আলফ্রেড নোবেল বিজ্ঞানকে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন মানব কল্যাণে। কিন্তু নাইট্রোগ্লিসারিনের নিরাপদ ব্যবহারের উপায় উদ্ভাবন করতে গিয়ে আবিষ্কার করে ফেলেন  ডিনামাইট। তাঁর চাওয়া ছিল টানেল তৈরী, পাথর ভাঙা কিংবা খনি খননের কাজে এটির ব্যবহার হবে। কিন্তু মানুষের হাতে পড়ে ডিনামাইট হয়ে উঠল মারণাস্ত্র। আর আলফ্রেড নোবেল নাম কুড়োলেন ‘মৃত্যুর বণিক’ (Merchant of Death) হিসেবে।

 

ব্যথিত নোবেল ১৮৯৫ সালে মৃত্যুর ঠিক আগের বছর তাঁর সম্পত্তির ৯৪ শতাংশ উইল করে দেন।  সেই উইল অনুসারে প্রবর্তিত হয় নোবেল পুরস্কার। 

নোবেল শান্তি পুরস্কার নরওয়েতে দেওয়া হলেও সাহিত্য ও অর্থনীতির মতো অন্যান্য পুরস্কার  দেওয়া হয় সুইডেন থেকে। ১৯০১ সাল থেকে প্রতিবছর দেওয়া হচ্ছে এই পুরস্কার। প্রতিবছর অক্টোবরের প্রথম সোমবার থেকে পরবর্তী ছয় দিন সারা বিশ্বের ছয়জন পুরস্কার বিজয়ীর নাম ঘোষণা শুরু হয়।

বাঙালীর সাথে নোবেলের সম্পর্ক অতি উষ্ণ না হলেও এ পর্যন্ত নোবেলপ্রাপ্তদের তালিকায় পাওয়া যায় চারজন বাঙালির নাম। আজকের আলোচনা এই চার নোবেল বিজয়ীদের নিয়েই।  

 

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

 

১৯০১ সালে সাহিত্যে নোবেল প্রবর্তনের পর প্রথম এই পুরষ্কার লাভ করেন ফ্রান্সের বিখ্যাত কবি ও প্রাবন্ধিক সুলি প্রুদোম। আর ২০২২ সালে এ সম্মানে ভূষিত হয়েছেন ফ্রান্সেরই আরেক কথাসাহিত্যিক আনি এরনো। এই ১২১ বছরের উজ্জ্বল ইতিহাসে সাহিত্যে নোবেল পেয়েছেন মোট ১১৯ জন সাহিত্যিক।  তবে এই তালিকায় বাঙালির সংখ্যা মোটে একজন।

কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯১৩ সালে তাঁর গীতাঞ্জলী কাব্যগ্রন্থের ইংরেজী অনুবাদ Song Offerings এর জন্য নোবেল পুরষ্কারে ভূষিত হন। এই কাব্যের ইংরেজী অনুবাদ করেন W.B. Yeats। 

এই কাব্যের সংবেদনশীলতা, মার্জিত রচনাশৈলী এবং গাম্ভীর্যমন্ডিত পংক্তি, যার মাধ্যমে তাঁর কাব্যিক চিন্তা চেতনা তিনি  প্রকাশ করতে সমর্থ হয়েছিলেন, তা পশ্চিমা সাহিত্যপাঠকদের বিমোহিত করতে যথেষ্ঠ ছিল।

 

অমর্ত্য সেন

 

১৯৯৮ সালে কল্যান অর্থনীতিতে অবদানের প্রেক্ষিতে প্রথম বাঙালি হিসেবে অর্থনীতিতে নোবেল পুরস্কার লাভ করেন অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন। ভারতীয় বাঙালী এই অর্থনীতিবিদ দূর্ভিক্ষ দূরীকরণ, জনকল্যাণ অর্থনীতি, মানব উন্নয়ন তত্ত্ব, ও গণদারিদ্রের অন্তর্নিহিত কার্যকারণ বিষয়ে গবেষণা এবং উদারনৈতিক রাজনীতিতে অবদানস্বরূপ ১৯৯৮ সালে অর্থনৈতিক বিজ্ঞানে ব্যাংক অফ সুইডেন পুরস্কার (যা অর্থনীতির নোবেল হিসেবে পরিচিত) লাভ করেন।

রবীন্দ্রনাথের পর দ্বিতীয় বাঙালি হিসেবে তিনি নোবেল পুরষ্কার অর্জনের কৃতিত্ব অমর্ত্য সেন এর। আর অর্থনীতিতে বাঙালি এমনকি এশিয়ান হিসেবে প্রথমবারের মতো তিনি এই বিশ্ববিখ্যাত পুরস্কারটি অর্জন করেন। দূর্ভিক্ষ ও দারিদ্র নিয়ে ভিন্ন ও গুরুত্বপূর্ণ দিকগুলো তুলে ধরার সুবাদে বিশ্বজুড়ে তিনি খ্যাত। 

ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস

 

এই তালিকায় একমাত্র বাংলাদেশী ডক্টর মুহাম্মদ ইউনূস। নোবেল পুরস্কার বিজয়ী এই অর্থনীতিবিদ একাধারে ব্যাংকার এবং শিক্ষকও বটে। তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের একজন শিক্ষক হিসেবে কর্মরত ছিলেন। বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতাকালীন প্রথমবার ক্ষুদ্রঋণ ধারণা নিয়ে তিনি কাজ শুরু করেন। ১৯৮৩ সালে মাত্র ৩ কোটি টাকা পুঁজি নিয়ে এক সামরিক অধ্যাদেশ বলে মুহাম্মদ ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেন। পরবর্তীতে দারিদ্র দূরীকরণের প্রেক্ষিতে মুহাম্মদ ইউনূস এবং গ্রামীণ ব্যাংক যৌথভাবে ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার লাভ করেন।

অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়

 

তালিকার শেষ বঙ্গসন্তান অভিজিৎ বিনায়ক বন্দ্যোপাধ্যায়। কলকাতায় জন্ম নেওয়া অভিজিৎ অবশ্য একা নন, ২০১৯ সালে তাঁর স্ত্রী ফরাসি বংশোদ্ভূত মার্কিন অর্থনীতিবিদ এস্তার দুফলো এবং সহকর্মী হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইকেল ক্রেমারও যুগ্মভাবে অর্থনীতিতে নোবেল পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হন। অভিজিৎ-এস্থার দম্পতি হলেন ৫ম নোবেল বিজয়ী দম্পতি।

 

তাঁদের পরীক্ষামূলক গবেষণাকে সম্মান জানিয়ে নোবেল কমিটি সেসময় বিবৃতি দিয়েছিল, ‘ওঁদের গবেষণা গোটা বিশ্বকে দারিদ্রের বিরুদ্ধে লড়ার নতুন হাতিয়ারের সন্ধান দিয়েছে। মাত্র দুই দশকে ওঁদের গবেষণা পদ্ধতি উন্নয়ন অর্থনীতির রূপরেখা বদলে দিয়েছে। এখন অর্থনীতির গবেষণায় এটি অন্যতম পাথেয় মডেল।’

একাডেমি আরও বলেছে, এই তিনজনের পরীক্ষামূলক গবেষণা পদ্ধতি ৫০ লাখের বেশি ভারতীয় শিশুকে উপকৃত করেছে।
উল্লেখ্য, অভিজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দেখানো সূত্রের ওপর ভিত্তি করেই ২০১৯ সালের নির্বাচনের আগে ভারতীয় কংগ্রেস তাঁদের ‘ন্যায়’ প্রকল্প গড়ে তোলে৷ 

কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজের নোবেল জয়ী সাবেক এই শিক্ষার্থী এখন কর্মরত আছেন এমআইটিতে ফোর্ড ফাউন্ডেশন ইন্টারন্যাশনাল প্রফেসর অফ ইকোনমিক্স হিসাবে। 

 

এখন পর্যন্ত মাত্র ৪ জন বাঙালি নোবেল পুরষ্কার লাভের গৌরব অর্জন করলেও ১৯১৩ থেকে ২০২০ সাল অব্দি বিভিন্ন শ্রেণীতে সর্বমোট ১৫ জন এই পুরষ্কারের জন্য মনোনীত হয়েছেন। তন্মধ্যে অনেকের নামই একাধিকবার তালিকায় স্থান পায়। দুরারোগ্য কালাজ্বরের প্রতিষেধক আবিষ্কার করে সাড়া ফেলে দেয়া বিখ্যাত বাঙালি চিকিৎসক এবং বিজ্ঞানী উপেন্দ্রনাথ ব্রহ্মচারী ৫ বার এই তালিকায় স্থান করে নিয়েছিলেনএকমাত্র বাংলাদেশি এবং নারী হিসেবে ২০০৫ সালে এ তালিকায় নাম লেখান আলোচিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন।

সুইডিশ কমিটির নিয়ম অনু্যায়ী ৫০ বছরের আগে কোনো সালের প্রস্তাবিত লেখক ও প্রস্তাবকারীদের নাম প্রকাশ করা হয় না। সম্প্রতি ১৯৭১ সাল পর্যন্ত প্রস্তাবিত লেখক ও প্রস্তাবকারীদের নাম প্রকাশিত হয়। এর মধ্যে চমকপ্রদ তথ্য হলো, ১৯৭১ সালে সাহিত্যে  প্রস্তাবিত হয়েছিল বাঙালি কথাসাহিত্যিক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম।

 

আরও ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন।

লেখক 

দীপ্ত বিশ্বাস

ইন্টার্ণ, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট 

YSSE