যুগে যুগে পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষ এর আবির্ভাব হয় যারা তাদের কঠোর পরিশ্রম, প্রবল চেষ্টা আর অধ্যবসায় দ্বারা সভ্যতার গতি সঞ্চার করেছে। যুগ থেকে যুগান্তর মানুষ তাদের স্মরণ করে, তাদের জীবনীকে অনুপ্রেরণা হিসাবে গ্রহণ করে থাকে। স্টিভ জবস তাদের মধ্যে একজন। যিনি তার পরিশ্রম আর অধ্যবসায় দ্বারা প্রযুক্তির জগৎ বদলে দিয়েছেন।
পরিচয়
জবসের জন্ম ১৯৫৫ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিস্কোতে। তার বাবা ছিলেন আবদুল্লান ফাতাহ জান্দালি আর মা ছিলেন জোয়ান ক্যারোল। তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন তারা তাদের সন্তান কে দত্তক দিবে। প্লল এবং ক্লারা জবস স্টিভ জবস কে দত্তক হিসাবে গ্রহণ করে। নতুন নাম দেয় স্টিভেন পল জবস।
১৯৭২ সালে তার হাইস্কুল জীবনের সমাপ্তি ঘটে। পরবর্তীতে তিনি রীড কলেজ এ ভর্তি হন। মাত্র ছয় মাসে কিন্তু কলেজ ছেড়ে দেন।
কর্মজীবন
জবস ও ওজানয়িক সার্কিট বোর্ড তৈরী করতো এবং তা স্থানীয় কম্পিউটার দোকানে বিক্রি করে অর্থ জোগাড় করতেন।১৯৭৬ সালে, জবস এবং ওজনিয়াক নিজেদের ব্যবসা শুরু করেন। তারা তাদের কোম্পানির নাম দেন “অ্যাপল কম্পিউটার কোম্পানি”। ১৯৮০ সালের ডিসেম্বরে অ্যাপলের কম্পিউটার প্রথমবারের মতো বাজারে আসে।
১৯৮৫ সালে স্টিভ জবস এবং অ্যাপল কোম্পানির সিওর মধ্যে একসময় মতবিরোধ এবং দ্বন্দ্ব বেড়ে যায় ফলে কোম্পানি তাকে প্রত্যাহার করা হলো। তারপর জবস আরও একটি কম্পিউটার কোম্পানি গড়ে তুললেন। যার নাম দিয়েছিলেন নেক্সট ইনকরপোরেটেড।
যা পরে ডিজনির পিক্সার নামে পরিচিতি লাভ করে। পরবর্তীতে নেক্সট এর জনপ্রিয়তার জন্য নেক্সট কেনার চেষ্টা শুরু করে অ্যাপল। ফলে ১৯৯৬ সালে সহ প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে অ্যাপলে তার প্রত্যাগমণ করেন।
পরিবারের আর্থিক অবস্থা তার অনুকুলে না থাকলেও জবসের প্রতিভা, পরিশ্রম দ্বারা তিনি নিজের ভাগ্য গড়তে চেষ্টা করেছেন। তার জীবনের প্রতিটা মূহুর্ত পরিশ্রম দ্বারা সাফল্য অর্জন করেছেন। ২০০৫ সালে স্টান্ডফোর্ড ইউনিভার্সিটির গ্রাজুয়েশন করা স্টুডেন্টের জন্য কিভাবে জীবনে সফল হতে হয় এই নিয়ে স্পিচ দেন এবং ২০০৭ সালে অ্যাপলের প্রথম আইফোন আনাউন্সমেন্টের সময় স্পিচটা সে দেয়। এবং এই স্পিচ টা ধরা হয়ে থাকে business presentation master class।
তার এই বক্তৃতা থেকে কিছু কথা উপদেশ হসেবে গ্রহণ করে আমাদের লক্ষ্যে পূরণে সহায়তা করবে।
- Connecting The Dots
জবস এর দত্তক মা বা তেমন শিক্ষিত ছিলো না এবং তাদের আর্থিক অবস্থা ভালো ছিলো না। কিন্তু তারা জবসের মা বাবাকে কথা দিয়েছিলো তারা তাকে লেখাপড়া শিখাবে। তাই জিবসকে লেখা পড়া শিখানোর জন্য তারা তাদের সারা জীবনের জমানো অর্থ খরচ করে ফেলে। জবস যখন ইউনিভার্সিটিতে পড়ে তখন সে তার মা বাবার আর্থিক অবস্থার কথাবুঝতে পারে এবং যে তখন সে ইউনিভার্সিটিতে ড্রপ আউট হয়ে যায়। কিন্তু ইউনিভার্সিটিতে যে সমস্ত ফ্রি ক্লাসগুলা হয়, এবং সেইগুলোতে অংশগ্রহণ করার জন্য সুযোগ পান। ইউনিভার্সিটি এর ক্যাম্পাসে ক্যালিগ্রাফি খুব বিখ্যাত ছিল। যেটা খুব সুন্দর হ্যান্ডরাইটিংওয়ালা ডিজাইন। এইজন্য সে ক্যালিগ্রাফি ক্লাসে এডেন্ড করা শুরু করে এবং শিখতে পারে কোন ফন্টগুলো সুন্দর এবং কোন লেখাগুলো কিভাবে লিখলে সুন্দর হয়, কোন ডিজাইনে লিখলে লেখা ভালো দেখায় এ সমস্ত বিষয়।
