‘নয়ন তলায় থাকিবে কাঁথার আঁচড়ে,

সুতার সুরে গাঁথবে গাঁথার দুঃখে’

— পল্লিকবি জসিমউদ্দিন

নকশিকাঁথা শুধু একটি কাপড় নয়, এটি এক টুকরো শিল্প, বাঙালির হৃদয়ের ভাষা। প্রতিটি সুঁইয়ের আচঁড়ে ফুটে ওঠে জীবনের গল্প, ভালোবাসার স্মৃতি, বেদনার চিত্র এবং সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি। এটি যেন শতাব্দী ধরে মায়ের স্নেহমাখা আদর আর গ্রামীণ জীবনের মমতাময় প্রতীক।

প্রাচীন বাংলার গ্রামীণ মাটির ঘরে জন্ম নেওয়া এই শিল্পকর্ম বাঙালি নারীদের সৃজনশীলতার এক অপূর্ব নিদর্শন। এটি কেবল একটি পণ্য নয়, বরং বাঙালির জীবনের দুঃখ-সুখ, সংগ্রাম এবং সংস্কৃতির রূপরেখা বহন করে।

গ্রামীণ শেকড়ের গল্প

নকশিকাঁথার ইতিহাস প্রাচীন। এটি প্রথমে ব্যবহারিক প্রয়োজনে তৈরি হলেও সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এটি শিল্পে পরিণত হয়। পুরনো শাড়ি বা কাপড়কে নতুনভাবে ব্যবহার করার চিন্তা থেকে শুরু হয়েছিল এর যাত্রা। বাংলার গ্রামীণ নারীরা নিজেদের শৈল্পিক দক্ষতা এবং সৃজনশীলতার মাধ্যমে সুতোর গাঁথুনি দিয়ে তৈরি করতেন নকশিকাঁথা।

একেকটি কাঁথা যেন একেকটি জীবন্ত গল্প। এতে ফুটে উঠত গ্রামের জীবনের রূপ। ফুল, পাখি, মাছ, চাঁদ, তারার মতো প্রকৃতির উপাদান ছাড়াও মানুষের দৈনন্দিন জীবনের খণ্ড খণ্ড দৃশ্য এই নকশায় প্রকাশিত হতো। কাঁথার প্রতিটি ধাপে ধাপে যেন জীবনের ব্যথা-বেদনা, ভালোবাসা এবং আনন্দ মিশে থাকত।

সংস্কৃতির বাহক

নকশিকাঁথা বাঙালির সংস্কৃতির একটি গভীর দিক তুলে ধরে। এটি শুধু একটি শিল্পকর্ম নয়; এটি আবেগের বহিঃপ্রকাশ। বিয়ের উপহার হিসেবে একটি নকশিকাঁথা দেওয়ার রেওয়াজ এখনো বাংলার বহু অঞ্চলে প্রচলিত।

নকশিকাঁথা শুধু পরিবারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। এটি বিভিন্ন উৎসবে, আনন্দে এবং শোকের সঙ্গী হয়েছে। গ্রামীণ বাংলার নারীরা তাদের স্বপ্ন, আশা, কষ্ট এবং ভালোবাসার প্রতিচ্ছবি হিসেবে এই কাঁথা বুনতেন।

জসীমউদ্দিন তাঁর ‘নকশিকাঁথার মাঠ’ কবিতায় এই শিল্পের দারুণ এক চিত্র তুলে ধরেছেন। তিনি দেখিয়েছেন, কীভাবে একটি কাঁথা গ্রামের মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাঁর কবিতায় এই কাঁথার প্রতিটি সুঁই যেন বয়ে নিয়ে যায় বাঙালির চিরন্তন অনুভূতির স্পন্দন।

কালের বিবর্তনে নকশিকাঁথা

নকশিকাঁথা সময়ের সঙ্গে রূপ বদলেছে। একসময় এটি কেবল গ্রামীণ বাংলার নারীদের সৃষ্টিশীলতার পরিচায়ক ছিল। কিন্তু আধুনিক ডিজাইনারদের হাত ধরে নকশিকাঁথা আন্তর্জাতিক পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

আজ এটি ফ্যাশনের জগতে একটি বিশেষ স্থান করে নিয়েছে। ব্যাগ, শাড়ি, জামা, এবং ঘর সাজানোর পণ্য তৈরিতে নকশিকাঁথার ব্যবহার জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। শহুরে মানুষের কাছে এটি এখন আধুনিকতার সঙ্গে ঐতিহ্যের এক অসাধারণ মেলবন্ধন।

একই সঙ্গে, এটি গ্রামীণ নারীদের অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী করে তুলতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তাদের দক্ষতা এখন কেবল পরিবারের গণ্ডিতেই সীমাবদ্ধ নয়; এটি আজ দেশজুড়ে এবং বিদেশেও ছড়িয়ে পড়েছে।

নকশিকাঁথা একটি পরিবারের গল্প বলার মাধ্যম। একটি পুরনো কাঁথা ধরে দেখলে মনে হয়, এটি যেন কালের সাক্ষী। প্রতিটি সুঁইয়ের আঁচড় মনে করিয়ে দেয় কোনো প্রিয় মুহূর্তের কথা। হয়তো এটি একটি বিয়ের উপহার ছিল, কিংবা মায়ের হাতে তৈরি একটি শীতের কাঁথা।

কাঁথার প্রতিটি নকশা যেন বাঙালির জীবনের ক্যানভাস। এটি শুধু একটি কাপড় নয়; এটি আমাদের শেকড়ের সঙ্গে সম্পর্কের স্মারক। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে এই শিল্প প্রবাহিত হয়ে এসেছে এবং বয়ে চলেছে বাঙালির ঐতিহ্য।

গ্রামীণ জীবনের প্রতিচ্ছবি

নকশিকাঁথা আমাদের সংস্কৃতি ও জীবনের প্রতিচ্ছবি। নকশিকাঁথা বাঙালির মাটি, মানুষ, এবং সংস্কৃতির এক চিরন্তন প্রতীক। প্রতিটি সুঁইয়ের আঁচড়ে ফুটে ওঠে ভালোবাসা, দুঃখ, সংগ্রাম এবং জীবনের সৌন্দর্য।

নকশিকাঁথা শুধু একটি কাপড় নয়; এটি সুঁই-সুতোর মাধ্যমে বোনা জীবনের গল্প, এই সত্যটি বারবার মনে করিয়ে দেয় আমাদের শেকড়ের সঙ্গে সম্পর্ক। এর প্রতিটি কাজ যেন আমাদের শেকড়ের সঙ্গে গভীরভাবে যুক্ত করে, আমাদের মনে করিয়ে দেয় আমরা বাঙালি।

নকশিকাঁথার প্রতিটি নকশায় যেন এক নতুন গল্প। এটি বাঙালির গর্ব, যা আমাদের ঐতিহ্যের সৌন্দর্য বিশ্বমঞ্চে তুলে ধরে।

এই রকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন

লেখক,
জেমি সাইলুক
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE