উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যাওয়ার স্বপ্ন অনেকেরই থাকে, কিন্তু সঠিক দিকনির্দেশনা না থাকায় অনেকেই মাঝপথে থমকে যান। বিশেষ করে দক্ষিণ কোরিয়ার মতো গবেষণায় উন্নত দেশে পড়তে যেতে হলে কীভাবে প্রস্তুতি নিতে হবে, কী কী চ্যালেঞ্জ আসতে পারে এসব বিষয় জানাটা জরুরি। আজ আমরা কথা বলব মার্জিয়া তাবাসসুম, একজন বাংলাদেশি গবেষকের সঙ্গে, যিনি দক্ষিণ কোরিয়ায় ইন্টিগ্রেটিভ বায়োটেকনোলজি নিয়ে পিএইচডি করছেন। গবেষণার পাশাপাশি তিনি ইউটিউবে ও সোশ্যাল মিডিয়ায় শিক্ষার্থীদের জন্য তথ্যভিত্তিক কনটেন্ট তৈরি করেন, যা অনেকের জন্য দিকনির্দেশনা হয়ে উঠেছে। ল্যাবের জটিল গবেষণার ফাঁকেই সময় বের করে শুরু করেন ব্লগিং, উদ্দেশ্য একটাই বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের সঠিক তথ্য দেওয়া, যাতে তারা বিদেশে উচ্চশিক্ষার পথে আরও আত্মবিশ্বাসী হয়ে উঠতে পারেন। আজ আমরা তার সম্পর্কে ও তার কাজের ব্যাপারে বিস্তারিত জানবো।
YSSE: প্রথমেই আপনার সম্পর্কে জানতে চাইছি। আপনার জন্ম, পড়াশোনা, বেড়ে উঠা, বর্তমানে কী কাজ করছেন ইত্যাদি?
উত্তরঃ আমার জন্ম এবং বেড়ে ওঠা বরিশাল জেলার মুলাদী থানায়। আমি পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃষিবিজ্ঞান এ অনার্স এবং এন্টোমলজিতে (কীটতত্ত্ববিদ্যা) মাস্টার্স করি। পরে উচ্চশিক্ষার জন্য দক্ষিণ কোরিয়ায় আসি। বর্তমানে আমি দক্ষিণ কোরিয়ায় ইন্টিগ্রেটিভবায়োটেকনোলজি নিয়ে পিএইচডি করছি। আমার গবেষণার মূল বিষয়বস্তু প্লান্ট ভাইরোলজি এবং ক্লোনিং, যেখানে আমি টমেটো ও অন্যান্য ফসলের ভাইরাস, তাদের বাহক পোকামাকড়, এবং রোগ সংক্রমণ প্রক্রিয়া নিয়ে কাজ করছি। গবেষণার পাশাপাশি আমি ইউটিউবে ও অন্যান্য সোশ্যাল মিডিয়ায় কন্টেন্ট তৈরি করি, যেখানে আমি দক্ষিণ কোরিয়ায় উচ্চশিক্ষা, স্কলারশিপ, ভ্রমণ ও লাইফস্টাইল নিয়ে আমার অভিজ্ঞতা শেয়ার করে থাকি সাধারণত।
YSSE: গবেষণা এবং অ্যাকাডেমিক লাইফের পাশাপাশি ব্লগিং করার অনুপ্রেরণা কী থেকে পেলেন?
উত্তরঃ আমি যখন কোরিয়ায় আসি, তখন দেখি যে বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য উচ্চশিক্ষা সংক্রান্ত তথ্য খুব কমই সহজলভ্য। অনেকেই কোরিয়ায় পড়তে আসতে চান, কিন্তু তারা কীভাবে সুযোগ পাবেন, কীভাবে আবেদন করবেন-এসব নিয়ে বিভ্রান্তিতে থাকেন। আমিও অনেকবার ঝামেলায় পড়েছি বিভিন্ন তথ্য না জানার কারণে। তাই আমি সিদ্ধান্ত নেই নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করব, যাতে অন্যরা উপকৃত হতে পারেন। সত্যি বলতে কি অনেকে বিভিন্নভাবে ইনফরমেশন শেয়ার করলেও আমার কাছে মনে হতো আরো ক্লিয়ার এবং ডিটেল দরকার। সেই চিন্তা থেকেই আমি ভিডিও বানানো শুরু করি। আর চেষ্টা করেছি এপ্লিকেশন প্রসেস, ভিসা, খরচ এসব বিষয়ে অনেক ক্লিয়ারলি ডিটেল এ আলোচনা করবার। আরেকটা গুরুত্বপুর্ন বিষয় হলো, আমার গবেষণার কাজ অনেকটাই ল্যাব-কেন্দ্রিক, তাই বাইরে নতুন কিছু করা আমার জন্য এক ধরনের রিফ্রেশমেন্টও ছিলো।
YSSE: উচ্চশিক্ষার জন্য দক্ষিণ কোরিয়াকে বেছে নেওয়ার বিশেষ কোনো কারণ ছিল?