অ্যাপেলের যখন Macintosh কম্পিউটার রিলিজ হয়। সেখানে খুব সুন্দর টাইপোগ্রাফি এবং ফন্ট থাকে। মাল্টিপল টাইপিং এর জন্য তারা সেখানে খুব সুন্দর ভাবে কম্পিউটারে উপস্থাপন করতে পেরেছিল। এবং এটি করার জন্য স্টিভ জবস এর ইনপুট খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই ডিজাইন প্রসেসে
উপদেশ : জবস যখন ক্যালিওগ্রাফি ক্লাস কাজ গুলো শিখছিলেন তখন তিনি জানতেন না এইগুলো তার ভবিষ্যতের জন্য কাজে লাগবে, তার ভাগ্য পরিবর্তন করে দিবে। জীবনের প্রত্যেকটি ঘটনা একটি ডটের মত। এজন্য বলা হয় আমরা যখন ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তা করবো তখন আমাদের মধ্যে এই অবস্থা রাখতে হবে আমরা বর্তমানে যা করছি এই ডট গুলো ভবিষ্যতে আমাদের সাথে সুন্দর ভাবে কানেক্ট হয়ে যাবে।
- Love and loss
জবস এর চেষ্টায় আ্যাপল প্রতিষ্ঠান গড়া। কিন্তু ৩০বছর বয়সে তার গড়া প্রতিষ্ঠান থেকে তাকে বিতাড়িত করা হয়। কিন্তু তারপর ও তিনি নিজের পায়ে ঘুরে দাড়ান। এরপর পরের পাঁচ বছর PIXAR এবং NEXT নামে দুটি কোম্পানি তৈরি করেন। এবং PIXAR হয়ে উঠে বিশ্বের অন্যতম সফল একটি এনিমেশন কোম্পানি। NEXT-এ যেসব আইডিয়া তিনি উদ্ভাবন করতেন, এই আইডিয়ার জন্য তাকে পরবর্তীতে Apple কোম্পানিতে আবার CEO হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়।
উপদেশ : এই বিষয়ে জবস বলেন, আপনি যেই কাজ টি ভালোবাসেন সেই কাজটি না পাওয়া পর্যন্ত শিখতে থাকুন, খুজতে থাকুন।
- Death As A Motivator
যখন তার pancreatic ক্যান্সার টি নির্ণয় করা হয়। তখন তাকে বলা হয় বেঁচে থাকার বেশি সময় নেই।সেই সময় তিনি নিজের কাছে প্রশ্ন করতেন বর্তমানে আমি কিভাবে নিজের সময় কাটাতে চাই।
স্টিভ জবস এর মতে তিনি প্রতিদিন নিজেকে জিজ্ঞেস করতেন “আমি যদি কালকে মারা যায় আমি আজকে যা করছি তা কি করতে থাকতাম নাকি”? এবং অনেকদিন পরে যদি আপনার এই প্রশ্নের উত্তর না পান তাহলে আপনি যা করেছেন তা পরিবর্তন করুন।
তার মতে জীবনে মৃত্যু আসবেই এটা মেনে নিতে হবে,আর এই সত্য টা যখন মেনে নেয়া সহজ হবে তখন বর্তমান জীবনের অনেক ব্যার্থতার ভয় আপনার জীবন থেকে চলে যাবে।
উপদেশ : এজন্য স্টিভ জবস এর উপদেশ হচ্ছে এই পৃথিবীতে আপনার সময় সীমিত । অন্য কারোর জন্য এই পৃথিবীতে আপনার সময় নষ্ট করবেন না। তিনি বিশ্বাস করেন যেহেতু প্রতিটা মানুষের জন্য সময় নির্ধারণ করা তাই মৃত্যুকে একটা মোটিভেশন হিসেবে নিতে।
- Stay foolish, Stay hungry
Stay hungry হচ্ছে, জীবনের লক্ষ্য, উন্নতি করার চেষ্টা এবং কোনো কিছু শিখার ইচ্ছাটা কখনো না হারাতে।
Stay foolish হচ্ছে, সে আইডিয়াটা ধরে রাখতে যে আপনি সব সময় নতুন কিছু শিখতে পারবেন এবং নিজেকে ইমপ্রুভ করতে পারবেন। নিজের লক্ষ্য পূরণে অটুট থাকতে হবে।
উপদেশ : তার উপদেশ হচ্ছে নিজের কৌতূহল এবং নিজের ইচ্ছে কে পরিপূর্ণ করার জন্য ঝুঁকি নিতে হবে, নিজেকে প্রতিনিয়ত উন্নতি করতে হবে, ব্যর্থ হয়ে গেলেও কখনো নিজের উচ্চাকাঙ্ক্ষাটা না হারাতে, এবং নিজের জায়গায় সবসময় স্থির হয়ে বসে না থেকে প্রতিনিয়ত নতুন কিছু আবিষ্কার করা।
২০১১ সালের ৫ই অক্টোবর যুক্তরাষ্ট্রের পালো আলটোতে ৫৬ বছর বয়সে মৃত্যুবরণ করেন প্রযুক্তি জগতের প্রবাদ পুরুষ। স্টিভ জবস, যিনি এক হার না মানা প্রতিভার নাম। তার প্রতিটি উপদেশ তার জীবনের সাথে সংশ্লিষ্ট। যিনি তার প্রতিভা, মেধা, পরিশ্রম দ্বারা বর্তমান বিশ্বকে আরও নতুন ভাবে প্রযুক্তির সাথে পরিচিত হয়ে সহায়তা করেছেন। এই প্রযুক্তি নির্ভর বিশ্ব তাকে স্মরণ করবে যুগ থেকে যুগান্তর।
এরকম আরও ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন।
লেখক
তাবাসসুম আক্তার তাবা
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE