ব্ল্যাক হোলের নাম তো কমবেশি আমরা সকলেই শুনেছি। ব্ল্যাক হোল বা কৃষ্ণগহ্বর হলো মহাশূন্যের এমন কিছু জায়গা, যেখানে মহাকর্ষবল আশপাশের সবকিছু টেনে তার কেন্দ্রে নিয়ে যায়। এমনকি আলোও টেনে নেয়।  

দারুণ এক রহস্য, তাই না?

এই ব্ল্যাক হোলের মতোই আরেকটি রহস্যের নাম হলো ব্লু হোল, দ্য গ্রেট ব্লু হোল। কী সেই রহস্য, চলুন জেনে নেওয়া যাক।

সমুদ্রের মাঝে বিশালাকার নীল রঙের একটি গর্ত রয়েছে, সেটিই মূলত দ্য গ্রেট ব্লু হোল নামে পরিচিত। শুরুতে ব্ল্যাক হোলের প্রসঙ্গ টানা হলেও আদতে ব্ল্যাক হোলের সাথে এর কোনো তেমন সম্পর্ক নেই, বলতে পারেন ব্ল্যাক হোলের মতোই আরেকটি রহস্য এটি। একটি হলো মহাশূন্যের রহস্য আরেকটি হলো সমুদ্র দেশের। 

মধ্য আমেরিকার উত্তর-পূর্ব উপকূলের বেলিজ সিটিতে দেখা মিলবে এই এলাকাটির। ঠিক বেলিজ সিটিতে নয়, মূলত বেলিজ সিটি থেকে প্রায় ৬০ মাইল দূরে, উপকূলবর্তী বেরিয়ার রিফ রিজার্ভ নামে পরিচিত প্রবাল প্রাচীরের কেন্দ্রে দৈত্যাকার এই সামুদ্রিক গর্তের অবস্থান। ৩০০ মিটার ব্যাসার্ধ এবং ১২৪ মিটার গভীরতা সম্পন্ন একটি বৃত্তাকার গর্ত এটি। 

তবে অক্ষরে অক্ষরে এটি সম্পর্কে জানতে পারলেও, সাধারণ জনগণ এই রহস্য নিজ চোখে দেখতে পারবে বলে ভাবলে তা একেবারেই ভুল হবে। কারণ রহস্য যেখানে রয়েছে বিপদ ও সেখানে উঁকি মারতে পারে তা আপনার-আমার সবার ই জানা আছে।

তাই তো কেবল স্কুবার ডাইভারদের জন্যই এই এলাকাটি হতে পারে ‘টু এক্সপ্লোর’ এর মতো একটি জায়গা। এবং একারণেই পৃথিবীর প্রথম পাঁচটি ‘ডাইভিং সাইট’-এর মধ্যে ইউনেস্কো স্বীকৃত ‘দ্য গ্রেট ব্লু হোল’ সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। 

ঠিক যেন সমুদ্রের একটি চোখ রহস্য নিয়ে তাকিয়ে আছে পৃথিবীর দিকে। আপনার প্রতিচ্ছবি সৃষ্টি হতে পারে এমন স্বচ্ছ জলের নিচে পরতে পরতে তৈরি হয়েছে এই বিশাল গর্ত যেখানে রয়েছে হাঙর, তিমি সহ নাম না জানা অসংখ্য সামুদ্রিক প্রাণীর বিচরণ। 

বিশেষজ্ঞদের মতে প্রায় ৬৫ হাজার বছর আগে, বরফযুগ চলাকালীন সময়ে সমুদ্রপৃষ্ঠ ছিল বর্তমান সময়ের চেয়ে অনেক নিচুতে। সেই সময় বেলিজের সমুদ্রপৃষ্ঠ ছিল এখনকার চাইতেও আরো ১৫০ মিটার নিচুতে। তখন ই ক্যালসিয়াম কার্বনেট জাতীয় পদার্থ জমে তৈরি হয় পাথর, আর সেই পাথর দিয়ে সৃষ্টি হয় ব্লু হোলের বিশাল এই কাঠামো।

কিন্তু বরফ যখন আবার গলতে শুরু করে, সাগরের পানির উচ্চতাও বাড়তে শুরু করে এবং ফলে পানির নিচে ডুবে যায় সেই বিশাল কাঠাম্ল

এরপর আজ থেকে প্রায় ১০ থেকে ১৫ হাজার বছর আগে এই পুরো কেভ নেটওয়ার্কই পানির নিচে পুরোপুরি ডুবে যায়। 

সমুদ্রের গভীরে, গাঢ় নীল জলের অতলে শৈবাল ও প্রবাল দিয়ে ঘেরাও করা এই বিশাল গর্তটি সর্বপ্রথম নজরে এসেছিল ১৯৭১ সালে জ্যাকুয়েস কস্টিউ নামের এক ব্যক্তির

এরপর শুরু হয় এই গর্ত নিয়ে নানান জল্পনা কল্পনা, এই রহস্য উদঘাটনের জন্য ডুবুরিদের যেন আর তর সইছিল না। যত দ্রুত সম্ভব সেই অজানা গর্তের পৃথিবীতে পাড়ি জমাতে চেয়েছে তারা।

কিন্তু দূর্ভাগ্য সেই চারশতাধিক ডুবুরির ব্লু হোলের খোঁজে সমুদ্রের তলে পাড়ি জমাতে গিয়ে তারা নিজেরাই নিখোঁজ হয়ে গেলেন। জ্বী! প্রায় চারশ জন ডুবুরি এই রহস্য উদঘাটন করার উদ্দেশ্যে ব্লু হোলের ভেতরে প্রবেশ করেছিলেন কিন্তু এর পর তাদের মধ্যে একজন ও ফিরে আসেননি, তারাও যেন এই ব্লু হোল নামক রহস্যের একটি অংশ হয়ে গেল।

এরপর থেকে এই দৈত্যাকার গর্তের রহস্য উদঘাটন করার উদ্দেশ্যে খুব কম ডুবুরিরাই ভেতরে যাওয়ার সাহস করেন, বরং কেবল উপরের স্তর পর্যন্ত গিয়েই ফিরে আসেন তারা।

অবশেষে বেশ অনেক বছর কেটে গেলে ২০১৮ ফ্যাবিয়েন কস্টিউ আবার এই অঞ্চলে অভিযান চালান। তাঁর সঙ্গ দেন ধনকুবের রিচার্ড ব্রান্সন এবং এরিকা বার্জম্যান

মূলত এই ব্লু হোলের একটি থ্রিডি ম্যাপ তৈরি করার উদ্দেশ্যে এর গভীরে নামার সাহস করেন তারা। নামার পথে তারা কিছু বিষয় লক্ষ করেন, যেমন দৈত্যাকার কচ্ছপ, কোরাল, স্কুইড ও রিফ শার্কের মতো দানবীয় সব সামুদ্রিক প্রাণী।

কিন্তু আরো গভীরে যেতে যেতে তারা যা দেখতে পেলেন তা দেখে তো চক্ষু চড়কগাছ! গর্তের কয়েকশ মিটার গভীরে অক্সিজেনের ছায়া মাত্র নেই, চারদিক কেবল হাইড্রোজেন সালফাইডের চাদর দিয়ে ঘেরাও করা। এই অঞ্চলে মানুষ কেন, কোনো সামুদ্রিক প্রাণী ও বেঁচে থাকার সম্ভাবনা নেই। 

বিশাল বিশাল প্রাণীদের অভয়ারণ্য, বিশাল এই গর্ত আসলে পৃথিবীতে কেবল একটিই রয়েছে এবং একটিই থাকবে। কারণ এর বিশালতা কিংবা রহস্য কোনোটার সাথেই টেক্কা দেওয়ার মতো ব্লু হোল আজ পর্যন্ত আবিষ্কার হয়নি। 

এরুকম আরো ব্লগ পড়তে ক্লিক করুন.

লেখিকা

মৌসুমী আক্তার রিতু 

ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট ইন্টার

YSSE

Leave a Reply