উত্তরঃ আসলে দেশের বাইরে পড়াশোনা করা আমার স্বপ্ন ছিলো অনেক বছরের। আমার সবসময় ইচ্ছা ছিলো আমি উচ্চশিক্ষ্যার জন্যে বাইরে যাবো। সেজন্যে প্রস্তুতিও নিচ্ছিলাম। বিভিন্ন স্কলারশিপ এ এপ্লাই করেছি, প্রফেসরদের সাথে যোগাযোগ করেছি। ফাইনালি কোরিয়াতে সুযোগ পেয়ে যাই।
দক্ষিণ কোরিয়া গবেষণা ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে অনেক উন্নত এটা তো আমাদের অজানা নেই। বিশেষ করে প্লান্ট ভাইরোলজি, বায়োটেকনোলজি ও এগ্রিকালচার নিয়ে এখানে অনেক উন্নত গবেষণা হয় যেটা আমার জন্যে অনেক বড় একটা সুযোগ। এছাড়া কোরিয়ার সরকারি ও বেসরকারি স্কলারশিপের সুযোগ অনেক ভালো, যা আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য বেশ সহায়ক।
YSSE: একজন বাংলাদেশি মেয়ের জন্য বিদেশে পড়তে যাওয়ার পথে সবচেয়ে বড় বাধা কী বলে মনে হয়েছে?
উত্তরঃ প্রথমত, সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি-অনেকেই মনে করেন মেয়েদের একা বিদেশে যাওয়া উচিত নয়। দ্বিতীয়ত, অর্থনৈতিক বিষয়-বিদেশে পড়তে যাওয়ার আগে বেশ কিছু খরচ থাকে, যা অনেকের জন্য চ্যালেঞ্জ হতে পারে। এছাড়া নতুন পরিবেশে মানিয়ে নেওয়া, ভাষা শিখতে সময় লাগা এবং নিরাপত্তা সংক্রান্ত বিষয়গুলোও ভাবনার জায়গা ছিল।
YSSE: বিদেশি শিক্ষার্থী হিসেবে কোরিয়ায় মানিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে কী কী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়েছেন?
উত্তরঃ প্রথম সমস্যা যেটা সেটা হলো কোরিয়ান ভাষা না জানলে দৈনন্দিন জীবনে অনেক সমস্যায় পড়তে হয়। যদিও ল্যাব এ আমরা ইংরেজিতেই কথা বলে অভ্যস্ত। তবে ব্যাসিক কোরিয়ান জানা থাকলে বাইরের পরিবেশের সাথে সহজে কমিউনিকেট করা যাবে। হালাল খাবার খুঁজে পাওয়া মুশকিল বাইরে তবে আমরা হালাল দোকান থেকেই কেনাকাটা করে থাকি স্পেশালি যেসবে হালাল সার্টিফিকেশন থাকতেই হবে। প্রথমদিকে কোরিয়ানদের খাবারের স্বাদে অভ্যস্ত হওয়া কষ্টকর ছিল কিন্তু এখন ভালো লাগে। কোরিয়ানদের কাজের পদ্ধতি এবং সময়নিষ্ঠ সংস্কৃতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে সময় লেগেছে। এটা অবশ্য নির্ভর করবে কাজের পরিবেশের উপরেও।
YSSE: বিদেশে পড়াশোনা নিয়ে কন্টেন্ট তৈরি করতে গিয়ে কী ধরনের প্রতিক্রিয়া পেয়েছেন?
উত্তরঃ আমি অনেক পজিটিভ রেসপন্স পেয়েছি। অনেক শিক্ষার্থী আমাকে মেসেজ দিয়ে ধন্যবাদ জানায়, কারণ তারা আমার ভিডিও দেখে অনেক কিছু জানতে পেরেছে। তবে কিছু নেগেটিভ মন্তব্যও আসে, কিন্তু খুবই কম, যেহেতু আমার চ্যানেল আসলে অনেক ছোট। তাই আমার খুব একটা অসুবিধা হয় না।
YSSE: দক্ষিণ কোরিয়ায় উচ্চশিক্ষার জন্য যেতে কী কী চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে?
উত্তরঃ আমি এখানে বলতে চাই প্রথম চ্যালেঞ্জ এটাই ছিলো স্কলারশিপ সহ ল্যাব খুজে পাওয়া। তারপর প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ঠিকমতো প্রস্তুত করা ও সময়মতো জমা দেওয়া চ্যালেঞ্জ ছিল। এম্ব্যাসি তে যাওয়া এবং ভিসা পাওয়াটাও কঠিন ছিলো। আমি যখন এপ্লাই করি তখন করোনা সময় ছিলো যার জন্যে আরো বেশি কঠিন হয়ে দাঁড়ায় সবকিছু। কোরিয়ায় এসে পড়াশোনার চাপ সামলানো এবং নতুন জীবনযাত্রার সঙ্গে খাপ খাওয়ানো কঠিন ছিল। আমি বিশেষত খুবই বন্ধুপ্রিয় মানুষ কিন্তু আমার কোরিয়ান ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশী ছিলো খুবই কম মাত্র ৭/৮ জন। কিন্তু সবাই ভীষণ ব্যস্ত। তার উপরে আমার ল্যাব টাইমিং টা অলয়েজ খুবই হেক্টিক ছিলো। তো সব মিলিয়ে শুরুতে বেশ কষ্টের মনে হলেও আস্তে আস্তে সব ঠিক হয়ে যায়।
YSSE: বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য কোরিয়ায় স্কলারশিপ বা সুযোগ-সুবিধা সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?
উত্তরঃ কোরিয়ায় KGSP (GKS), বিশ্ববিদ্যালয় স্কলারশিপ, প্রফেসরদের ফান্ডিং, এবং বিভিন্ন গবেষণা গ্রান্টের সুযোগ রয়েছে। আমি মনে করি, যারা কোরিয়ায় পড়তে আসতে চান, তারা যদি একাডেমিক প্রোফাইল ভালোভাবে গড়ে তোলেন, তাহলে স্কলারশিপ পাওয়া সম্ভব।
YSSE: গবেষণা, কন্টেন্ট ক্রিয়েশন ও ব্যক্তিগত জীবন-এই তিনটি কীভাবে ব্যালান্স করেন এবং গবেষণা এবং অ্যাকাডেমিক লাইফের পাশাপাশি ব্লগিং করার অনুপ্রেরণা কী থেকে পেলেন?
উত্তরঃ আমি সঠিক পরিকল্পনা ও টাইম ম্যানেজমেন্টের মাধ্যমে সবকিছু ব্যালান্স করার চেষ্টা করি। গবেষণার কাজের বাইরে যখন ফ্রি থাকি, তখন কন্টেন্ট তৈরি করি। উইকএন্ড বা ফাঁকা সময়গুলো ব্যক্তিগত জীবন ও বিশ্রামের জন্য রাখি। যদিও কনটেন্ট ক্রিয়েশন এর ব্যাপারে আমার আরেকটু সিরিয়াস হতে হবে হয়ত।
YSSE: আপনার অভিজ্ঞতা অনুযায়ী, উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশ যেতে ইচ্ছুক শিক্ষার্থী বিশেষ করে মেয়েদের কী প্রস্তুতি নেওয়া উচিত?
উত্তরঃ আমি এখানে কয়েকটি পয়েন্ট বলতে চাই সেগুলো হলো-
- ভালো একাডেমিক ব্যাকগ্রাউন্ড গড়ে তোলা।
- স্কলারশিপ ও বিশ্ববিদ্যালয় সম্পর্কে ভালোভাবে রিসার্চ করা।
- ভাষা ও সংস্কৃতি সম্পর্কে ধারণা রাখা।
- মানসিকভাবে প্রস্তুত থাকা, যেন যেকোনো চ্যালেঞ্জ সামলাতে পারেন (এটাই আমার কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ন মনে হয় কারণ বাধা আসবে বিভিন্ন দিক থেকে, তো সেগুলো পার করার শক্তি নিজের মধ্যে গড়ে তুলতে হবেই।)
YSSE: বিদেশে পড়তে এসে কোন কোন নতুন অভিজ্ঞতা আপনাকে সবচেয়ে বেশি বদলেছে?
