দেশভাগের পর পাকিস্তানিরা প্রথম আঘাত হানে বাঙালিদের ভাষার উপর। রাষ্ট্রভাষা করার নামে উর্দুকে একরকম জোর করেই বাঙালিদের উপর চাপিয়ে দেয়া হয়। বাঙালিরাও চুপচাপ মেনে নেয়ার পাত্র নয়। মাতৃভাষার দাবি আদায়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে তারা।
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করেছে ছাত্রসমাজ। শান্তিপূর্ণ মিছিলে নির্বিচারে গুলি চালায় পাক বাহিনী। গুলিতে রফিক, আবদুল জব্বার, আবুল বরকত শহিদ হন। পুরো ঢাকা শহর তখন থমথমে ও গুমোট পরিবেশ। ভাষা আন্দোলনে শহিদ হওয়ার খবর ছড়িয়ে পড়লে পুরো দেশে ছাত্র-জনতা উত্তাল হয়ে ওঠে। দেশের সর্বত্র চলে মিছিল-মিটিং-সমাবেশ। পুরো ঢাকা শহর তখন থমথমে ও গুমোট পরিবেশ। ঢাকা শহরের সর্বত্র পুলিশ- সেনাবাহিনীর টহল বৃদ্ধি করা হয়।
২২ শে ফেব্রুয়ারি পুরান ঢাকার নবাবপুরে ভাষার দাবিতে পাক সৈন্যদের গুলিতে হত্যার শিকার রফিক, জব্বার, বরকতদের হত্যা নিয়ে শোক ও প্রতিবাদ মিছিল বের করেন ছাত্ররা। নবাবপুর এলাকা যখন ছাত্রদের মিছিল এবং স্লোগানে উত্তাল, ঠিক তখন ওই এলাকার একটি রেস্টুরেন্টের সামনে আনুমানিক ৯ বছর বয়সি একটি ছেলে দাঁড়িয়ে ছিল। তার সামনেই ছিল পাকিস্তানি সৈন্যদের গাড়ি। জলপাই রঙের পোশাক পরিহিত পাকিস্তানি সৈন্যদের জীবনে প্রথম দেখছে ছেলেটি। ৯ বছর বয়সি ছেলেটি জানে না তারা কারা। তার আবার ছিল ছবি আঁকার শখ। ছেলেটি পকেট থেকে একটি সাদা কাগজ বের করে জলপাই রঙের পোশাক পরিহিত সৈন্যদের ছবি আঁকার প্রস্তুতি নেয়। মাত্র ছবি আঁকা শুরু করেছে ছেলেটি এরই মধ্যে ছাত্রদের মিছিলটি তার সামনে আসে। মিছিল দেখামাত্র সাত-পাঁচ না ভেবেই মিছিলে যোগ দেয় ছেলেটি। মিছিলটি কয়েক হাত সামনে এগোতেই পাকিস্তানি সৈন্যরা আকস্মিক গুলি ছুড়তে শুরু করে। সৈন্যদের গুলিতে শহিদ হন শফিউর রহমান, ২৬ বছর বয়সি আবদুল আউয়াল নামের একজন নিরীহ রিকশাচালক এবং সেই ৯ বছর বয়সি ছেলেটি। ঘাতকের বুলেটে সেই ৯ বছরের ছেলেটির মাথার খুলি উড়ে যায়। এ অবস্থায় ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় মিছিলটি। ঘাতকরা তিনটি লাশ নিয়ে যায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। হাসপাতালে নেওয়ার সময় শিশুটির পরিচয় নিশ্চিত হতে প্রচেষ্টা চলে এবং জানা যায় তার নাম অহিউল্লাহ। নাম নিশ্চিত হওয়ার পর শিশুটির পিতা রাজমিস্ত্রি মো. হাবিবুর রহমানকে খবর দিয়ে আনা হয় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। তিনি হাতে আঁকা কিছু ছবি দেখে তার ছেলে অহিউল্লাহর লাশ শনাক্ত করেন। অহিউল্লাহর পিতা হাবিবুর রহমান নিজ ছেলের লাশ নিতে চাইলেও পাক সৈন্যরা লাশ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করেনি। অহিউল্লাহর লাশ সৈন্যরা রাতের অন্ধকারে অত্যন্ত গোপনে আজিমপুর কবরস্থানে দাফন করে।
অহিউল্লাহর পিতা তার একমাত্র সন্তানকে আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি শত অভাবের সংসারেও ছেলেকে ভর্তি করিয়েছিলেন স্কুলে। মাত্র তৃতীয় শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল অহিউল্লাহ। দরিদ্র রাজমিস্ত্রি পিতার অনেক স্বপ্ন ছিল একমাত্র ছেলে ঘিরে। কিন্তু পাকিস্তানি হানাদারদের কারণে সেই স্বপ্ন কখনো আলোর মুখ দেখেনি। ছেলে অহিউল্লাহ পাক সৈন্যদের বুলেটে শহিদ হওয়ার পর লাশটিও পাননি দরিদ্র পিতা।
ওই বছরের ২৩ ফেব্রুয়ারি ‘দৈনিক আজাদ’ পত্রিকায় শহিদ অহিউল্লাহর মৃত্যুর ঘটনাটি প্রকাশিত হয়। ১৯৫৪ সালের মার্চ মাসে ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র হিসেবে প্রকাশিত হয় ‘সৈনিক’ নামের একটি পত্রিকা। ওই পত্রিকায় ভাষাশহিদদের তালিকায় অহিউল্লাহর নাম ছিল।
এরপর সময় গড়ায়। রফিক, বরকত, জব্বার, শফিউর, সালাম প্রমুখরা ভাষাশহিদ হিসেবে মর্যাদা পেলেও সময়ের বিবর্তনে শিশু ভাষাশহিদ অহিউল্লাহ আমাদের স্মৃতি থেকে হারিয়ে যেতে থাকে। শুধুমাত্র পুরান ঢাকার প্রবীণদের কাছে ভাষাশহিদ অহি অক্ষয়-অম্লান ছিল। ভাষা আন্দোলনের ৫৪ বছর পর ২০০৬ সালে অহিউল্লাহ বিষয়ক কিছু লেখা নজরে পড়ে ভাষা-গবেষণা কেন্দ্র ও জাদুঘরের ট্রাস্টি এম আর মাহবুবের। তিনি বিভিন্নভাবে ভাষাশহিদ অহিউল্লাহ সম্পর্কে নানা তথ্য সংগ্রহ করেন। তথ্য সংগ্রহ করার একপর্যায়ে তিনি জানতে পারেন অহিউল্লাহর পরিবার ঢাকার নবাবপুর রোডস্থ ১৫২ লুৎফর রহমান লেনে বসবাস করে। তিনি সেখানে গিয়ে কথা বলেন অহিউল্লাহর পরিবারের সাথে, খোঁজখবর নিতে থাকেন ঢাকা সিটি করপোরেশনে। সেখানে আজিমপুর কবরস্থানের নথিপত্র ঘেঁটে পেয়ে যান অহিউল্লাহর নাম এবং শহিদ হওয়ার তারিখ।
কিন্তু অনেক চেষ্টা করেও অহিউল্লাহর কোনো ছবি জোগাড় করতে পারলে না এম আর মাহবুব। অহিউল্লাহর বাড়িতে তার কোনো স্মৃতিচিহ্ন নেই। ফলে তার ছবি আঁকার বিষয়টি তিনি অধিক গুরুত্বের সঙ্গে নিলেন। এ ব্যাপারে তিনি দায়িত্ব দিলেন প্রখ্যাত চিত্রশিল্পী শ্যামল বিশ্বাসকে। চিত্রশিল্পী শ্যামল বিশ্বাস ওই বছরই ভাষাশহিদ অহিউল্লাহর পরিবারের লোকজন, আত্মীয়স্বজন, প্রতিবেশী প্রবীণদের কাছে অহিউল্লাহর শারীরিক বর্ণনা শুনে ছবি আঁকার কাজ শুরু করেন। ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে ভাষাশহিদ অহিউল্লাহর ছবি আঁকার কাজ শেষ করেন চিত্রশিল্পী শ্যামল বিশ্বাস।
আমাদের মাতৃভাষা শহিদ হিসেবে রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত, শফিউরদের নাম সর্বত্র উচ্চারিত হয়। প্রতি বছর তাদের স্মরণ করে পুরো বিশ্বের বাংলা ভাষাবাসী। কিন্তু শিশু অহিউল্লাহ হারিয়ে গেছেন বিস্মৃতির আড়ালে। ভাষাশহিদ রফিক, জব্বার, সালাম, বরকত, শফিউরদের পাশাপাশি অহিউল্লাহও আমাদের স্মরণে শ্রদ্ধার দাবিদার।
এরকম আরও অনেক ব্লগ পড়ার জন্য ক্লিক করুন।
লেখকঃ
আতিয়া আলম নিসা
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট।
YSSE