“দাও নাগরিকত্ব

নয় মৃত্যু”

  • ২০১২ সালের ছিটমহলবাসীর সম্মিলিত স্লোগান

 

ছিটমহল এমন একটি শব্দ যেটি দ্বারা এক রাষ্ট্রের অঞ্চল অন্য রাষ্ট্রের ভৌগলিক সীমার অভ্যন্তরে অবস্থিত।

এই ছিটমহল বিশ্বের সীমানাজুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।যা অন্য রাষ্ট্রের মালিকানা ভূখন্ডের হওয়া সত্ত্বেও পড়ে রয়েছে অন্য রাষ্ট্রের ভূখন্ডে।এই অঞ্চলের মানুষেরাও রয়েছে এমন ভাবে নিজেদের পরিচয় গোপন রেখে সেই রাষ্ট্রে বসবাসরত নাগরিক হিসেবে পরিচয় দেওয়া।শুধুই পরিচয় কি…বিদ্যুৎ,যাতায়াত,কর্মসংস্থান,ঠিকানা দৈনন্দিন জীবনের নানান সমস্যায় জর্জরিত।এই সমস্যার সমাধানের জন্য বিশ্বজুড়ে এখন চেষ্টা চলছে।

 

ছিটমহল কি

 

ছিটমহল দুই প্রকার:১.এনক্লেভ(Enclave) এবং ২.এক্সক্লেভ(Exclave)

 

১.এনক্লেভ:যে অঞ্চল একটি দেশ দ্বারা সম্পূর্ণ ভাবে আবদ্ধ তাকে ছিটমহল বলা হয়।যেমন:ভ্যাটিকান সিটি,সান ম্যারিনো(এই অঞ্চল গুলোকে ছিটমহল দেশ হিসেবে বলা হয়) ইত্যাদি।

এনক্লেভ কে সম্পূর্ণভাবে ছিটমহল হিসেবে ধরা হয়।

 

২.এক্সক্লেভ:যে অঞ্চল একটি বা কিছু দেশ দ্বারা আবদ্ধ থাকে এবং কোনো এক গতিপথ দ্বারা এই এক্সক্লেভে প্রবেশ করা যায়।এই এক্সক্লেভকে ছিটমহল বলা যায় না।তবে কিছুক্ষেত্রে ছিটমহল বলা হয়।যেমন:আজারবাইজান নাখচিভান একটি উদাহরণ এক্সক্লেভের।

 

ছিটমহল ইতিহাস

 

“A piece of territory surrounded by foriegn dominion is enclave

 

আমরা মানুষরা ভিন্ন জাত,গোষ্ঠী,সম্প্রদায়ের হলেও একটা পরিচয় আমাদের তা হল মানুষ।যার কারণে আজও দেশ-বিদেশের মানুষে-মানুষের এত মমত্ববোধ চিরন্তন।

 

কিন্তু ঔপনিবেশিক শাসনামলের শাসকদের খামখেয়ালিপনা ক্ষমতার দ্বন্দ্বের এক অনন্য প্রতীক ছিটমহল।কুচবিহারের রাজা এবং রংপুরের মহারাজা তিস্তার পাড়ে তাসখেলায় বাজি ধরতেন ছিটমহলের মালিকানা নিয়ে।

এই ছিটমহল অর্থাৎ ছিট অর্থ টুকরো।বিভিন্ন মহলকে এক করে ছিটমহল তৈরী।ইতিহাসের পাতা বলে,ষোড়শ শতাব্দীতে সম্রাট শাহ জাহানের থেকে শুরু হয়।তার অসুস্থতার কারণে কুচবিহারের রাজা প্রাণনারায়ণ আক্রমণ করে সুবেদার মীর লুৎফুল্লাকে।পরে আওরঙ্গজেবের আদেশে মীর জুমলা পরাজিত করে প্রাণনারায়ণ কে।পরে তিনি আবার সৈন্যবল নিয়ে আক্রমণ করে জয়ী হন।এইভাবে শুরু হয় একের পর এক আক্রমণ।

 

এরকম বিশ্বজুড়ে নানান রেশ,দ্বন্দ্ব,প্রকৃতি গতিপথ পরিবর্তনের ফলে এমন ছিটমহলের সৃষ্টি হয় যা সেই ছিটমহলে অবস্থিত মানুষদের দৈনন্দিন জীবনে নানান সমস্যায় জর্জরিত করে।

 

বিশ্বজুড়ে ছিটমহল

 

দুনিয়ার মানচিত্র জুড়ে ঐতিহাসিক অনেক ছিটমহল রয়েছে যা তার প্রতীক হিসেবে প্রদর্শিত।

  • নেপোলিয়ানের কবর সেন্ট হেলেনার লংউডে যা ফ্রান্সের অধীনে
  • ভিক্টের হুগোর বাড়ী যা গুয়াসের সেন্ট পিটার পোর্টে যা প্যারিস নগরীর অধীনে
  • ফ্রান্সের দ্য নরম্যান্ডি আমেরিকান সেমিট্রি(দিত্বীয় বিশ্বযুদ্ধের ৯৩৮৬ মার্কিন যোদ্ধার কবর) যা যুক্তরাষ্ট্রের অধীনে
  • সুইজারল্যান্ডের সুভোরোড স্মৃতিসৌধ(২৪ বর্গমিটার)রাশিয়ার অধীনে
  • ইংল্যান্ডের অধীন যুক্তরাষ্ট্রের নর্থ ক্যারোলিনায় অবস্থিত দুটো কবরস্থান। উভয় কবরস্থানেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে নিহত ব্রিটিশ নাবিকদের কবর দেয়া হয়েছে

 

কিছু ঐতিহাসিক ছিটমহল

 

  • তুর্কী:বর্তমান সিরিয়ায় অবস্থিত। বালাত জগারের কাছে সুলেমান শাহর কবর। এক সময় তুর্কী অঞ্চল হিসেবে বিবেচ্য ছিল। ১৯৭৩ সালে আলাদ হ্রদ খননের সময় কবরটি পুনরায় স্থানান্তরিত করা হয়।
  • মাউন্ড স্কেপাস (জেরুজালেমে অবস্থিত) : ১৯৪৮ ও ১৯৬৭-এর মাঝে ছয়দিনব্যাপী যুদ্ধের পর ইসরাইলের পশ্চিম জেরুজালেমের সঙ্গে এক হওয়ার আগে মাউন্ট স্কোপাস ছিল জর্দানের ভেতর ইসরাইলি ছিটমহল। রাজনৈতিকভাবে এটি এখনো একটি ছিটমহল।
  • গাজার : ১৯৫৮ সাল পর্যন্ত এটি ছিল পাকিস্তানের মাঝে ওমানের উপকূলীয় ছিটমহল

 

বাংলাদেশ-ভারত ছিটমহল

 

১৯৪৭ সালে লর্ড মাউন্টব্যাটনের আদেশে স্যার রেডক্লিফ ভারতের পূর্ব-পশ্চিম অঞ্চলের দুই প্রদেশ বাংলা-পান্জাব মাঝ বরাবর দাগ টেনে ম্যাপ করেন।যা জনগণের মাঝে ব্যাপক ঝড় তোলে।ছিটমহলবাসীর প্রায় ১৬২ টি ছোট-বড় ভূখড অনিষ্পত্তি অবস্থায় রাখে যা চরম দূর্ভোগে সৃষ্টি হয়।

পৃথিবীর মানচিত্রে এদের (Shattered Belt) বলা হয়।

 

১৯৪৭ এর দেশভাগের পর সমস্যা হয় কুচবিহার নিয়ে।রাজা জগদ্দীপপেন্দ্র এর জমিদারিত্ব এবং রংপুর এবং দিনাজপুরের আওতাধীন জেলায়।বিপরীতে রংপুর এবং দিনাজপুর জেলার জমিদারদের সমস্যা হয় কুচবিহারের সীমানার মধ্যে।এই উভয়পক্ষ সমস্যা সমঝোতায় ব্যর্থ হয়ে ভারতে বাংলাদেশের কিছু জায়গা পড়ে যায় এবং বাংলাদেশে ভারতের কিছু জায়গা পড়ে যায়।

 

এরপর শুরু হয় এই ছিটমহল অঞ্চল গুলোতে নানান রকম নির্যাতন,দৈনন্দিন জীবনে সমস্যায় পড়া,সব রকম সুযোগ-সুবিধা,নাগরিকত্ব সমস্যা,অধিকার থেকে বঞ্চিত হতে থাকা যেন এক নরকজ্বালা যন্ত্রণার ভোগ।

 

এর মধ্যে অনেক চুক্তি হয়েছিলো রেডক্লিফ রোয়েদাদ,নুন-নেহেরু চুক্তি,৭৪ এর মুজিব-ইন্দিরা চুক্তির পর ছিটমহলের বাসিন্দারা “কলঙ্ক তিলক

মানবেতর জীবনযাপন করেছে।

 

তার বহুসময় পরে ১৯৯৬ তে মুজিব-ইন্দিরা চুক্তি সূত্র ধরে কূটনৈতিক শুরু করেন।২০১১ সালে ভারত সরকার মনমোহন সিং বাংলাদেশ সফরে সমঝোতা স্বাক্ষর করেন।পরে এই বিলটি একই বছরে পাস করে জাতীয় সংসদে।ভারতে নরেন্দ্র মোদি এই ছিটমহলের অভিশাপ দূর করতে অগ্রসর হন।যা ৭ইমে ২০১৫ সালে স্থলসীমান্ত  চুক্তি সংবিধান সংশোধনী বিল ভারতীয় লোকসভায় বিল পাস করা হয়।

 

বাংলাদেশের মধ্যে ভারতের ১১১টি ছিটমহল

ভারতের মধ্যে বাংলাদেশের ৫১ টি ছিটমহল উভয়পক্ষের মালিকানা তুলে দেওয়া হলো।যা ইতিহাসের এক সুন্দর আলোড়ন তৈরী করে “কলঙ্ক তিলক” মানবেতর জীবন থেকে মুক্ত করা হয়।

 

আজ এই বাংলাদেশ-ভারতের ছিটমহল এখন একটি ইতিহাস।এই কলঙ্ক নিঃসরণ করে এক সুন্দর মানবীয় বৈশিষ্ট্যের আলোড়ন করে ইতিহাসে যা সত্যিই ইতিহাসের পাতায় সুন্দর এক সৃষ্টি।

 

“সেই ঐতিহাসিক ২০১২ সালের ছিটমহলবাসীর সম্মিলিত স্লোগান আজ সত্যি হলো”

 

“ইচ্ছে নই,শক্তিই রাষ্ট্রের ভিত্তি”

 

টি এইচ গ্রিন

 

ধন্যবাদ

 

লেখক,

তীর্থ চৌধুরী

ইন্টার্ন কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট

ওয়াইএসএসই

 

 

আরো ব্লগ পড়তে চাইলে,চাপ দিন।