হঠাৎ সাইরেন বেজে উঠলো। আমি তরিঘরি করে ঘুম থেকে উঠলাম। দূরে কোথাও হয়তো আগুন লেগেছে। চারদিক থেকে লোকজনের চিৎকার, চেঁচামেচি বাড়তে লাগল। বাবা হঠাৎ আমাকে অভয় দিলো। “চিন্তার কিছু নেই। আমি দেখছি।” কিন্তু উল্টো বাবাকেই উল্টো চিন্তিত হতে দেখলাম। বাবা রহিমা ফুফুকে কাছে ডেকে বললো, “হাসপাতালে মনে হয় আগুন লেগেছে। আফিয়ার কাছে যেতে হবে। নাহলে ও ঢের বিপদে পড়ে যাবে।” “মা হাসপাতালে!” ভেবে আমি ঘাবড়ে গেলাম।

আমি চুপিচুপি কাউকে জানান না দিয়ে, বাড়ির পেছনের গেট দিয়ে বের হলাম। রাস্তাঘাট এ কোনো স্ট্রিট লাইট ছিলো না। কিন্তু আগুনের দাউ দাউ করা ফুলকির ঝলসানো আলোতে চারপাশ দিনের আলোর মত উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

আমি দৌড়াতে থাকলাম। কারোর ডাকা ডাকিতে থামলাম না। শহরের আরেক প্রান্তে ছিল হাসপাতালটা। মার টানে আমি তখন সাত সমুদ্র পারি দিতে রাজি। তাই এত খানি দূরত্বও তখন কিছুই মনে হয় নি। হঠাৎ হাসপাতালটার সামনে দাঁড়ালাম। ভবনের সবজায়গায় তখনো আগুনের শিখা ছড়ায় নি। “মার হয়তো কিছু হয় নি।” আমি ভাবলাম, “বের করে আনার এখনই সময়।” দ্রুতই ভবনের ভিতরে ঢুকে পড়লাম।

আগুনের উত্তাপের চেয়েও ইস্পাতের মতো দৃড় মনোবল নিয়ে সামনে এগিয়ে গেলাম। হঠাৎ বাতাসে মার ফিসফিসানি শুনতে পেলাম। কখনোবা ডানে বা বামে মা কানের কাছে বলে যাচ্ছে, “এদিক দিয়ে আসো, বাছা আমার”, “ও দিক দিয়ে গেলে ব্যাথা পাবে খুব।

মা, তুমি কোথায়” অস্থিরতায় আমি জোরে চিৎকার করে উঠলাম। কিন্তু আগুনের দাউ দাউ শব্দের মাঝে আমার কথাগুলো যেন মিলিয়ে গেল।

হতভম্বের সতো আমি একেক তলার প্রতিটা ওয়ার্ডে যেয়ে যেয়ে খুঁজলাম। যতই ওপরের দিকে উঠলাম, ততই অদ্ভুতুড়ে পরিস্থিতি বেশি চোখে পড়ল। ওয়ার্ডের বেড গুলোতে নার্সেরা রোগীদের সাথে গল্প করছে। সবাই খোশ মেজাজে আছে। আগুন যে শীঘ্রই এদিকে ধেয়ে আসবে সেটা নিয়ে কারো খেয়াল নেই। হঠাৎ এক রুমের সামনে থমকে দাঁড়ালাম। আমার ঠিক মনে হল, এখানে মার গায়ের ঘ্রাণ পাচ্ছি। বেডের পর্দা সরিয়ে দেখলাম, ভেতরে কেউই ছিল না।

এত সবকিছুর ভিড়ে, হঠাৎ এক নার্সকে দেখলাম শান্ত ভঙ্গিতে এক টুলের উপর বসে কাঁদছে। “ও, আমি জানি, তোমার খুব কষ্ট হচ্ছে তাইনা”, নিচুভঙ্গিতে মুখের দিকে না তাকিয়ে বললো, “বৃথাই কষ্ট করছো! তুমি কিন্তু তোমার মাকে এখাতে পাবে না।” আমি তার একটা কথাও বিশ্বাস করলাম না। কিন্তু অজানা আশঙ্কা মন থেকে দূর হল না।

হঠাৎ আগুনের হলকায় ভবনটা কিছুক্ষণ কেঁপে উঠল। আমি দ্রুত দেয়ালের দিকে সরে গেলাম। কিছুক্ষণ পর পিছনে তাকালাম। কেউ নেই। কেউ ছিলোও না। স্বপ্ন আর বাস্তবের মধ্যে তফাৎ করতে পারলাম না। ‘আমি কি স্বপ্ন দেখছি?‘ নিজেকে প্রশ্ন না করে পারলাম না।

কিন্তু স্বপ্ন দেখলে তো আগুনের ভয়ংকর লৌহিত রং দেখতে পারতাম না। “যা ঘটছে, সবই সত্যি” নিজেকে এই ভেবে সান্ত্বনা দিলাম।

আবার, আমার সামনে নার্সটা ফিরে এলো কিন্তু এবার খুব বয়স্ক মুখাবয়ব নিয়ে। কিছুক্ষণ মুখের দিকে তাকিয়ে থাকাতে বুঝতে অসুবিধা হল না, ‘ইনিই আমার মা।’

এই দৃশ্য দেখে আর নিজেকে সামলাতে পারলাম না। হাঁটু গেড়ে বসে গেলাম। নার্সটা আমাকে জড়িয়ে ধরলো। “নিজেকে মাফ করে দাও, তোমার কোনো দোষ ছিলো না” অশ্রু সজল মুখে সে সোজাসুজি কথাটা বলতে কার্পণ্য করল না। “তোমার মা, সবসময় তোমার সাথে থাকবে, তোমারই হৃদয়ের গহীনে।”

হঠাৎ মনে হল, এগুলো সব আমার অবচেতন মনের সৃষ্টি। মাকে হারানোর শোঁকে আমার মন এই হাসপাতাল, আগুন, এই সব মানুষ আর নার্সটাকে তৈরি করেছে।

ভঙ্গুর-জরাঝীর্ণ স্কুল বিল্ডিংটা থেকে বের হলাম। ভোরের আলো, আমাকে নতুন প্রত্যয় নিতে উৎসাহিত করল। আমায় নিজেকে ক্ষমা করা শিখতে হবে। এমন সময়, কালো বড়সড় একটা মাকড়সা হাতে পড়ল।

এরকম আরো গল্প পড়তে, এখানে ক্লিক করুন

 

লেখক
সাদি রেজা
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE