অর্থনীতির দিক থেকে আমেরিকার মতো শক্তিশালী দেশ খুব কমই আছে। সেই আমেরিকাও ১৯২৯ -১৯৩৯ সাল পর্যন্ত, দশ বছরে মুখোমুখি হয়েছিল ভয়াবহ অর্থনৈতিক মন্দা, দারিদ্র্য, বেকারত্ব এবং অপরাধপ্রবনতার। যা শুধু আমেরিকাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি, এর প্রভাব পড়েছিল বাকি দেশগুলোর উপরেও। ইতিহাস এই সময়টাকে চিহ্নিত করেছে “দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন” হিসেবে। প্রায় ১০০ বছর পরে বর্তমান বিশ্বে আবার কি ফিরে আসতে যাচ্ছে দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন?  চলুন জেনে নেওয়া যাক।

 

প্রথম বিশ্বযুদ্ধে ইউরোপ ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হলেও আমেরিকা নিজেদের অর্থনীতিকে যুদ্ধের প্রভাব থেকে বাঁচাতে সক্ষম হয়েছিল। ইউরোপ নিজেদের ক্ষয়ক্ষতি সামাল দিতে আমেরিকার শরণাপন্ন হয়। ১৯২০-১৯২৯ এই দশ বছর আমেরিকা খাদ্যদ্রব্য ও সমরাস্ত্রসসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য  ইউরোপে রপ্তানি করে অর্থনৈতিক দিক দিয়ে ক্রমাগত শক্তিশালী হতে থাকে। গড়ে ওঠে নতুন নতুন কলকারখানা, ব্যাংক, কর্পোরেট অফিস। কর্মসংস্থান তৈরি হয় লক্ষ লক্ষ আমেরিকানের। বেকারত্ব, দারিদ্রতা উল্লেখযোগ্য হারে কমে আসে। এরকম শক্তিশালী অর্থনীতি এবং বিলাসী জীবনযাপন আমেরিকানরা প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আগে আর কখনো দেখেনি। ইতিহাসে সময়টাকে “Roaring twenties” নামে অভিহিত করা হয়। 

এই স্বর্ণালী সময়টাতে আমেরিকানরা প্রচুর পরিমানে অর্থ শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে শুরু করে। কারণ শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করলে দ্বিগুণ মুনাফা পাওয়া ছিল প্রায় সুনিশ্চিত। তাই লাগাতার মুনাফার লোভে মার্কিনীরা ব্যাংকে ঋণ নিয়ে হলেও শেয়ার বাজারে বিনিয়োগ করতে থাকে। কিন্তু ১৯২৯ সালের অক্টোবরের শেষের দিকে শেয়ার বাজারে অস্থিতিশীলতা তৈরি হয় এবং কিছুদিনের মধ্যেই নিউইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জ তাসের ঘরের মতো ভেঙে পড়ে। শুরু হয় অর্থনৈতিক মহামন্দা। এই অর্থনৈতিক মহামন্দার একটি অন্যতম কারণ ছিল রপ্তানি হার কমে যাওয়া। ইউরোপ প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর আমেরিকার উপর নির্ভরশীল হলেও পরবর্তী দশ বছরে তারা ধীরে ধীরে সে নির্ভরশীলতা কাটাতে শুরু করে। আমদানিমুখী না হয়ে তারা নিজেরাই নিজেদের পণ্য উৎপাদন শুরু করে। যার ব্যাপক প্রভাব পড়ে আমেরিকার কৃষি ও শিল্পখাতে। রপ্তানির অভাবে কৃষকের ফসল নষ্ট হতে থাকে, শিল্পকারখানা বন্ধ হয়ে যায়। বেকার হয়ে পড়ে প্রায় দেড় কোটি মার্কিনী। শেয়ার বাজারের দরপতনের ফলে শুরু হয় অর্থনৈতিক মন্দা। শুরু হয় গ্রেট ডিপ্রেশন। 

বর্তমান আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপট অনেকটাই দ্য গ্রেট ডিপ্রেশনের সময়ের সঙ্গে মিলে যায়। গ্রেট ডিপ্রেশনের সময় বেড়েছিল বেকারত্ব। ১৯৩৩ সালে প্রায় ১৫ মিলিয়ন মার্কিনী বেকার হয়ে পড়ে। শেয়ারবাজারের ভয়াবহ ধ্বস, ব্যাংকগুলোর দেউলিয়া হয়ে যাওয়া এবং কলকারখানা থেকে শ্রমিক ছাটাইয়ের ফলে ভয়াবহ অর্থসংকটের মধ্যে পড়ে মার্কিন নাগরিকরা। বেড়ে যায় দারিদ্র্য, খাদ্যসংকট,  গৃহহীন মানুষের সংখ্যা। করোনা মহামারীর পর আমরাও একই সমস্যার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। World Economic Forum এর মতে, ২০২০ সালে করোনা মহামারীতে ১১৪ মিলিয়ন মানুষ তাদের চাকরি হারিয়েছে এবং ২০২৫ সালের মধ্যে বিশ্বের ৮৫ মিলিয়ন চাকরি বাদ হয়ে যাবে।” বিশ্লেষকরা মনে করছেন এই বেকারত্বের পেছনে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স একটা বড় প্রভাবক হিসেবে কাজ করছে। এআই ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংক Goldman Sachs ধারণা করছে প্রযুক্তির হাতে চলে যাবে প্রায় ৩০০ মিলিয়ন ফুল টাইম জব। গ্রেট ডিপ্রেশনের সময়টাতে বেকারত্ব বাড়ার  সাথে সাথে বেড়ে গিয়েছিল হতাশা, বিষণ্ণতা, একাকীত্ব। বেড়েছিল সম্পর্কের শিথিলতা, বেড়েছিল সুইসাইড। বর্তমান সময়ের দিকে তাকালেও আমরা একই দৃশ্য দেখতে পাই। করোনা মহামারীর পর ইতিমধ্যে ডিপ্রেশন ২৫% বেড়ে গিয়েছে বলে জানিয়েছে WHO। আর্থসামাজিক বৈষম্য বাড়ছে, মানুষের মনোযোগ কমে যাচ্ছে, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশি সময় কাটানোর ফলে প্রোডাক্টিভিটি কমে যাচ্ছে, সম্পর্কে দূরত্ব বেড়ে যাচ্ছে, বিচ্ছেদ বাড়ছে, বাড়ছে আত্মহত্যার প্রবণতা। 

 

দ্য গ্রেট ডিপ্রেশনের প্রভাব পড়েছিল বিশ্বরাজনীতিতেও। গ্রেট ডিপ্রেশনের কিছু সময় পরেই শুরু হয় ২য় বিশ্বযুদ্ধ।  বর্তমান পৃথিবীতেও একইরকম যুদ্ধের ডামাডোল দেখতে পাই আমরা। ইউক্রেন -রাশিয়া যুদ্ধ,  ইসরাইল- প্যালেস্টাইন যুদ্ধ, রাশিয়া- যুক্তরাষ্ট্রের টানাপোড়ন প্রভাব ফেলছে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির ফলে মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাচ্ছে নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যাদি, যার ফলস্বরূপ বাড়ছে হতাশা, বাড়ছে বিষণ্ণতা ।  WHO ধারণা করছে, ২০৩০ সালের মধ্যে বিষণ্ণতা হবে বিশ্বের একমাত্র প্রধান রোগ। তাহলে দ্য গ্রেট ডিপ্রেশন কি আবার আমাদের কাবু করতে চলেছে? আপনার কি মনে হয়?

 

এরকম আরও অনেক ব্লগ পড়ার জন্য ক্লিক করুন

লেখিকা, 

আতিয়া আলম নিসা 

ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট। 

YSSE