বাংলাদেশে মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে এখনো অনেক ট্যাবু রয়েছে। মানসিক স্বাস্থ্যকে শারীরিক স্বাস্থ্যের মত সমান গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করা হয় না। কিন্তু সমাজের এসব ট্যাবু ভাঙতে এবং মানসিক স্বাস্থ্য সেবাকে সবার দোরগোড়ায় পৌঁছে দিতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে “Let’s Talk Mental Health” অর্গানাইজেশন এবং এই অর্গানাইজেশনের প্রেসিডেন্ট আনুশা চৌধুরী। তার এই অসামান্য কাজের অভিজ্ঞতা তুলে ধরা হলো YSSE এর সাথে সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে।
YSSE: শুরুতেই আপনার সম্পর্কে জেনে নিতে চাই। আপনার পড়াশোনা, বেড়ে ওঠা, বর্তমানে কি করছেন ইত্যাদি।
আনুশা চৌধুরী: আমার বেড়ে ওঠাটা চট্টগ্রামে। আর আমার জন্ম ওমানে। তার পাশাপাশি বিভিন্ন কাজে চট্টগ্রামে আসা যাওয়া করতাম। আমার স্কুল ছিল ওমানেই। এরপর আমি নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি থেকে বিবিএ সম্পন্ন করি। এছাড়াও আমি হার্ভার্ড মেডিকেল স্কুল থেকে “পজিটিভ সাইকোলজি” নামে একটা কোর্স করেছি । বর্তমানে নিয়মিত সময় দিচ্ছি আমার সংগঠন “Let’s Talk Mental Health” কে। এটি মূলত একটা নন- প্রফিট অর্গানাইজেশন। পাশাপাশি “বাজার নাও” নামে আমার একটা ই-কমার্স প্ল্যাটফর্ম আছে। ২০২০ সালে এটা আমি শুরু করেছিলাম। আমি পেশায় একজন উদ্যোক্তা এবং প্যাশনের দিক থেকে আমি একজন মেন্টাল হেলথ এডভোকেট।
YSSE: আপনি Let’s talk mental health এর co- founder & president . Let’s talk mental health এর পথচলার শুরুটা কিভাবে?
আনুশা চৌধুরী: ২০১৮ সালে প্রথম আমরা “Let’s talk mental health” চালু করি। নর্থ সাউথে পড়ার সময় আমার একজন বন্ধু ছিল, আমরা যথেষ্ট ক্লোজও ছিলাম। কিন্তু হঠাৎ করে আমি ওর ভেতর একটা behavioural change দেখতে পাই। হঠাৎ করে ও সবার সাথে মেশা, interact করা কমিয়ে দেয়। আগে ও অনেক প্রাণবন্ত একটা মেয়ে ছিল। কিন্তু হঠাৎ করে ওর ভেতর একটা lost attitude দেখতে পাই। আমরা ভেবেছিলাম হয়তো ফ্যামিলি প্রেশার বা পড়াশোনার প্রেশারের কারনে এমনটা হচ্ছে। আস্তে আস্তে ওর সাথে আমার কথা বলাটাও কমে যায়। আগে যেমন প্রতিদিন ৩-৪ বার কথা হতো সেখানে সপ্তাহে একদিনও কথা হতো না। একদিন হঠাৎ ও সন্ধ্যা ৭/৮ টার দিকে আমাকে ৬ বার কল করে। আমি তখন লাইব্রেরিতে ছিলাম বলে ফোনটা ধরতে পারি নি। লাইব্রেরি থেকে বের হয়ে ক্লান্তির কারণে সেদিন আর ফোন চালানো হয় নি। ওকে কল ব্যাক করার কথা আমার মাথায়ই ছিল না। পরেরদিন সকালে আমি যখন ওকে কল ব্যাক করি তখন ওর বড় বোন কলটা রিসিভ করে এবং বলে she is no more. She has committed suicide. যেহেতু ওর লাস্ট কলটা আমার কাছে ছিল, তাই আমাকে অনেকগুলো স্ট্রাগলের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। প্রথমত, আমি খুবই অবাক হয়েছিলাম যে ও আমাকে কেন কল দিয়েছিল? দ্বিতীয়ত, ও আমাকেই কেন কল দিয়েছিল? এমন একটা জায়গা তো থাকা উচিত যেখানে কল দিয়ে মানুষ হেল্প চাইতে পারবে at the last moment of their life এবং আমার মনে হয়েছিল আমার ফ্রেন্ড আমার সাথে তো শুধু কথাই বলতে চেয়েছিল। সে ভাবনাটা থেকেই আমি আমার সংগঠনটা শুরু করি যেটার নামের শুরুটাই হচ্ছে Let’s talk Mental Health.
YSSE: Let’s talk mental health কিভাবে কাজ করে থাকে?
আনুশা চৌধুরী: আমরা চাই মানুষকে একটা সেইফ জায়গা দিতে যেখানে মানুষ তাদের নিজেদের কথাগুলো বলবে। যে কথাগুলো সে অন্যদের বলতে পারে না, সেই কথাগুলো জাজমেন্ট ছাড়া সে মন খুলে বলতে পারবে। এই উদ্দেশ্য নিয়েই আমি ২০১৮ সালে একটা সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম তৈরি করি যেটা এখন সাড়ে পাঁচ বছরে প্রায় ৪২০০০ মানুষের কাছে মানসিক স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিয়েছে। আমরা বাংলাদেশের একটা অর্গানাইজশন হয়ে বিশ্বের ১৩ টি দেশে কাজ করছি। আমাদের একটাই মিশন, আমরা বাংলাদেশের প্রত্যেকটা ঘরে ঘরে মানসিক স্বাস্থ্য সেবা accessible & affordable করতে চাই। একজন ইয়ুথ যখন আসবে, তাকে যেন এটা চিন্তা করতে না হয় যে এখানে অনেকগুলো টাকা ইনভেস্ট করতে হবে। আমাদের অনলাইন প্ল্যাটফর্মে যখন কেউ টেক্সট এর মাধ্যমে সেবা চায়, সেটা সম্পূর্ণ ফ্রি। আর যখন কেউ কাউন্সেলিং বা এক ঘন্টার সেশন নিতে চায় তখন তাদের শুধুমাত্র সাইকোলজিস্টের ফি টুকু পে করতে হয়। আমরা ওই প্ল্যাটফর্ম টা তৈরি করে দিয়েছি যেখানে যে কেউ স্বেচ্ছায় যেকোনো কিছু শেয়ার করতে পারবেন। অন্যান্য মেন্টাল হেলথ অর্গানাইজেশনগুলোতে আপনি যখন নক করবেন, তখন দেখবেন ওরা বেশ কিছু সাইকোলজিস্ট এর ছবি দিয়ে জিজ্ঞেস করে আপনি কার কাছে সেশন নিতে চান? কিন্তু আমার মনে হয়, আমি যখন অলরেডি একটা ভালনারেবল অবস্থায় আছি তখন আমি কিভাবে চুজ করব আমার জন্য কোন সাইকোলজিস্ট বা সাইকিয়াট্রিস্ট বা কাউন্সিলর ভালো হবে? এজন্য আমাদের অর্গানাইজেশনে আমরা আমাদের বেনিফিশিয়ারিজদের এরকম অপশন দেই না। আমাদের সাইকোলজিস্টরা প্রথমে উনাদের কি সমস্যা সেটা শোনেন, তারপর সেই অনুযায়ী সেই ইন্ডিভিজুয়ালের জন্য যে সাইকোলজিস্ট বা সাইকিয়াট্রিস্ট প্রেফারেবল তাকে এসাইন করা হয়। We actually don’t put people into a sea or ocean. এভাবেই আমরা আমাদের সার্ভিস দিয়ে থাকি।
YSSE: আপু, আপনি নিজেও একজন Mental health advocate. মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করার জার্নিটা কেমন ছিল?
আনুশা চৌধুরী: এই জার্নিটা খুব একটা স্মুথ ছিল না। আমার টিমে প্রায় ১৫০ জন মেম্বার রয়েছে বাংলাদেশে। এটাকে আমি বাংলাদেশের only youth led mental health organization বলবো। এখানে যারা কাজ করছেন তারা মোটামুটি সবাই ইয়ুথ। আমাদের সবার একটাই মোটিভ, আমরা মানসিক স্বাস্থ্য নিয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে চাই। প্রফেশনাল কাউন্সেলিং, অনলাইন ওয়েবিনার, সোশ্যাল ক্যাম্পেইন এর মাধ্যমে সেল্ফ হেল্পিং স্কিলগুলোকে মানুষের কাছে অ্যাভেইলেবল করতে চাই। আমাদের সবচেয়ে বড় স্ট্রাগল হচ্ছে মানুষকে সচেতন করা। মানুষ তো আসলে সহজে মেন্টাল হেলথ নিয়ে কথা বলে না। যদি একটু গ্রামীন এরিয়ার দিকে যাই, দেখব কেউ মানসিক সমস্যায় ভুগলে মানুষ আসলে তাদের পাগল ভাবে। আমরা যখন রেগে যাই, হুট করে একটা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি, কোনো জিনিস ভেঙে ফেলি। এগুলো যে মেন্টাল হেলথ ডিসঅর্ডারের একটা অংশ এটা কিন্তু মানুষ সহজে অ্যাক্সেপ্ট করতে চায় না। এই যে স্টিগমা বা ট্যাবু এটা অনেক বড় একটা ব্যারিয়ার। ২০১৮ সালে আমি যখন কাজ করা শুরু করি, তখন আমার কাছে মনে হয়েছে মানুষ বিশ্বাসই করতে চায় না মানসিক স্বাস্থ্য, শারীরিক স্বাস্থ্যের