উত্তরঃ সবকিছু একা সামলানোর অভ্যাস হয়েছে। কোরিয়ানদের কাজের ধরণ, জীবনযাপন, এবং মূল্যবোধ সম্পর্কে শিখেছি। ধৈর্য ও মানিয়ে নেওয়ার ক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। একজন পিএইচডী শিক্ষার্থী হিসেবে জীবন, গবেষণা এবং সর্বোপরি সার্বিক পরিস্থিতিকে এক অন্য আলোকে দেখার সুযোগ হয়েছে। সেটা হলো যে কোন জিনিসের প্রসেস্টাকে বুঝার চেষ্টা করা। যদি কোন কিছু ভুল হয় কেন হলো সেই প্রশ্ন করে গভীর থেকে সমস্যার সমাধান করা।
YSSE: যারা দক্ষিণ কোরিয়ায় পড়তে যেতে চান, তাদের জন্য আপনার পরামর্শ কী?
উত্তরঃ আমার পরামর্শ থাকবে-
- ভালো CGPA ও গবেষণা অভিজ্ঞতা তৈরি করুন
- স্কলারশিপের জন্য আগে থেকেই প্রস্তুতি নিন
- কোরিয়ান ভাষা শেখার চেষ্টা করুন, অন্তত বেসিক
- সঠিকভাবে ডকুমেন্ট ও আবেদন জমা দিন
YSSE: ভবিষ্যতে গবেষণা, ক্যারিয়ার ও ব্লগিং নিয়ে আপনার কী পরিকল্পনা?
উত্তরঃ গবেষণার ক্ষেত্রে আমি প্লান্ট ভাইরোলজি ও ইনফেকশাস ক্লোনের উপর আরও গভীরভাবে কাজ করতে চাই। ক্যারিয়ারের ক্ষেত্রে আমি অ্যাকাডেমিক ও গবেষণা খাতে অবদান রাখতে চাই। পাশাপাশি, ব্লগিং চালিয়ে যাব, যাতে নতুন শিক্ষার্থীদের সাহায্য করতে পারি এবং কোরিয়ার জীবনযাত্রা সম্পর্কে আরও তথ্য দিতে পারি।
YSSE: বর্তমান তরুণ প্রজন্মের জন্য আপনার কি পরামর্শ থাকবে?
উত্তরঃ তরুণ প্রজন্মের জন্য আপনার কি পরামর্শ থাকবে-
- নিজের স্বপ্নের প্রতি দৃঢ় থাকুন, কঠোর পরিশ্রম করুন।
- নতুন জিনিস শিখতে ভয় পাবেন না।
- সোশ্যাল মিডিয়া ও প্রযুক্তির ভালো দিক ব্যবহার করুন।
- সঠিক পরিকল্পনা ও ধৈর্যের মাধ্যমে লক্ষ্যে পৌঁছানোর চেষ্টা করুন।
এই দীর্ঘ ও অনুপ্রেরণাদায়ী আলাপনের জন্য আপনাকে আন্তরিকভাবে ধন্যবাদ। গবেষণার কঠিন জগৎ আর ব্যক্তিগত চ্যালেঞ্জের মাঝেও আপনি যেভাবে সময় বের করে অন্যদের পথ দেখাচ্ছেন, তা সত্যিই প্রশংসনীয়। আপনার অভিজ্ঞতা, পরামর্শ এবং ইতিবাচক মানসিকতা আমাদের অনেক কিছু শেখায় বিশেষ করে যারা বিদেশে উচ্চশিক্ষার স্বপ্ন দেখছেন, তাদের জন্য তো যেন এক রোডম্যাপই।
আপনার গল্পটা শুধু বিদেশে পড়াশোনার নয়, এটা এক নারীর সাহস, সংকল্প আর নতুনকে গ্রহণ করার মানসিকতার গল্প। আমরা আশাবাদী, আপনার মত আরও অনেক তরুণ-তরুণী সাহস করে স্বপ্নপূরণের পথে এগিয়ে যাবেন। গবেষণা, ব্লগিং আর জীবনের প্রতিটি পদক্ষেপে আপনার পথ যেন আরও উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।
Guest- Marjia Tabassum (YouTube Channel : https://youtube.com/@marjiainkorea?si=ck0_jPc32f87YaNK)
এই রকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন
লেখিকা
আনিকা শারমিলা
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE