কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা (AI) নিয়ে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করছেন যে অটোমেশন, এবং OpenAI-ChatGPT-এর মতো প্রোগ্রামের উপর নির্ভরতা লক্ষ লক্ষ চাকরির উপর মারাত্মক প্রভাব ফেলতে পারে, বিশেষ করে এমন শিল্পগুলিতে যা সহজেই স্বয়ংক্রিয়ভাবে হতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা।
সাম্প্রতিক কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যে সরঞ্জামগুলি রয়েছে তা মানুষ যা করতে পারে সেসকল কাজ দ্রুত ও নিপুণভাবে করতে সক্ষম। এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, প্রযুক্তি আসলে বিপুল সংখ্যক কর্মসংস্থানের সুযোগ তৈরি করবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে প্রযুকির উন্নয়নে মানুষকে চাকরিও হারাতে হচ্ছে।
গুগল, মেটারমতো বড় বড় কোম্পানিগুলো থেকে অসংখ্য কর্মজীবীকে একদিনে চাকরিচ্যুত করা হয়েছে। কিন্তু একটা কথা ভেবে দেখুন যে যারা চাকরি হারিয়েছেন তারা কী বসে রয়েছে ? না তারা কেউই গুগল বা মেটার আশায় বসে নেই। অবশ্যই তাদের দক্ষতা ছিল বলেই ঐ কোম্পানিগুলোতে সুযোগ পেয়েছিল।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা স্বয়ংক্রিয় ডিভাইসের ভূমিকা হল প্রদত্ত ডেটা ইনপুট সেটগুলির সাথে সেই নির্দিষ্ট আউটপুটে পৌঁছানোর জন্য একটি আশাবাদী অ্যালগরিদম বা ডাটা নিয়ে আসা। এই কাজটি স্পষ্টতই কম শ্রমের প্রয়োজন হবে এবং ফলস্বরূপ কম জনশক্তির প্রয়োজন হবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নতুন কোনো বিষয় নয় আমাদের কাছে। দীর্ঘদিন ধরে এর ব্যবহার করে আসছে মানুষ, বড় বড় শিল্প-কারখানা এমনকি চিকিৎসা ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীরা তাদের পড়াশোনার ক্ষেত্রে সকল ক্ষেত্রে এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সাহায্য নিচ্ছে।
২০১০ সাল পর্যন্ত এআই বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এত শক্তিশালী হয়ে উঠেছিল যে স্কুল শিক্ষকদের দেওয়া প্রবন্ধ এবং বাড়ির কাজ পর্যন্ত করতে পারত। কিন্তু এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, একটি সাধারণ সফ্টওয়্যার যা কিনা যেকোনো কাজ সেকেন্ডে করতে পারে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক্স ফোরামের মতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ২০২৫ সালের মধ্যে ৮৫ মিলিয়ন নতুন চাকরি প্রতিস্থাপন করবে। কিন্তু একই সঙ্গে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি করবে ৯৭ মিলিয়ন নতুন কর্মসংস্থান। তাই এটা এমন নয় যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা আসার সাথে সাথে চাকরি হারাবেন, অনেক নতুন চাকরির সুযোগও তৈরি হবে। এমন অনেক চাকরি আছে যা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা প্রতিস্থাপন করা যাবে না।
চলুন এবার দেখে নেওয়া যাক কোন কোন ধরনের চাকরি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা প্রতিস্থাপন করা সম্ভব অর্থাৎ যে সকল চাকরি অল্প পরিশ্রমে এবং অল্প সময়ে মানুষের থেকেও দৃঢ়ভাবে সম্পন্ন করতে পারে।
ডাক্তার : জন হপকিন ইউনিভার্সিটির একটি সমীক্ষায় জানা যায় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে হৃদরোগ এবং ক্যান্সারের পরে মৃত্যুর তৃতীয় প্রধান কারণ চিকিৎসা ত্রুটি এবং এটি শুধুমাত্র মানুষের ভুল নয়। AI এখন রোগ নির্ণয়ের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে,
উদাহরণস্বরূপ, স্ট্যান্ডফোর্ড ইউনিভার্সিটির একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছে যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ত্বকের ক্যান্সার শনাক্ত করতে পারে ঠিক ততটাই ভালো করে, যা চর্মরোগ বিশেষজ্ঞরা করতে পারে।
আসলে অনেক অস্ত্রোপচার এখন রোবোটিক আর্ম দ্বারা করা হয়, স্পষ্টতই পুরো সার্জারি করা হয় না। এদের পিছনে ডাক্তাররাই অস্ত্র পরিচালনা করেন। অন্যদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ডাক্তারদের সম্পূর্ণভাবে প্রতিস্থাপন করতে পারবে বলে মনে করবেন না।
এটি ডাক্তারদের কাজে আরও সহায়ক হবে এবং কাজকে আরও দ্রুত করতে সক্ষম হবে।
যদি আমরা COVID-19 মহামারী সম্পর্কে বলি তবে ডাক্তাররা বুকের এক্স-রে ব্যবহার করে COVID-19 সনাক্ত করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করেছিলেন। এখন স্পষ্টতই এটি ১০০% নির্ভুলভাবে করতে পারে না তবে প্রাথমিকভাবে COVID-19 এর কারণগুলি বাছাই করতে সাহায্য করবে৷
এমন অনেক দেশ আছে যেখানে ডাক্তার কম, সেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ডাক্তারদের প্রতিস্থাপন করতে পারবে না। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মেডিকেল রেকর্ড বিশ্লেষণ করতে পারে এবং রোগীর রোগের ধরন ও মেডিকেল হিস্ট্রির উপর ভিত্তি করে চিকিৎসার পরামর্শ দিতে পারে।
এটির মানুষের সহানুভূতি বোঝা এবং রোগীদের সাথে যোগাযোগ করার ক্ষমতা নেই। জটিল সিদ্ধান্ত নিতে এবং রোগীদের মানসিক সহায়তা দেওয়ার জন্য ডাক্তারদের এখনও প্রয়োজন হবে।
প্রায় সময় একজন বিক্রেতাকে গ্রাহকদের প্রশ্ন এবং সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এখন সেই সকল প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার জন্য মানসিক বা সামাজিক বুদ্ধিমত্তা সম্পন্ন কাউকে প্রয়োজন। প্রায়শই জিজ্ঞাসিত প্রশ্নের স্বয়ংক্রিয় প্রতিক্রিয়া প্রদান করতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার করা যেতে পারে। এতে তথ্য ভেলিভারির স্ট্যাটাস, পেমেন্ট কনফার্মেশন, অর্ডার ক্যান্সেলেশন বা রিফান্ড স্ট্যাটাস অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে।
ডেটা এন্ট্রি ক্লার্ক : এআই-চালিত সফ্টওয়্যার ডেটা এন্ট্রির কাজগুলিকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে করতে পারে, যা মানব কর্মীদের প্রয়োজনীয়তা হ্রাস করে। এটি সহজভাবে কাজ করতে সাহায্য করতে পারে, তবে এটির ফলে মানুষ চাকরি হারাতেও পারে। শুধুমাত্র ডেটা এন্ট্রিই নয় এআই প্রোগ্রামিং বিষয়ক সকল ধরনের কাজ সয়ংক্রিয়ভাবে করতে সক্ষম।
কন্টেন্ট রাইটিং : বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বারা কন্টেন্ট, ব্লগ পোস্ট তৈরি করা যায়। কন্টেন্ট তৈরি করার জন্য আগে মানুষকে অনেক বেশি চিন্তা ভাবনা করে অনেক সময় ব্যয় করে, অনেক ধরনের তথ্য উপাত্ত সংগ্রহ করতে হত। কিন্তু বর্তমানে মানুষ যেভাবে একটি কন্টেন্ট তৈরি করতে পারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা মিনিটের মধ্যেই সাজানো গোছানো একটি কন্টেন্ট তৈরি করে দিতে পারে।
মিউজিক কম্পোজার বা সুরকার : আমরা মিউজিক ইন্ডাস্ট্রিতে যত মিউজিক বা গান শুনি বা ভিডিও দেখি তা মানুষের বদলে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার মাধ্যমে তৈরি করাও সম্ভব। মিউজিক কম্পোজিশন আমরা সবাই জানি একটি সৃজনশীল ক্ষেত্র তাতে কোন সন্দেহ নেই কিন্তু এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কাছে এত বেশি ডেটা রয়েছে বা এটি এতটাই শক্তিশালী হয়ে উঠেছে যে এখন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিজেই সঙ্গীত রচনা করতে পারে এবং সহজে একটি গান তৈরি করে দিতে পারে।
কৃষিকাজ : ১০০ বছর আগে কৃষি ছিল এমন একটি খাত যা সংখ্যাদিক্য লোকের কর্মসংস্থান ছিল। কিন্তু বছরের পর বছর তা কমছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে এই হার আগামী বছরগুলিতে দ্রুত হ্রাস পাবে কারণ এমন অনেক কাজ ছিল যার জন্য কায়িক শ্রমের প্রয়োজন ছিল কিন্তু এখন অনেক যন্ত্রপাতি এসেছে এবং অনেক জায়গায় রোবটিক অস্ত্র ব্যবহার করা হচ্ছে। যার ফলে মানুষ্য নির্ভর কাজগুলো দিন দিন কমে আসছে।
এই ধরনের অনেক কাজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দ্বারা প্রতিস্থাপন করা যেতে পারে কিন্তু একই সাথে আরো অনেক ধরনের কাজ রয়েছে যেগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রতিস্থাপন করতে পারবে না।
সফ্টওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং, মনোবিজ্ঞানী, বিচারক এবং আইনজীবী, পণ্য ব্যবস্থাপক, স্পোর্টস ম্যান বা ক্রীড়াবিদ ইত্যাদি কাজ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা প্রতিস্থাপন করা যাবে না।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা চিকিৎসার ক্ষেত্রে যতই সাহায্য করুক না কেন একজন মানুষ যিনি মানসিক সমস্যায় ভুগছে সে কখনোই একটা রোবটের কাছে গিয়ে নিজে সমস্যার কথা বলবেনা এবং সেই সমস্যা সমাধানের আশাও করতে পারেনা।
এছাড়াও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা শুধুমাত্র সেই কাজগুলো করতে পারে যে কাজগুলোর জন্য অনেক ডাটা বিদ্যমান রয়েছে, তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্বারা সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিং এর কাজ করা সম্ভব নয়। অন্যদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হয়তো খেলার মত শিল্পকেও নিজের আয়ত্তে করতে পারে, মানুষ কখনোই রোবটের খেলা দেখে আনন্দিত হবে না, আমরা সব সময় মানুষকেই খেলোয়াড় হিসেবে দেখতে চাইবো। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেভাবে মানুষের থেকে চাকরি কেড়ে নিতে পারে ঠিক একইভাবে আমাদের চাকরির সুযোগও করে দিতে পারে।
এরকম আরও ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন।
লেখিকা
তারিন আলম স্বর্ণা
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE