জ্যাকি চ্যান– বিশ্বব্যাপী পরিচিতি পাওয়া এই মার্সাল আর্টিস্ট কে চেনে না এমন কাওকে খুজে পাওয়া দুষ্কর। অনস্ক্রিনে আমরা তাকে এক্টিং করতে দেখেছি কিন্তু তার পেছনের গল্প আমাদের অনেকেরই অজানা।চলুন জেনে নেই তার জীবনের সফলতার গল্প।
জন্ম ও শৈশব:
৭ই এপ্রিল ১৯৫৪, এই দিনটিতেই পৃথিবীতে আগমন ঘটে জ্যাকি চ্যানের। জ্যাকি খুবই দরিদ্র পরিবারের ছিলেন। জ্যাকি চ্যানের জন্মের সময় তারা এতোটাই গরিব ছিল যে হসপিটালের বিল পরিশোধ করার মতো অর্থ তাদের কাছে ছিল না। তখন জ্যাকির বাবা-মা চেয়েছিল তাকে সেই ডক্টর এর কাছে বিক্রি করে দিতে। কিন্তু ডাক্তার তাতে রাজি হয় নি। এরপর জ্যাকির বাবা তার এক বন্ধুর কাছ থেকে টাকা লোন নিয়ে হসপিটালের বিল পরিশোধ করেন। জ্যাকির জন্মের পর তারা হংকং এর ভিক্টোরিয়া পিক ডিস্ট্রিক্ট এ একটি সার্ভেন্ট কোয়ার্টার এ থাকা শুরু করেন। আমরা যাকে জ্যাকি চ্যান হিসেবে জানি তার নাম প্রথমে এটি ছিল না। তার বাবা তার নাম রেখেছিলেন চ্যান কং স্যাং। তার দুরন্তপনা স্বভাবের কারনে পরবর্তীতে তার নিক নেম হয়ে যায় “পাউ পাউ”,যার অর্থ কামানের গোলা!
প্রশিক্ষণ ও প্রাথমিক সংগ্রাম:
জ্যাকি চ্যানের মার্সাল আর্ট এর প্রথম শিক্ষক ছিলেন তার বাবা। মার্সাল আর্ট এর হাতেখড়ি হয়েছে তার বাবার কাছ থেকেই। জ্যাকির বাবা তাকে খুব ভোরে উঠাতেন এবং কুং ফু প্রশিক্ষণ দিতেন। এটি বেশ তাড়াতাড়িই শিখে যাচ্ছিলেন জ্যাকি। কিন্তু পিছিয়ে যাচ্ছিলেন তার পড়াশোনায়। জ্যাকি ছোট বেলায় ডিস্লেক্সিয়া রোগে আক্রান্ত ছিলেন, যেই রোগে অক্ষর চিনতে অনেক অসুবিধা হয়। যার ফলে প্রাথমিকে প্রথম বছরের ফেল করেন। এরপর তার বাবা তাকে চায়না ড্রামা একাডেমিতে ভর্তি করান। জ্যাকি তার জীবনের পরবর্তী ১০ টি বছর কাটিয়ে দেন এখানে। সেই চায়না একাডেমি মূলত স্টুডেন্টদের অপেরা শেখাতো। গানের পাশাপাশি এখানে এক্রোবেটিকস, মার্সাল আর্ট, অভিনয় সব কিছু শেখানো হতো। এই একাডেমিতে থাকাকালীন সময়ে জ্যাকি ‘বিগ এন্ড লিটেল ওং টিন’ নামের একটি মুভিতে ডেব্যু করেন।একাডেমিতে বেড়ে উঠার সময় তিনি এবং তার বন্ধুরা মিলে ‘দা সেভেন লিটল ফরচুন’ নামের একটি পারফরম্যান্স গ্রুপ তৈরি করেন। তারা বিভিন্ন সিনেমাতে স্ট্যান্টম্যান হিসেবে কাজ করতো। একাডেমি থেকে গ্রাজুয়েশন করার পর তিনি হংকং ইন্ডাস্ট্রি তে স্ট্যানটম্যান হিসেবে কাজ শুরু করেন। শুরু দিকে তার কাজ কারোই পছন্দ হতো না। অনেক ডিরেক্টর তাকে ইউজলেসও বলেছিল। বাট জ্যাকির মধ্যে বেশ জেদ ছিল। সে হাল ছাড়ে নি। জ্যাকি নিজেকে নিয়ে আরো কাজ করা শুরু করেন। ধীরে ধীরে হংকং এর কিছু মুভিতে তিনি স্ট্যান্টম্যান হিসেবে কাজের সুযোগ পান। তার বুদ্ধিদীপ্ত ও ভয়ডরহীন স্ট্যান্ট হংকং ইন্ডাস্ট্রি তে তার নাম ডাক বাড়িয়ে দেয়। তিনি লিজেন্ডারি এক্টর ব্রুস লি র সিনেমাতেও স্ট্যান্টম্যান হিসেবে কাজ করেছেন। কিন্তু কয়েকবছর যেতেই হংকং ইন্ডাস্ট্রি ধসে পরে। তখন তিনি বাধ্য হয়ে ফিরে যান অস্ট্রেলিয়াতে তার বাবা-মায়ের কাছে।সেখানে তিনি একটা রেস্টুরেন্ট ও কন্সট্রাকশন সাইটে কাজ করতো। সেখান থেকেই তার নাম হয় জ্যাকি চ্যান। একদিন তার কাছে একটি টেলিগ্রাম আসে যেখানে লেখা ছিল হংকং এর ফেমাস ডিরেক্টর লো উই তার সাথে সিনেমা বানাতে চায়।এরপর জ্যাকি ২১ বছর বয়সে ‘নিউ ফিস্ট অফ ফিউরি‘ সিনেমায় লিড রোল প্লে করেন। ব্রুস লি মারা যাওয়ার পর তার মতো আরেকজনকে আনতে চেয়েছিল ডিরেক্টর লো উই। সেখানে জ্যাকি চ্যান কে আনলেও তার মুভিগুলো সাফল্য পাচ্ছিলো না। জ্যাকি চ্যান ব্রুস লি’র ছায়া থেকে নিজেকে বের করতে চাচ্ছিলেন। তখন ফাইটিং এর পাশাপাশি কমেডি রোল করার কথা ভাবেন। তারপর একের পর এক হিট সিনেমা উপহার দেন জ্যাকি চ্যান।
প্রথম সাফল্য ও চ্যালেঞ্জ :
জ্যাকি চ্যান সিনেমা করতে যেয়ে বহুবার ইঞ্জুরড হয়েছিলেন। ‘ড্রাগন মাস্টার’ সিনেমা করতে যেয়ে আইব্রুয়ের এর নিচের হাড্ডি ফ্রাকচার হয়ে যায়। অন্ধ হয়ে যাওয়ার মতো অবস্থায় চলে গিয়েছিলেন। তাছাড়া নাক ভাংগা, হাত ভাংগা, হাটুর ইঞ্জুরি-এগুলো তার জন্য ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। তবে তার ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় এক্সিডেন্ট ঘটে ‘দা আর্মোর অফ গড’ মুভির একটা স্ট্যান্ট করতে যেয়ে। তার স্ক্যাল্প ফেটে যায়।পরবর্তীতে সেখানে মেটাল প্লেট বসানো হয়। নানা সময়ে নানা সমস্যার মুখোমুখি হন তিনি। সেগুলো কাটিয়ে উঠে কয়েক বছরেই তিনি হংকং ইন্ডাস্ট্রি তে সর্বোচ্চ পারিশ্রমিকের অভিনেতা বনে যান। ‘স্নেক ইন দা ঈগলস শ্যাডো’ ছিল তার প্রথম সফল হিট সিনেমা। জ্যাকি নিজেকে আরো দূর নিয়ে যেতে চেয়েছিলেন। তাই তিনি এরপর পারি জমান হলিউডে। তবে সেখানে গিয়ে সুবিধা করতে পারেন নি। কয়েকটা ফ্লপ মুভির পর তিনি আবার হংকং ফিরে আসেন। দশ বছর নিজেকে আরো ঢালাওভাবে তৈরি করেন। এরপর ‘রাম্বেল ইন দা ব্রনক্স’ মুভির মাধ্যমে তিনি হলিউডের অডিয়েন্স এর কাছে জায়গা করে নেন। এরপর আরো বেশ কিছু ব্লকবাস্টার সিনেমা উপহার দেন জ্যাকি চ্যান।
বিশ্বজুড়ে জনপ্রিয়তা:
জ্যাকি চ্যানের জনপ্রিয়তা সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। হংকং থেকে চায়না, আমেরিকা থেকে পুরো বিশ্ব-সকল জায়গায় জ্যাকি চ্যান পরিচিত মুখ। তার ভয়ডরহীন স্ট্যান্ট, একটিং স্কিল দিয়ে মন জয় করে নিয়েছেন সবার। তার বেশ কিছু ব্লকবাস্টার সিনেমার মধ্যে রয়েছে- রাশ আওয়ার, ড্রানকেন মাস্টার, পুলিশ স্টোরি, দা স্পাই নেক্সট টু ডোর, প্রোজেক্ট এ ইত্যাদি। সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি তে তার সাফল্যের জন্য ২০১৬ সালে তিনি অস্কার পান। তার প্রভাব সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি ছাপিয়ে পৌছে গেছে নতুন প্রজন্মের কাছে।
জ্যাকি চ্যান শুধু একজন অভিনেতা নয়, তিনি অনেকের কাছে এক আবেগের নাম, এক অনুপ্রেরণার নাম। কিভাবে ধৈর্য ও ডেডিকেশন এর সাথে কাজ করে শত বাধা বিপত্তি ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা যায় তা তার থেকে আমরা শিখতে পারি। প্রজন্মের পর প্রজন্ম মনে রাখবে এই অস্কার জয়ী অভিনেতাকে।
এরকম আরো ব্লগ পরতে, ক্লিক করুন
লেখক,
পিয়াস মাহমুদ
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE