বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রসঙ্গ আসলে সবার কি শুধু তাঁর বিদ্রোহী চেতনার কবিতা গুলোই মাথায় আসে? “চল চল চল”, ” বল বীর বল উন্নত মম শীর”, “কারার ওই লৌহ কপাট” – তা়ঁর এ ধরনের বিখ্যাত বিপ্লবী ধারার কবিতা গুলো আমরা সবাই কম বেশি পড়ে বড় হয়েছি। কিন্তু আমাদের কারোই এই বিষয় অজানা নেই যে তিনি একাধারে বিদ্রোহী কবি, প্রেমের কবি, মানবতার কবি।
কাজী নজরুল ইসলাম (১৮৯৯-১৯৭৬) বিংশ শতাব্দির অন্যতম প্রধান ও সাহসী কবি যিনি আমৃত্যু সকল অন্যায় ও শোষনের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার ও প্রতিবাদী। এজন্য তিনি বাংলা সাহিত্যে “বিদ্রোহী কবি” হিসেবে সমধিক পরিচিত। আবার একই সঙ্গে কোমল দরদি মন নিয়ে ব্যথিত বঞ্চিত মানুষের পাশে থেকেছেন তিনি। তাঁর লেখায় প্রেম কখনও কখনও প্রকাশ পেয়েছে সৌন্দর্যের প্রতি, কখনও দেশেরমাতার প্রতি, কখনও আবার সমাজের নিপিড়ীত মানুষের প্রতি। এভাবেও বলা যায়, তাঁর কবিতায় নারী কখনো প্রেমিকা, কখনো দেশপ্রেমিকার রূপে দেখা দিয়েছে।
নজরুলের কবিতায় প্রেম এবং দ্রোহ (বিদ্রোহ) দুইটি প্রধান উপাদান হিসেবে উপস্থিত।
কাজী নজরুল ইসলামের প্রেমের কিছু উল্লেখযোগ্য কবিতা:
“গানের আড়াল”
‘তোমার কন্ঠে রাখিয়া এসেছি মোর কন্ঠের গান —
এইটুকু শুধু রবে পরিচয় ? আর সব অবসান ?
অন্তরতলে অন্তরতর যে ব্যথা লুকায়ে রয়,
গানের আড়ালে পাও নাই তার কোনদিন পরিচয় ?’
১৯২৯ সালে রচিত ‘চক্রবাক’ কাব্যগ্রন্থ থেকে নেয়া এই কবিতাটিতে কবি প্রেমের বেদনার ছবি তুলে ধরেছেন। প্রেমিক বা প্রেমিকার কাছে তার হৃদয়ের অভিব্যক্তি পৌঁছাতে না পারার এক অন্তর্লীন যন্ত্রণা এতে ফুটে উঠেছে।
“অ-নামিকা”
‘তোমারে বন্দনা করি
স্বপ্ন-সহচরী
লো আমার অনাগত প্রিয়া,
আমার পাওয়ার বুকে না-পাওয়ার তৃষ্ণা-জাগানিয়া!
তোমারে বন্দনা করি….’
১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে ‘সিন্দু হিন্দোল’ কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত হওয়া এই কবিতায় কবি প্রেমকে এক ধ্রুপদী অনুভূতি হিসেবে চিত্রিত করেছেন, যা কখনোই পুরোপুরি অর্জিত হয় না, কিন্তু তার তৃষ্ণা মানুষের অস্তিত্বকে অর্থবহ করে তোলে।
“আমার কবিতা তুমি”
‘প্রিয়া-রূপ ধরে এতদিনে এলে আমার কবিতা তুমি,
আঁখির পলকে মরুভূমি যেন হয়ে গেল বনভূমি!’
এই কবিতায় অপেক্ষামান প্রিয়ার জন্য কবির ব্যাকুলতা প্রকাশ পেয়েছে। প্রেমিকার রূপ ও সৌন্দর্য কবির সৃষ্টিতে প্রভাব ফেলে, অথচ তাকে না পাওয়ার যন্ত্রণা কবিকে গভীর বিরহে ডুবিয়ে রাখে।
কাজী নজরুল ইসলামের দ্রোহের কিছু উল্লেখযোগ্য কবিতা:
“বিদ্রোহী”
‘বল বীর –
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারি’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রির!’
১৯২১ সালের ডিসেম্বরে ঔপনিবেশিক ভারতের বিরুদ্ধে আমাদের দুখুমিয়া বীরের মতো আওয়াজ তুলেছিলেন এই কালজয়ী কবিতা রচনার মাধ্যমে। যে কবিতার শব্দের ঝংকার আজ ১০০ বছরের বেশি সময় পরেও বাঙালিকে উদ্দীপ্ত করে চলছে প্রতিনিয়ত।
“কান্ডারী হুশিয়ার”
‘দুর্গম গিরি, কান্তার-মরু, দুস্তর পারাবার
লঙ্ঘিতে হবে রাত্রি-নিশীথে, যাত্রীরা হুশিয়ার!’
১৯২৬ সালের এপ্রিল মাসে কলকাতায় হিন্দু-মুসলমান দাঙ্গার ভয়াবহ রূপ দেখে অস্থির হয়ে দাঙ্গাপীড়িত মানুষের দুঃখ-কষ্ট অনুভব করে নজরুল লিখেন তাঁর ‘কাণ্ডারী হুশিয়ার’ কবিতাটি। অখণ্ড ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে লেখা এই কবিতা সংগ্রামি যুবসমাজের কাছে স্বাধীনতার একটি স্পষ্ট বার্তা হিসেবে কাজ করেছে।
“মোরা ঝঞ্চার মত উদ্দ্যাম”
‘মোরা আকাশের মত বাঁধাহীন
মোরা মরু সঞ্চার বেদুঈন..’
সামাজিক অন্যায়বিচারের পাথর ভেঙে ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠার লক্ষে নজরুল ১৩৩১ সালে ব্যান্ডের সুরে রচনা করেন এই অবিস্মরণীয় কবিতাটি। বিদ্রোহী ও স্বাধীনচেতা মনোভাবের প্রকাশক এই কবিতাটি একই সাথে আত্মবিশ্বাস, উদ্যম, ও মুক্তচিন্তার প্রতীক, যা কোনো বাঁধাকে মানে না এবং প্রবল শক্তি নিয়ে এগিয়ে চলে।
কবি যে কলম দিয়ে ট্রেনে এক নারীর প্রেমে পরে লিখেছিলেন–“তুমি সুন্দর তাই চেয়ে থাকি প্রিয়, সেকি মোর অপরাধ?” ঠিক একই কলমে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে রচনা করেছিলেন কালজয়ী রক্ত গরম করা কবিতা ও গান “কারার ওই লৌহ কপাট“। যে কবি তাঁর লেখনীর জাদুতে অসংখ্য যুবক-যুবতির মনে প্রেমের ফুল ফুটিয়েছিলেন; তিনিই আবার লাখো বিপ্লবীদের হ্রদয়ে জাগিয়েছিলেন বিদ্রোহের আগুন। তাই কবি তার এক লেখনীতে এভাবে আক্ষায়িত করেছেন-”এক হাতে বাঁশি আরেক হাতে রণতুর্য”।
এরকম আরো ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন
লেখিকা,
খোশবুবা আলম ব্রতী,
ইন্টার্ণ,
কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট,
YSSE