মতোই একটা প্রায়োরিটি হতে পারে। এখন ২০২৪ সালে এসে সময়টা কিছুটা চেইঞ্জ হয়েছে। মানুষ আস্তে আস্তে মেন্টাল হেলথকে প্রায়োরাইটাইজ করা শুরু করেছে। ২০১৮ সালে যেখানে বাংলাদেশে মাত্র চার-পাঁচটা অর্গানাইজেশন ছিল সেখানে এখন প্রায় ১০-১২ টার বেশি অর্গানাইজেশন আছে, যারা মেন্টাল হেলথ নিয়ে কাজ করছে। কেন এই অর্গানাইজেশনগুলো বাড়ছে? কারণ এটার প্রয়োজনীয়তা আছে। মানুষ এখন এটা নিয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করছে। এখন পথটা একটু স্মুথ হয়েছে এবং মানুষের একটা আস্থার জায়গা তৈরি হয়েছে।
YSSE: আমরা জানি আপনি Diana award recipient, 2022, এই অর্জনের পেছনের গল্পটা জেনে নিতে চাই।
আনুশা চৌধুরী: ডায়ানা অ্যাওয়ার্ড পাওয়াটা আসলে অনেক সম্মানের একটা বিষয় ছিল। আসলে প্রত্যেকটা মানুষেরই তো একটা পার্সোনাল স্টোরি থাকে। যেমন আমার স্টোরিটা ছিল আমার কাছের বন্ধুকে হারানো। এটাই আমাকে মেন্টাল হেলথ নিয়ে কাজ করতে উদ্বুদ্ধ করেছিল। এছাড়াও আমার নিজের লাইফেও আমি বেশ কিছু মেন্টাল হেলথ স্ট্রাগল ফেস করেছি। তাই প্রত্যেকটা ওয়ার্কশপ বা ক্যাম্পেইনের পিছনে আমার একটাই উদ্দেশ্য ছিল, I want to reach as much as people I can. আমরা অনেকগুলো ব্যাক টু ব্যাক ক্যাম্পেইন করেছিলাম। আমরা মোস্টলি টিনেজারদের জন্য স্কুল বেইসড কিছু ক্যাম্পেইন করেছিলাম। স্ট্রিট চিলড্রেনদের নিয়ে আমরা একটা ক্যাম্পেইন করেছিলাম “Bringing Smile” আমরা ইন্ডিয়া, বাংলাদেশ, দুবাই সহ সাত আটটা দেশে এই ক্যাম্পেইন করেছিলাম। আমাদের উদ্দেশ্য ছিল যত বেশি মানুষকে আমরা সচেতন করতে পারি। আমি তো আসলে জানতাম-ই না কে আমাকে নমিনেট করেছে। একদিন প্রায় রাত দেড়টার দিকে আমি একটা মেইল পাই। সেখানে আমার নমিনেটর আমাকে জানায়, “Anusha, you have been selected as a Diana Award Recipient” আমার নমিনেটর একটা ক্যাম্পেইনে আমাদের পার্ট ছিল। আমরা একসাথে কাজ করেছি এবং সে নিজেও একজন ডায়ানা অ্যাওয়ার্ড রিসিপিয়েন্ট। ওই সময় আমি যদিও অনেক অবাক হয়েছিলাম বাট এওয়ার্ড পাওয়ার অনুভূতিটা আসলেই অসাধারণ ছিল।
YSSE: Diana award আপনাকে কিভাবে উদ্বুদ্ধ করেছে সামনে এগিয়ে যেতে?
আনুশা চৌধুরী: যেকোনো অ্যাওয়ার্ড বা সম্মাননা কাজের স্পৃহাকে অনেক বাড়িয়ে দেয়। আর যেকোনো সম্মাননার সাথে অনেক বড় দায়িত্বও চলে আসে। একটা সম্মাননার পাশাপাশি যে দায়িত্বটা আসে, আমার কাছে মনে হয় সেটা আরো অনেক বেশি সিগনিফিকেন্ট এবং পাওয়ারফুল। তখন আরো অনেক কাজ করার ইচ্ছে তৈরি হয়। আমার তখন মনে হয়েছিল যেহেতু আমার কাজ বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পাচ্ছে, সেহেতু আমি কেন আরো কাজ করব না বা আরো কাজ করার জন্য মানুষকে ইন্সপায়ার করব না? যদি আমি একজন চেঞ্জমেকার হতে পারি তাহলে অন্যরাও চেঞ্জমেকার হতে পারবে। তবে আমি একা কাজ করে এতদূর আসতে পারতাম না যদি আমার টিম আমাকে সাপোর্ট না করতো। আমার অর্জনের পেছনে আমার টিমের অনেক বড় একটা অবদান আছে।
সাক্ষাৎকারের ২য় পর্বে আমাদের অতিথির বাকি গল্প সম্পর্কে জানতে পারবেন। এবং আরো কিছু প্রশ্ন উত্তরের মাধ্যমে অতিথির অভিজ্ঞতা সম্পর্কে এবং তার কাজের পরিধি সম্পর্কে জানতে পারবেন।
লেখকঃ
আতিয়া আলম নিসা
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট।
YSSE
এরকম আরও অনেক ব্লগ পড়ার জন্য ক্লিক করুন
