশোর সীমান্তে কেশব পূর্ব জেলার ভদ্রা নদীর পশ্চিম তীরে রয়েছে একটি গ্রাম নাম ভরত-ভায়না। যেখানে কাল সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে আনুমানিক প্রায় দেড় হাজার বছর পুরনো এক পুরাকীর্তি। স্থানীয়দের কাছে বৌদ্ধ বিহারের মতো দেখতে এই জায়গাটি ভারতের দেউল বা ভরত রাজার দেউল নামেই বেশি পরিচিত।
ভরত ভায়না আবিষ্কার পর্ব :
ভারতের প্রত্নতাত্ত্বিক জরিপ বিভাগ ১৯২২ সালে এর সংরক্ষণ করে। পরবর্তীতে ১৯২৩ সালে কাশীনাথ ঢিবিতে জরিপ পরিচালনা করেন এবং তার জরিপে উঠে আসে যে ঢিবির নিচে ৫ শতকের প্রাচীন একটি বৌদ্ধ মন্দির আছে এবং এটি সম্ভবত হিউয়েন সাং এর বর্ণিত ৩০ টি সংঘারামের একটি। বাংলাদেশ সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর ১৯৮৫ সালে প্রথম ঢিবি খনন করে এবং এক দশক পর ১৯৯৫ – ৯৬ সালে পুনরায় এখানে খনন করা হয়। অতঃপর ১৯৯৬ – ৯৭ বাদে ২০০০ থেকে ২০০১ পর্যন্ত প্রতি মৌসুমের ক্ষরণ কাজ অব্যাহত থাকে খনন কাজ এখনো পর্যন্ত শেষ হয়নি।
ভরত-ভায়নার ভগ্নাবশেষ :
মূল মন্দিরটি এক একর উনিশ শতক জমির উপর প্রতিষ্ঠিত রয়েছে। প্রত্নতত্ত্ব বিশেষজ্ঞদের গবেষণায় উঠে এসেছে এটি মূলত একটি মন্দির যা তৈরি হয়েছে খ্রিস্টীয় তৃতীয় শতকে। গবেষণা চলেছে এখানে প্রাপ্ত ঈদ ও বিভিন্ন পোড়ামাটির মূর্তি পর্যবেক্ষণ করে। প্রচলিত আছে ভরত নামধারী এর প্রভাবশালী রাজার নামে এই মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল।
প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তৈরিকৃত একটি স্কেচ থেকে দেখা যায় মোট ৮২ টি বদ্ধ প্রকোষ্ঠ ধাপে ধাপে উপরের দিক উঠে গেছে যেখানে ধীরভীর শীর্ষ ধাপটি দেয়াল নয় ফুট প্রশস্ত এবং এর মধ্যে ৬ ফুট ১০ ইঞ্চি প্রশস্তের বরযাত্রীদের চারটি প্রকোষ্ঠ রয়েছে। দ্বিতীয় ধাপে দেয়াল তিন ফুট চওড়া এবং এখানে বিভিন্ন আকৃতির ১৯ টি প্রকোষ্ঠ রয়েছে। যেখানে ৩ ফুট ৯ ইঞ্চি চওড়া দেয়ালে তৃতীয় ধাপে প্রকোষ্ঠ ১৮ টি এবং সাড়ে তিন ফুট চওড়া দেয়ালের চতুর্থ ধাপ দিতে ১৯ টি বদ্ধ প্রকোষ্ঠ আছে। সর্বশেষে দশ থেকে তেরো ফুট চওড়া দেয়ালে চতুর্থ ধাপে ১০ থেকে ১৩ ফুট চওড়া দেয়াল এর মধ্যে ২২ টি বদ্ধ প্রকোষ্ঠ আছে। এরই নিচে প্রায় দশ ফুট চওড়া প্রদক্ষিণ পথ আছে এবং মন মন্দিরের চারদিকে চারটি প্রবেশপথ আছে। বিভিন্ন গবেষণা এবং গঠনশ শ্রেণীর দিক বিবেচনায় পূর্ব দিকটাই এর মূল প্রবেশপথ ছিল বলে ধারণা করা হয়। এটি নির্মাণে বিশেষ ইট ব্যবহার করা হয়েছিল যার পরিমান ৩৬ সেন্টিমিটার ২৬ সেন্টিমিটার ও ৬ সেন্টিমিটার সমপরিমাণ। এত বড় ইট এই অঞ্চলে কোন পুরাকৃতিতে ব্যবহৃত হতে দেখা যায়নি। অবকাঠামো ছাড়াও গবেষণার সময় যা যা উঠে এসেছে তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য রয়েছে গুপ্ত যুগের একটি পোড়া মাটির মাথা পোড়ামাটির মানুষের হাত ও পায়ের কয়টি ভগ্ন টুকরা, কয়েকটা মাটির প্রদীপ, অলংকৃত ইটের টুকরা, পদচিহ্ন সংবলিত দুটো ইটের টুকরা এবং একটি মাটির ক্ষুদ্র পাত্র সংগৃহীত হয়েছে যা খুলনা বিভাগীয় জাদুঘরে সংরক্ষণ করা হয়েছে।
খুলনা সাতক্ষীরা মহাসড়কের খর্নিয়া বা যুগ্নগর হয়ে খুব সহজভাবে ভরত ভায়না যাওয়া যায়। অপরদিকে খুলনা নগরের দৌলতপুর থেকে ডুমুরিয়া সাহাপুর বাজার হয়ে সামনের মিক্সিমেল সড়ক ধরে এগিয়ে ভদ্রা নদীর সেতু পার হয়ে কিছুদূর গেলেই দেখা পাওয়া যায় ঐতিহাসিক ভরত ভায়না গ্রাম। পাখির কলরবে সাধুরে হাটতে হাঁটতেই করবে মন দেওনের চূড়া, দেউল প্রাঙ্গনে আছে বিশাল এক বটগাছ যা আপনাকে সঠিক দিক নির্দেশনা নিতে সাহায্য করবে যে আপনি সঠিক স্থানে পৌঁছেছেন। কেশবপুর সদর থেকে ১৮ কিলোমিটার দক্ষিণ পশ্চিমে যাত্রা করলেই যাবে ভরত ভায়নার।
দেরী না করে চাইলে আপনিও ঘুরে আসতে পারেন দক্ষিণবঙ্গের সর্ব প্রাচীন ঐতিহাসিক নিদর্শন ও কালের সাক্ষী ভারত ভায়নাতে।
এরকম আরো ব্লগ পড়তে এখানে ক্লিক করুন।
লেখক
কাজী সুরাইয়া ইভা
ইন্টার্ণ, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE