বর্তমানে অর্থনৈতিক শোষন ও পুঁজিবাদ, সম্পদের অসম বন্টন, জলবায়ু পরিবর্তন বৈশ্বিক সুস্থতার অন্তরায়। এইসব বাধা থেকে উত্তরনের পথ খুজে চলেছেন বিজ্ঞানী, অর্থনীতিবিদ ও পরিবেশবাদীরা। সেই চেষ্টা প্রচেষ্টাকে সামনে রেখেই আর্থিক স্বাধীনতা, দক্ষ জনশক্তি ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় তরুন সমাজকে অনুপ্রানিত করার জন্য বাংলাদেশের নোবেলজয়ী ড. ইউনুস এমনই এক তত্ত্বের প্রস্তাবনা করেছেন। ২০১৫ সালের ১৮ মে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে সামাজিক ব্যবসা দিবসে তিনি প্রথম থ্রী জিরো তত্ত্ব বা তিন শুন্য তত্ত্ব তুলে ধরেন। এরপর ২০১৭ সালে A world of three Zeros নামক গ্রন্থে তিনি বিশ্বব্যাপি এই তিন শূন্য তত্ত্ব তুলে ধরেন। যা পুরো বিশ্বজুড়ে বেশ গ্রহনযোগ্যতা পেয়েছে। এই তত্ত্বের মাধ্যমে তরুণ প্রজন্মকে কাজে লাগিয়ে এমন এক অর্থনৈতিক ও সামাজিক ব্যবস্থার প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে যার মাধ্যমে কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করা সম্ভব। এই তত্ত্ব মূলত তিনটি লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে: শূন্য কার্বন নিঃসরণ, শূন্য সম্পদ বৈষম্য, এবং শূন্য বেকারত্ব। জেনে নেওয়া যাক আলোচিত এই তত্ত্বগুলো কি কি।
প্রথম লক্ষ্য ‘শূন্য কার্বন নিঃসরণ’ গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন সম্পূর্ণ বন্ধ করার দিকে মনোযোগ দেয়। শিল্পকারখানা, যানবাহন, এবং জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার ক্রমাগত কার্বন ডাই অক্সাইড নির্গমন বাড়িয়ে তুলছে, যা বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রধান কারণ। এই নির্গমন বন্ধ করতে সৌর শক্তি, বায়ু শক্তি এবং জলবিদ্যুৎ শক্তি ও সবুজ প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ানোর ওপর এই তত্ত্বে জোর দেওয়া হয়। যা পরিবেশ বান্ধব অর্থনীতির প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিবে। নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করা গেলে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য টেকসই শক্তি সরবরাহ করা সম্ভব হবে। পাশাপাশি, বনাঞ্চল সংরক্ষণ, গাছ লাগানো, প্লাস্টিক ব্যবহার শূন্যতে নামিয়ে আনা ইত্যাদি বায়ুমন্ডল থেকে অতিরিক্ত কার্বন শোষণ করে পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করতে পারে।
উল্লেখ্য ২০২৪ সালে প্যারিসে অনুষ্ঠিত অলিম্পিক এবং গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিক এর গেমস আয়োজনে থ্রি জিরো তত্ত্বকে মূল থিম হিসেবে রাখা হয়। যেখানে কোনো এয়ারকন্ডিশন ছাড়াই ইন্টরিয়র ডিজাইন এমন ভাবে করা হয়েছিলো যে ভেতরের তাপমাত্রা যেনো বাইরের তাপমাত্রা থেকে ৬° কম থাকে। ফলাফলসরূপ প্রতি বর্গমিটারে ৩০% কম দূষন ঘটে। এছাড়াও কার্বন যুক্ত কংক্রিটের বদলে কাঠের ব্যবহার করা হয়েছিল।
দ্বিতীয় লক্ষ্য ‘শূন্য দারিদ্রে’ বর্তমান অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় বিদ্যমান বৈষম্য দূর করার কথা বলে। যেখানে ড. ইউনুস উল্লেখ করেন যে দারিদ্র্য স্বাভাবিক বা প্রকৃতিগত তৈরী সমস্যা নয়। মানুষ নিজেরাই এই অসম অর্থনৈতিক বন্টন বা পুঁজিবাদী সমাজব্যবস্থা তৈরীর জন্য দায়ী। এই দারিদ্র্যতা থেকে রক্ষা পেতে অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে পুনর্গঠন করতে হবে। যেখানে মাইক্রোফাইন্যান্স গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। এছাড়াও এই লক্ষ্যে টেকসই সমাজব্যবস্থা গড়ার জন্য সমাজিক ব্যবসার মডেল প্রতিষ্ঠিত করতে হবে। যেখানে ব্যক্তিগত লাভের পরিবর্তে সমাজিক সমস্যার সমাধান ও উন্নয়ন প্রাধান্য পাবে। ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের আর্থিক সহায়তা প্রদান, দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য প্রশিক্ষণ কর্মসূচি, এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এই বৈষম্য দূর করার কার্যকর পদ্ধতি হতে পারে।
তৃতীয় লক্ষ্য, শূন্য বেকারত্ব কর্মসংস্থানের অভাব দূর করে সকলের জন্য কাজের সুযোগ সৃষ্টি করার প্রস্তাব করে। নবায়নযোগ্য শক্তি এবং পরিবেশ-বান্ধব শিল্পে বিনিয়োগের মাধ্যমে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করা সম্ভব। সৌর শক্তি উৎপাদন, পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্য উৎপাদন, এবং পরিবেশ সংরক্ষণমূলক প্রকল্পগুলো বিপুল পরিমাণ কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে। পাশাপাশি, অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য তরুন জনগোষ্ঠীকে তাদের সৃজনশীলতা প্রকাশের সুযোগ করে দিতে হবে। দক্ষতাভিত্তিক শিক্ষার প্রসার তরুণ প্রজন্মকে নতুন শিল্পের চাহিদার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে সাহায্য করবে। প্রচলিত চাকরি ব্যবস্থার পিছনে না ছুটে যখন তরুনরা নিজেদের উদ্যাক্তা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে তাদের দক্ষতা ও জ্ঞানকে কাজে লাগাবে তখনই দূর করা সম্ভব হবে দারিদ্র্য ও বেকারত্ব।
থ্রী জিরো তত্ত্বের এই তিনটি লক্ষ্য একসঙ্গে পরিবেশ ও অর্থনীতির উপর বহুমুখী প্রভাব ফেলতে সক্ষম। কার্বন নিঃসরণ কমানো পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি রোধ করবে, যা সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি এবং চরম আবহাওয়ার মতো সমস্যাগুলো থেকে রক্ষা পেতে সাহায্য করবে। একইসঙ্গে, সম্পদ বৈষম্য কমিয়ে এবং কর্মসংস্থান বাড়িয়ে একটি স্থিতিশীল ও ন্যায়সঙ্গত সমাজ গড়ে তোলা সম্ভব।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশের প্রেক্ষাপটে থ্রী জিরো তত্ত্ব অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোর একটি, যেখানে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির কারণে উপকূলীয় অঞ্চলগুলো হুমকির মুখে রয়েছে। নবায়নযোগ্য শক্তির ব্যবহার বাড়িয়ে এই ঝুঁকি অনেকাংশে কমানো সম্ভব। একইসঙ্গে, দেশের ধনী-গরিব বৈষম্য এবং উচ্চ বেকারত্ব সমস্যা দূর করতে এই তত্ত্ব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের সহায়তা করা, পরিবেশ-বান্ধব শিল্প স্থাপন, এবং বৈষম্য কমানোর মাধ্যমে বাংলাদেশ একটি টেকসই উন্নয়নপথে এগিয়ে যেতে পারে।
তবে এই তত্ত্ব বাস্তবায়নে বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ রয়েছে। নবায়নযোগ্য শক্তিতে বিনিয়োগের জন্য প্রয়োজন বিশাল অর্থনৈতিক সংস্থান, যা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য কঠিন। তদুপরি, দুর্বল প্রশাসনিক কাঠামো এবং জনসাধারণের সচেতনতার অভাব বাস্তবায়ন প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে।
সবকিছু সত্ত্বেও, থ্রী জিরো তত্ত্ব ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি উন্নত ও ন্যায়সঙ্গত পৃথিবী গড়ে তোলার পথে একটি দিকনির্দেশনা। জলবায়ু এবং অর্থনৈতিক সমস্যার দীর্ঘমেয়াদি সমাধানের জন্য এই তত্ত্বের কার্যকর বাস্তবায়ন প্রয়োজন। বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশগুলো যদি এই তত্ত্বের নীতিগুলো গ্রহণ করে, তবে একটি টেকসই ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নিশ্চিত করা সম্ভব।
এই রকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন
লেখিকা,
সিরাজুম মুনিরা
ইন্টার্ন,
কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE