জয়নুল আবেদীন বলেছিলেন, ‘এখনতো চারিদিকে রুচির দুর্ভিক্ষ! একটা স্বাধীন দেশে সুচিন্তা আর সুরুচির দুর্ভিক্ষ! এই দুর্ভিক্ষের কোনছবি হয়না।‘ কিন্তু তুফান চাকমা সেই অদৃশ্য দুর্ভিক্ষের ছবি আঁকেন—তুলির আঁচড়ে ফুটিয়ে তোলেন হারিয়ে যাওয়া কণ্ঠ, বিস্মৃত যন্ত্রণারচিত্র। তার ক্যানভাসের রঙ শুধু রঙ নয়, প্রতিটি রেখা যেন এক একটি গল্প, যেখানে আদিবাসীদের অস্তিত্ব সংকট, হারিয়ে যাওয়া সংস্কৃতি ও ন্যায়বিচারের আর্তনাদ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। নিঃশব্দ বঞ্চনাকে তিনি রঙে রূপদেন, আঁধারের মাঝে ছড়িয়ে দেন আলো। তার শিল্পকর্ম কেবল দৃশ্যমান নয়, বরং অনুভবযোগ্য— এক একটি প্রতিবাদ, এক একটি ইতিহাস, এক একটি অনন্ত সত্য।
YSSE: আপনার শৈশব, শিক্ষাজীবন এবং বর্তমানে কী করছেন, সে সম্পর্কে কিছু বলুন।
তুফান চাকমা: আমি খাগড়াছড়ির দীঘিনালা উপজেলার উদাল বাগান গ্রামে বড় হয়েছি। প্রাথমিক শিক্ষা নিয়েছি উদাল বাগান সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে এবং মাধ্যমিক শিক্ষা উদাল বাগান উচ্চ বিদ্যালয়ে সম্পন্ন করেছি।
এসএসসি শেষ করার পর খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজে ভর্তি হই।এরপর এইচএসসি শেষ করে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা বিভাগে ভর্তি হই এবং সেখান থেকে চারুকলায় স্নাতক সম্পন্ন করি।
বর্তমানে আমি ইরাসমাস মুন্ডাস স্কলারশিপ নিয়ে ফিনল্যান্ডের Aalto University–তে অ্যানিমেশন বিষয়ে পড়াশোনা করছি এবং আমার কাজে আরও এক ভিন্নমাত্রা যোগ করার জন্য শিক্ষা নিচ্ছি।
YSSE: আপনার শিল্পচর্চার শুরুটা কেমন ছিলো? সেখানে আপনার উল্লেখযোগ্য কাজ সম্পর্কে যদি আমাদের কিছু বলতেন।
তুফান চাকমা: শুরু থেকে যদি বলি, আমি কোনো তথাকথিত শৈল্পিক পরিবার থেকে আসিনি। বাবা কৃষিকাজ, মা ‘বেন‘ বুনে ছোটবেলা থেকে আমার পড়ালেখার খরচ যুগিয়েছে। ছোটবেলা থেকে পড়ালেখায় প্রচন্ড মনযোগী ছাত্র ছিলাম এবং বিশেষ করে আমার মা আমাকে পড়ালেখার জন্য সবসময়ই উৎসাহিত করতেন।
একটা কথা সারাজীবন মনে থাকবে যেটা মা আমাদের দুই ভাইকে বলতেন, ‘পাতা বেঁচে হোক, লাকড়ি বেঁচে হোক আমি তোমাদের পড়ালেখার খরচ যোগাবো।‘ নিজে পড়ালেখার সুযোগ না পেলে কি হবে, আমার মা, আমার বাবা ছোটবেলা থেকে আমার পড়ালেখার খরচ যোগাতে নানা প্রতিবন্ধকতা স্বত্বেও বিন্দুমাত্র ছাড় দেননি।
তবে, আঁকাআকি করার বিষয়টা সম্পূর্ণ আলাদা ছিল। যেহেতু, আমাদের গ্রামের স্কুলে পড়ালেখা করেছি, জাতীয় পাঠ্যপুস্তকগুলোই ছিল পড়ালেখার একমাত্র আধার। ছবি আঁকা শেখা, ছবি আঁকা নিয়ে পড়ালেখা করা, উচ্চশিক্ষা নেয়া এইসব বিষয়ে বিন্দুমাত্রও জ্ঞাত ছিলাম না।
এমনকি আমার নিজের মধ্যেও ছোটবেলায় অমন কিছু সুপ্ত বাসনা কাজ করতো না যে, আমি বড় হয়ে ছবি আঁকাআকিকেই লক্ষ্য হিসেবে বেছে নিব।
তবে, এটুকু বলতে পারবো যে, ছবি আঁকতে আমার প্রচন্ড ভালো লাগতো, এক ধরনের শান্তি পেতাম। রং, ড্রইং খাতা কিছুই ছিলো না, লেখার কলম আর জ্যামিতি আঁকার পেন্সিল দিয়ে গণিত খাতা বা বইয়ের খালি জায়গায় পাঠ্যপুস্তকের ছবিগুলো দেখে দেখে আঁকতাম। আমার স্কুলের বন্ধুরা প্রচন্ড উৎসাহ দিতো তখন যে, আমি নাকি সুন্দর আঁকি। এইসব কদর আমাকে আস্তে আস্তে ছবি আঁকার সাথে ছোটবেলা থেকে আরও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ফেলে।
এসএসসি পরীক্ষার পর খাগড়াছড়ি সরকারি কলেজে পড়াকালে আমার এক জেঠিমার বাসায় থাকতাম। তার ছেলে খাগড়াছড়ি ক্যান্টনমেন্টের ছাত্র হওয়ায় তার কাছে রঙয়ের বক্স ছিল। সেসময় জীবনে প্রথমবার আমি রঙ দিয়ে ছবি এঁকেছিলাম তার ড্রইং খাতায় যে ছবিটা এখনও জেঠিমা বাড়িতে রেখে দিয়েছেন।
তারপর, এইচএসসি সম্পন্ন করার আগে পরে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা সম্পর্কে অবগত হই। জানতে পারি যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারুকলা নামক একটি বিষয় আছে যেখানে আঁকাআঁকি নিয়ে পড়ানো হয়। সেসময় পর্যন্ত খাগড়াছড়ি আমার কাছে দুনিয়ার সবচেয়ে বড় শহর ছিল। তবে, যখন আমি সিদ্ধান্ত নিলাম যে, আমি ঢাকা গিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়বো তখন আমাদের পারিবারিক অবস্থার কথা চিন্তা করে অনেকেই যেতে মানা করে।
যাহোক, কোনো প্রকার কোচিং বা গাইডলাইন ছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা দিলাম। যা হবার তা–ই হলো। সেখানে আমি উত্তীর্ণ হতে পারিনি। কিন্তু পরের বার জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনটি বিভাগে উত্তীর্ণ হই। এদের মধ্যে চারুকলা বিভাগে মেধাতালিকায় ৬ নং-এ আমার স্থান হয়, যেটা আমার নিজের কাছেই অবিশ্বাস্য লাগছিলো ফলাফল দেখে। কেননা, আমি যে ভর্তি পরীক্ষা দিয়েছিলাম, তাতে নেগেটিভ মার্কিং নিয়ে পর্যন্ত আমার পরিষ্কার কোনো ধারণা ছিলো না, যেগুলো হয়তো এখন মানুষের কাছে সাজানো কাহিনী মনে হতে পারে। কিন্তু, সেসময় আমার সেরকম পরিচিত কেউই ছিলো না যার কাছ থেকে আমি পরিষ্কার ধারণা পেতে পারতাম।
বিশ্ববিদ্যালয় শুরুর দিকে চারুকলা বিভাগে আসলে কী নিয়ে পড়ানো হতো তা নিয়ে ধারণা ছিলো না৷ এমনকি চারুকলা নিয়ে পড়াশোনা করে আমি ভবিষ্যতে কী করব সেটা নিয়েও ভাবনা ছিলো না। শুধু ভালোবাসার জায়গা থেকে এই বিভাগের সাথে জড়িয়ে পরবর্তীতে আস্তে ধীরে ছবি আকাঁআঁকির একাডেমিক বাঁধাধরা নিয়মগুলো শেখা শুরু করেছিলাম সেসময়।
যদি আমার উল্লেখযোগ্য কাজের কথা বলতে চাই, তাহলে বলতে হয় যে, ২০১৮ সালে আঁকা আমার এক পেনস্কেচ, আমার শৈল্পিক সত্তা বিকাশে গোড়াপত্তন করেছিল যা মূলত ছিল সেসময় দিঘীনালা–খাগড়াছড়ি সড়কে নয় মাইল এলাকায় এক ত্রিপুরা আদিবাসী মেয়ের ধর্ষণ হওয়ার প্রতিবাদ স্বরূপ আঁকা একটা ড্রইং। সেসময় এই ঘটনা নিয়ে হাতেগোনা কয়েকটা অনলাইন ভিত্তিক পত্রিকা ছাড়া তেমন কোনো লেখালেখি, খবর কিছুই দেখা যায় নি যা আমাকে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছিল যে, এই শূন্যতা পূরণে আমি কি করতে পারি?
ছবিটি ফেসবুকে আপলোড করার পরপরই দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়েছিল এবং এক ঘন্টায় এক হাজারের বেশি বার শেয়ার করা হয়েছিল। তবে, এক ঘন্টা পরেই ছবিটি ফেসবুক রেস্ট্রিকটেড করে দিয়েছিল।
তখন থেকে সেই যে আমি শুরু করলাম এসব অশ্রুত, অদেখা, অজানা আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীর জীবনের গল্প বলার আরেক গল্প, সেসময় থেকে আমি চেষ্টা করছি আমাদের আদিবাসীদের বর্ণিল সংস্কৃতির পেছনেও যে অসংখ্য বোবাকান্না লুকিয়ে আছে, সেসব কান্নার ভিজ্যুয়াল প্রেজেন্টেশন করার, যাতে করে আদিবাসীদের বিরুদ্ধে যত অপপ্রচার আমরা দেখতে পাই, যত বানোয়াট তথ্য আমরা শুনতে পাই সেগুলোর প্রকৃত সত্য কিছুটা হলেও আমার শিল্পচর্চার মাধ্যমে তুলে আনতে সক্ষম হই।
YSSE: একজন আদিবাসী ভিজুয়াল আর্টিস্ট হিসেবে আপনার শৈল্পিক যাত্রা কতটা চ্যালেঞ্জিং ছিলো?
তুফান চাকমা: শৈশবে আঁকাআকি নিয়ে প্রাথমিক বা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা না থাকা এবং বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা নিয়ে বিশেষ করে শুরুর দিকে অনেক কাঠখড় পোহাতে হয়েছে। ২০১৪ সালে ঢাকায় পা রাখার পর থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত টানা ৪ বছর টিউশনি পড়িয়েছি। নিজের খরচ নিজেই চালাতাম, পরিবার থেকে টাকা নিতাম না সেসময় থেকে। এদিকে প্রত্যেক সপ্তাহে ক্লাসের সাবমিশনের জন্য রং, পেন্সিল, পেপার, তুলি, ক্যানভাস এগুলো কিনতেই বেশিরভাগ টাকা চলে যেতো। এইসব বাস্তবতা সামাল দিতে দিতে সেই সময়ে নিজের আর্টিস্টিক সত্ত্বা বিকাশে মনোনিবেশ করাটা আমার জন্য প্রচন্ড চ্যালেঞ্জিং ছিলো। মাঝে মাঝে তাই মনে হয়, সেই সময়ে যদি এই বিষয়গুলো নিয়ে এসব ঝামেলা না থাকতো, হয়তো এরচাইতে আরও ভালো কিছু করতে পারতাম।
তবে, ২০১৭–২০১৮ সালের দিকে পার্বত্য চট্টগ্রামের রাঙামাটি এবং খাগড়াছড়ি জেলায় ঘটে যাওয়া বেশ কয়েকটি সাম্প্রদায়িক হামলার ফলে, যে এক অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছিল, তা আমার ভাবনার জগতে নতুন আলোড়ন তুলেছিল। আমি আদিবাসী হিসেবে নিজেদের অবস্থান, নিজেদের পরিচয়, অস্তিত্ব সবকিছু নিয়ে নতুনভাবে উপলব্ধি করতে শুরু করলাম, এগুলো নিয়ে কাজ করার তাগিদ অনুভব করলাম।
আমি তখন থেকে আমার ফেসবুক প্রোফাইল থেকে আস্তে আস্তে আমার চিন্তাগুলোর দৃশ্যমান রূপ আপলোড করা শুরু করি এবং পরিচিত লোকদের কাছ থেকে ইতিবাচক সাড়া পাওয়া শুরু হয়। তখন আমাকে অনেকেই অনেকভাবে বললো যে, এই বোবাকান্নার আওয়াজ গুলো দেয়াল ভেদ করে আসাটা কতোটা গুরুত্বপূর্ণ।
এরপর যত কাজ করতে লাগলাম, ততো নিজের মধ্যে প্রগাঢ় দায়িত্ববোধ অনুভব করতে লাগলাম। কাজ করতে গিয়ে পার্বত্য চট্টগ্রাম এবং চাকমা ছাড়াও এখানকার অন্যান্য আদিবাসী জাতিগোষ্ঠীদের ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি সবকিছু নিয়ে জানার আগ্রহ দিনদিন বাড়তেই লাগলো। আমিও যত জানতে লাগলাম, ততো নিজের মধ্যে এক ছটফট করা শিল্পসত্তার তিলতিল করে বেড়ে ওঠা অনুভব করতে লাগলাম। আমি খেয়াল করতে থাকলাম, কিভাবে পাহাড়ের রূপ বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছে দিনদিন, কিভাবে উন্নয়ন বা বিভিন্ন অজুহাতে বছরের পর বছর আদিবাসীদের উচ্ছেদ প্রকল্প অব্যাহত রাখা হয়েছে, কিভাবে এক আগ্রাসী শক্তি আদিবাসীদের অস্তিত্ব সংকটে ফেলানোর জন্য নানা কৌশলে কাজ করে যাচ্ছে। এছাড়াও নতুন প্রজন্মের দিনদিন নিজস্ব সংস্কৃতি বা শেকড়ের থেকে ক্রমাগত দূরে সরে যাওয়ার বিষয়গুলো আমাকে আমার কাজ অব্যাহত রাখা বা আরও বড় পরিসরে, নতুন আঙ্গিকে করার জন্য প্রতিনিয়ত ইন্ধন যোগাচ্ছে।
YSSE: আন্তর্জাতিক পর্যায়ে আপনার শিল্পকর্মের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?
তুফান চাকমা: বাংলাদেশে বেশ ভালো ভালো আর্টিস্ট রয়েছে যাদের কাজ দেখলে মাঝে মাঝে বেশ হীনমন্যতায় পড়ি, কারণ তাদের তুলনায় আমি নিতান্তই তুচ্ছ৷ এমনকি এখনও আমি এগুলো নিয়ে স্ট্রাগল করছি প্রতিনিয়ত আরও ভালো কিছু আঁকার, আরও ভালো করে আঁকার জন্য। তবে ২০২৩ সালে অর্জিত প্রথম আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি সত্যিই আমাকে অনুপ্রাণিত করেছে, আমার আত্মবিশ্বাসকে দৃঢ় করেছে, নতুন করে দায়িত্ববোধ জাগিয়েছে।
আমি যেরকমটা বললাম, আমার শিল্পচর্চার শুরুই হয়েছিল একদম প্রকৃতির নিয়মে, কোনো প্রতিষ্ঠানের বাঁধাধরা নিয়মের গন্ডিতে নয়। বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার আগ পর্যন্ত আমি স্বাধীনভাবে নিজের মত করে যা ইচ্ছা তাই আঁকতাম। এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির পর যখন থেকে নিজের মধ্যে সত্যিকারের এক শিল্পসত্তাকে খুঁজে পেলাম, তখনও একদম ব্যক্তিগত প্রেরণা বা অনুভূতি থেকে আঁকতাম। তখন ওইসব পুরষ্কার বা প্রতিযোগিতা কোনোকিছু নিয়ে পরিচিত ছিলাম না।
এভাবে হতে হতেই আমাদের অব্যক্ত কথার গল্প বলার তাড়নায় কোভিডের সময় ২০২০ সালে আমি ‘TUFAN’S ARTBIN’– এর যাত্রা শুরু করি, যা আজ আমাকে পরিচিত করেছে সবার কাছে। একদম শুন্য থেকে শুরু করা এই পথচলা আমার জীবনের গতিপথ নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে চলেছে, তাতে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই।
আমি প্রথম যেই এওয়ার্ডটি পাই সেটা International Art Contest for Minority Artists 2023 যা জাতিসংঘের OHCHR সংস্থা কর্তৃক প্রদত্ত এক পুরষ্কার যার Theme ছিলো Intersectionality. সেই সময়, পদ্মিনী (পদ্মিনী চাকমা, Winner of Indigenous Community Grant, Bangladesh Press Photo Contest 2023) আমায় জানায়, আমি যেহেতু এই ধরণের পেইন্টিং নিয়ে কাজ করি সেহেতু আমি OHCHR–এ আমার কাজটি সাবমিট করতে পারি। আমি একদম শূন্য প্রত্যাশা রেখে শুধু নিজের কাজের গ্রহনযোগ্যতা পরীক্ষা করার জন্য আবেদন করেছিলাম যা সত্যি সত্যিই আমাকে ওই বছরের আটজন বিজয়ী শিল্পীর একজন হিসেবে বানিয়েছিল। এটাই আমার কাজের প্রথম কোনো স্বীকৃতি, তাও আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি। এই অর্জনের অভিজ্ঞতা আমার শিল্পসত্তাকে পরবর্তী ধাপে নিয়ে যাওয়ার আরেকটা বড় অধ্যায় হিসেবে থাকবে।
আমরা যদি বিভিন্ন আর্টিস্টের জীবনী পড়ি, খেয়াল করবেন ছোটবেলা থেকে প্রায় আর্টিস্টদের অনেক অর্জন থাকে। কিন্তু, শৈশবের এ অধ্যায়টা আমার জীবনের সাথে ঘটার সুযোগ পায়নি। তবে, আমার জীবনের এই প্রথম স্বীকৃতি আমার মনে বিশ্বাস এনে দেয় যে, হ্যাঁ আমি আমার জাতির জন্য কিছু একটা করছি এবং এটা যে কেউই পারবে না। সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত Award Giving Ceremony–র মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমার মা–কে নিয়ে কথা বলার অভিজ্ঞতাটাও আজীবন মনে থাকবে। বিশেষ করে জেনেভায় যাওয়া আর থাকা, ফিরে আসা নিয়ে ৭ দিনের যাত্রা এতটাই ঘটনাবহুল এবং নাটকীয় যে, এই অভিজ্ঞতা আমার শিল্পসত্তা বিকাশের পাশাপাশি আমার ব্যক্তিগত সত্তা বিকাশেও যে অনন্য, তা আমি ছাড়া আর কেউ ভালো বলতে পারবে না। এরপর আমি ২০২৪ সালে PRINCE CLAUSE SEED AWARDS অর্জন করি যা আমার জীবনের আরেকটা গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়।
তবে, আমার জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে ২০২৪–২৬ ইনটেকে ERASMUS MUNDUS SCHOLARSHIP অর্জন, যেটার মাধ্যমে আমি বর্তমানে ইউরোপের তিনটি দেশ যথাক্রমে বেলজিয়াম, ফিনল্যান্ড এবং পর্তুগালে এনিমেশন বিষয়ে মাস্টার্স ডিগ্রী নিয়ে পড়ালেখা করছি। আশা করি, জীবনের এই মোড় আমার গল্প বলার মাত্রাকে এক নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরতে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে অদূর ভবিষ্যতে।
YSSE: আপনার লাইফ মোটো যদি আমাদের সাথে শেয়ার করতেন।
তুফান চাকমা: আমি আসলে ভবিষ্যতে কী করব তা নিয়ে এখন ভাবি না। কাজ করতে করতে আমার সামনে যা পড়ে, যা করার জন্য ভিতর থেকে তাগিদ অনুভব করি, আমি তা–ই করি।
তবে, এটুকু বলতে পারি, যেহেতু আমি এখন ফিনল্যান্ডে অ্যানিমেশন নিয়ে মাস্টার্স করছি, সেহেতু আমাদের মাস্টার্স স্টাডির অংশ হিসেবে একটা ফাইনাল এনিমেশন শর্ট ফিল্ম বানাতে হবে। বর্তমানে এটা নিয়েই ব্যস্ত আছি এবং আশা করি জীবনের প্রথম এনিমেশন ফিল্মের মাধ্যমে আমার গল্প বলার মাত্রাকে এক ভিন্ন লেভেলে নিতে পারবো।
এছাড়াও, পেইন্টিং এ ফিরে যাওয়ার পরিকল্পনা করছি। অনেকদিন ধরে ক্যানভাসে ছবি আঁকার ক্ষুধা নিয়ে দিনাতিপাত করছি। আর অ্যানিমেশন যেহেতু শিখছি, অ্যানিমেশনের মত শক্তিশালী এবং প্রভাবশালী মাধ্যমে এতদিন ধরে জমিয়ে রাখা গল্পগুলোর প্রাণদান করার জন্যও চলবে নানা কাজ। সব ঠিকঠাক থাকলে একটা পূর্ণদৈর্ঘ্য এনিমেশন ফিল্ম ও বানানোর ইচ্ছা আছে।
এছাড়া পার্বত্য চট্টগ্রামের আদিবাসীদের বিভিন্ন পাড়ায় গিয়ে গিয়ে আমার করা শিল্পকর্ম এবং এনিমেশনের প্রদর্শনীর আয়োজন করার ইচ্ছে অনেকদিনের। কোনো তথাকথিত শহুরে গ্যালারির চেয়ে যাদের নিয়ে কাজ করি, তাদের জায়গায় গিয়ে, তাদেরকে নিয়ে এক্সিবিশন করার ইচ্ছা আমার অনেকদিনের।
এছাড়াও শিক্ষাদানেরও ইচ্ছে আছে।
YSSE: তরুণ শিল্পী এবং পাঠকদের উদ্দেশ্যে আপনার পরামর্শ কী হতেপারে?
তুফান চাকমা: প্রথম যে বিষয়টা বলবো, সেটা হচ্ছে নিজেকে জানা। বর্তমান প্রজন্মের সবচেয়ে বড় সংকট নিজেকে না চেনা। আজকাল সবকিছুর এত এত অপশনের ভিড়ে আমি কি চাই, আমি কে এ প্রশ্নগুলো নিজেকে করার কোনো সময়ই যেন আমাদের নেই। যখন এগুলো আমরা উপলব্ধি করি, তখন অনেক দেরি হয়ে যায়।
দ্বিতীয় পরামর্শ হবে, টেকনোলজির পজিটিভ দিকগুলোর সাথে নিজেদের পরিচিত করানো। তবে টেকনোলজির সাথে সংযোগস্থল দৃঢ় করতে গিয়ে নিজেদের শেকড় থেকে যেন দূরে সরে না আসি। বরং, আমাদের চেষ্টা করতে হবে এই প্রযুক্তিকে কাজে লাগিয়ে কিভাবে আমাদের শেকড়কে আরও শক্ত করে গাড়তে পারি যাতে বিশ বছর পর আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের ভবিষ্যত সংকট না হয়।
তৃতীয়ত, এটা পরামর্শ না, অনুরোধ থাকবে, স্রোতে গা ভাসিয়ে না দিয়ে আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী হিসেবে আমাদের বর্তমান অস্তিত্বের সংকট অনুধাবন করে নিজেদের মধ্যে দায়িত্ববোধ নিয়ে আসা। যে যার অবস্থান থেকে সমাজে ইতিবাচক পরিবর্তন আনার ক্ষেত্রে কাজ করার তাগিদ অনুভব করা, আদিবাসী জাতিগোষ্ঠী হিসেবে ব্যক্তিসত্তার উপরে সামগ্রিক সত্তাকে গুরুত্ব দেয়া।এটাই আমাদের আদিবাসী জাতিসত্তার মূল শিক্ষা।
LinkedIn: https://www.linkedin.com/in/tufan-chakma-7ab28a222
Facebook page: https://www.facebook.com/tufansArtbin
এই রকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন
লেখক
জেমি সাইলুক
ইন্টার্ন, কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE