বাংলা সাহিত্য ইতিহাসে রহস্য ও গোয়েন্দা কাহিনির বিকাশ সেই উনিশ শতকে। ফেলুদার আগে,ব্যােমকেশেরও আগে ছিলেন এক বাঙালি গোয়েন্দা, দারোগা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়। মূলত যাদের হাত ধরে বাংলা সাহিত্যে রহস্য ও গোয়েন্দা গল্পের অগ্রযাত্রা তাদের মধ্যে অন্যতম হলেন দারোগা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়। তার লেখা “দারোগার দপ্তর” গ্রন্থটি বাংলা সাহিত্যে রহস্য ও গোয়েন্দা কাহিনির এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেন। আজ আমরা জানার চেষ্টা করব কীভাবে এবং কতটা গভীরভাবে প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যে প্রভাব ফেলেছেন এবং পরবর্তী লেখকদের অনুপ্রেরণার উদাহরণ হয়েছেন।
প্রিয়নাথের জীবন ও কর্মজীবন
প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় (৪ জুন, ১৮৫৫- ২০জুন, ১৯৪৭) ছিলেন ব্রিটিশ ভারতের একজন পুলিশ কর্মকর্তা এবং বাংলা সাহিত্যের গোয়েন্দা ও রহস্য কাহিনির পথপ্রদর্শক। তিনি ১৯শ শতকের শেষভাগে ব্রিটিশ ভারতের পুলিশ বিভাগে দারোগা পদে কর্মরত ছিলেন। দারোগা পদে কর্মরত অবস্থায় তিনি বিভিন্ন অপরাধ তদন্ত করেন,অপরাধীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করেন এবং সেই তদন্তের সমাধান করেন। তিনি তার তুখড় বিচারবুদ্ধি ও পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা কাজে লাগিয়ে বহু জটিল অপরাধ সমাধান করতে সক্ষম হন। কর্মজীবনের এমন বিচিত্র অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে তিনি “দারোগার দপ্তর” নামক গ্রন্থটি লিখে প্রকাশিত করেন। জনগণের কাছে সমাজের অপরাধের চিত্র,তদন্ত পদ্ধতি,অপরাধী চিহ্নিতকরণের বিষয়গুলো তুলে ধরার জন্য সাহিত্য একটি উপযুক্ত মাধ্যম হতে পারে যেকারণে তিনি গ্রন্থটি লেখার সিদ্ধান্ত নেন।
প্রিয়নাথের কিছু লেখা
১৮৭৮-১৯১১ সাল পর্যন্ত প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায় চাকরি করেন কলকাতা পুলিশে। তার দীর্ঘ ৩৩ বছরের কর্মজীবনে তিনি অপরাধ সংত্রান্ত বিভিন্ন অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হন যা তিনি “দারোগার দপ্তর’ নামে বাংলা ভাষার প্রথম ক্রাইম ম্যাগাজিনে তুলে ধরেন। গ্রন্থটির কয়েকটি খন্ড রয়েছে,যার কিছু গল্প আজকে তুলে ধরব।গ্রন্থটির প্রথম খন্ডে প্রকাশিত হয় আসমানী লাশ নামক গল্পটি। শুরুতেই দেখা যায় বর্ষাকালের কোনো এক দুপুরে দারোগা প্রিয়নাথের কাছে একটা চিঠি আসে যেখানে এক সম্ভ্রান্ত বড়লোক সাহায্য চেয়ে চিঠিটি লিখেছেন। দারোগা চিঠি পড়া মাত্রই ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন এবং জানতে পারেন বাড়ির চিলেকোঠার ঘরে একটা বাক্সবন্দী অর্ধগলিত লাশ পাওয়া যায়। বাড়ির সবাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করেও কোনো সুরাহা হল না।তদন্তের খাতিরে তিনি খোঁজ পান বাগানের পেছনে যে বাড়িগুলো ছিল তার মধ্যে একটা বাড়িতে থাকতেন রাম গোপাল বিশ্বাস। স্ত্রীর সাথে তার বিভিন্ন কারণে ভনিভনা ছিল না যার জেদ ধরে নিজেই স্ত্রীকে খুন করেন এবং সুযোগবুঝে লাশ বাক্সবন্দী করে চালান করেন।
দারোগা দপ্তরের ৭০ তম সংখ্যায় প্রকাশিত হয় “বেওয়ারিশ লাশ” নামক গল্পটি। গল্পের শুরুটা হয় জোড়াবাগান থানায় আসা বাক্সে বন্দী চটে জড়ানো এক লাশ নিয়ে। দারোগা প্রিয়নাথ অফিসের বাইরে পায়চারি করছিলেন এমতাবস্থায় কানে আসলো পাশের থানায় আসা বেওয়ারিশ লাশের ব্যাপারে। থানায় গিয়ে দেখলেন মৃতদেহটি পুরুষের,বয়স আনুমানিক ৩০। মাথার বাঁদিকে একটা কালো দাগ ছাড়া সারা শরীরে আর কিছুই নেই। তবে বাক্সের ভেতরে একটা ঔষধের শিশি পাওয়া যায় যা কোনো সাহেবের নামে ছিল। কিন্তু এভাবে লাশ শনাক্ত করা যাচ্ছিলো না। অতঃপর লাশের আশেপাশে ঘিরে থাকা দুজন ব্যক্তির কাছ থেকে জানা গেল,লাশটি তালতলা বস্তিতে থাকা মেহের আলীর জামাইয়ের। লোকটির নাম রব্বানী এবং পেশায় ছিলেন রাজমিস্ত্রী যিনি কিনা তার শশুর মেহের আলীর কাছ থেকে ৫/৭ টাকা পেতেন। কোনো এক দুপুরে ঘরে বাজার না থাকায় শশুরের কাছ থেকে পাওনা টাকা ফেরত নিতে যান তারপর থেকে নিখোঁজ। যাকিনা পুলিশ অনুসন্ধান করে জানতে পারে,ওখানে পাওনা টাকা নিয়ে জামাই শশুরের মধ্যে তর্কাতর্কি হয়, একপর্যায়ে মেহের আলীর হাতে জামাই রব্বানী মারা যায়। লাশ লুকাতে মেহের আলী তার ঘরে থাকা বাক্সে লাশ রেখে গঙ্গার ধারে ফেলে দেন। যেটা শুরুতে থানায় হস্তান্তর করা হয়েছিল।
প্রিয়নাথের সাহিত্যিক বৈশিষ্ট্য
দারোগা প্রিয়নাথ মুখোপাধ্যায়ের লেখনীর প্রধান আকর্ষণ ছিল সহজ-সাবলীল ভাষার প্রয়োগ। তার “দারোগার দপ্তর” গল্পের একাধিক খন্ডে(প্রথম খন্ড প্রকাশিত হয় ১৮৯২ সালে) শুধু অপরাধ ও তদন্তই তুলে ধরেননি বরং ব্রিটিশ শাসন,বিচারব্যবস্থার ত্রুটি,নারী নির্যাতন-এসব বিষয় তার লেখা মাধ্যমে উঠে এসেছে। তার লেখার মাধ্যমে অপরাধের বিবরণ উপস্থাপন,রহস্যের ধাপে ধাপে উন্মোচন, তদন্তের পদ্ধতিগত দিক বিশদভাবে তুলে ধরেছেন যেকারণে গ্রন্থটি দ্রুতসময়ে পাঠক হৃদয়ে গ্রহণযোগ্যতা পায়। এই ধরনের লেখা প্রথমবার বাংলাভাষায় আত্মপ্রকাশ করে এবং পরবর্তীকালে তার লেখা বহু লেখকদের জন্য দিকনির্দেশনা হিসেবে কাজ করে।
বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যে তার প্রভাব
প্রিয়নাথের লেখা “দারোগার দপ্তর” বাংলা সাহিত্য রহস্য ও গোয়েন্দা গল্পের ভিত্তি স্থাপন করেন, যা পরবর্তী বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যের ওপর বিস্তর প্রভাব ফেলেছে। এক্ষেত্রে প্রথমেই মাথায় আসে সত্যজিৎ রায়ের লেখা ফেলুদা, যা বাংলা সাহিত্যের অন্যতম জনপ্রিয় গোয়েন্দা চরিত্র। আরেকটি অন্যতম গোয়েন্দা চরিত্র “ব্যােমকেশ বক্সী” যেটি শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃষ্ট। ব্যােমকেশ এবং ফেলুদার কাহিনীগুলোতে যে বাস্তবসম্মত তদন্ত,তদন্তের সময় তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ এবং অপরাধীর আচরণ পর্যবেক্ষণ অনুসরণ করে তদন্তের সমাধান দেখানো হয়েছে যেসব অনেকাংশে দারোগা প্রিয়নাথের লেখা থেকে অনুপ্রাণিত। হেমেন্দ্রকুমার রায়ের গোয়েন্দা চরিত্রগুলোতেও প্রিয়নাথের লেখার প্রভাব আমরা দেখতে পাই।
আমরা সাধারণত একপ্রকার বিনোদনের জন্য বই পড়ে থাকি এক্ষেত্রে তার লেখা কেবল বিনোদনমূলক ই নয় বরং এটি ঐতিহাসিক,সামাজিক ও বাস্তবিক প্রেক্ষাপট থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। তার এই সাহিত্যিক অবদান বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দা ও রহস্যকে আরও একধাপ এগিয়ে নিয়ে গেছে। যা পরবর্তী প্রজন্মের জন্য একটা আদর্শ উদাহরণ এবং অনুপ্রেরণা হিসেবে কাজ করবে।
এরকম আরও ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন।
লেখিকা,
মাইশা মাসুদ হৃদিকা
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE