নদীকে শুধু প্রকৃতির একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ বললে ভুল হবে, বরং এটি আমাদের সংস্কৃতি, অর্থনীতি এবং জীবনের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। নদীর গুরুত্ব প্রসঙ্গে লিখা শুরু করল যেমন শেষ করা যাবে না, তেমনি নদী রক্ষায় একজন মানুষের অবদানের কথাও লিখে শেষ করা যাবে না। তিনি হলেন আমাদের দেশের একজন বিশেষজ্ঞ, ড. মো. মনজুরুল কিবরিয়া। তিনি শ্রীলঙ্কার কলম্বোর কেলানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে গত ৮-৯ নভেম্বর অনুষ্ঠিত তৃতীয় আন্তর্জাতিক নদী কংগ্রেসে ‘Best River Scientist Award 2024’ এ ভূষিত হয়েছেন। শুধু তাই নয়, ২০১১ সালেও তিনি বেশ কিছু পুরষ্কারে ভূষিত হয়েছিলেন। তিনি নদীর প্রতি আমাদের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে দিয়েছেন এবং নদী বাঁচাতে প্রতিনিয়ত কাজ করে যাচ্ছেন।
ড. মো. মনজুরুল কিবরিয়া বর্তমানে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় প্রাণিবিদ্যা বিভাগের প্রফেসর ও হালদা নদীর গবেষক হিসেবে যুক্ত রয়েছেন। তিনি ২০০৩ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত বাংলাদেশের নদী এবং মাছ নিয়ে গবেষণা করে যাচ্ছেন।তাঁর কাজের মাধ্যমে নদীর বাস্তুতন্ত্র রক্ষার গুরুত্ব, মিঠাপানি মাছের বৈচিত্র্য, তাদের বংশবিস্তার, নদী দখল ও এর দূষণ প্রতিরোধ বিষয়গুলো ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর নেতৃত্বে দেশে ‘নদী রক্ষা’ নামক একটি আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনটি শুধু যে পরিবেশ সংরক্ষণের দৃষ্টিকোণ থেকেই করা হয়েছে তা নয় বরং এটি একটি সামাজিক আন্দোলন এর দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে।
নদীর প্রতি তাঁর যে দৃষ্টিভঙ্গি তা আমাদের সকলের জীবনে বাস্তবায়ন করা উচিত। তাঁর মতে নদী একটি বাস্তুতন্ত্র, সংস্কৃতি এবং একাধিক জীবনের মেলবন্ধন। কিভাবে নদী দূষণ ও মানব সৃষ্ট অসুবিধার কারণে আমাদের দেশের নদীগুলো তাদের অস্তিত্ব হারাচ্ছে, তা তাঁর কাজের মাধ্যমে আমরা বিস্তারিত জানতে পারি। নদীর প্রতি তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি কেমন তা তাঁর উক্তির মাধ্যমে আমরা স্পষ্ট জানতে পারি, “নদীকে আমরা শুধু একটি সম্পদ হিসেবে দেখি। কিন্তু নদী আসলে আমাদের অস্তিত্বের একটি অংশ। এটি হারিয়ে গেলে আমরা আমাদের শিকড় হারিয়ে ফেলব।” এই উপলব্ধিকে কেন্দ্র করেই তিনি তাঁর কাজ শুরু করেন।
২০১৮ সালের “নদী রক্ষা” আন্দোলনে ড. মো. মনজুরুল কিবরিয়ার কিছু উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ হলো: স্থানীয় জনগণদের মাঝে নদীর গুরুত্ব সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি, স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের কেন্দ্র করে নদী রক্ষার ক্যাম্পেইন চালনা, স্থানীয় প্রশাসন এবং সরকারি সংস্থাগুলোর যৌথ প্রচেষ্টায় নদী রক্ষায় কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া, তরুণদের মাধ্যমে নদী পরিষ্কার অভিযানের আয়োজন করা ইত্যাদি। আন্দোলনটি নদী রক্ষায় খুব গুরুত্বপূর্ণ আবেদন রেখেছে। তিনি একজন পরিবেশবিদ বা সংগঠকের ভূমিকা পালনের পাশাপাশি একজন পথপ্রদর্শক হিসেবে আমাদের ভবিষ্যতের জন্য পথ দেখিয়েছেন। তাঁর প্রচেষ্টায় দেশের অনেক নদী দখলমুক্ত হয়েছে এবং নদীদূষণ প্রতিরোধের জন্য কার্যকর নীতিমালা বাস্তবায়িত হয়েছে।
ড. কিবরিয়ার গবেষণার একটি বড় অংশ জুড়ে রয়েছে মিঠা পানির মাছের বৈচত্র্য। কিভাবে নদী দূষণ ও ব্যবস্থাপনার ফলে মাছের প্রজাতি গুলো ধ্বংস হচ্ছে তা সবার দৃষ্টিগোচর করেছেন তিনি। মাছগুলো যে শুধু জীববৈচিত্র্যের অংশ তা নয়, এগুলো আমাদের খাদ্যের নিরাপত্তা দেয় এবং অর্থনীতি সচল রাখে।
ড. কিবরিয়া তাঁর কাজের পাশাপাশি ছাত্রদের পরিবেশ সংরক্ষণ সম্পর্কে শিক্ষা দিয়ে থাকেন। তাঁর গবেষণাগুলো নির্দিষ্ট কোনো বয়সের জন্য সীমাবদ্ধ না, এগুলো নির্বিশেষে সবার পড়ার এবং জ্ঞান আহরণের জন্য উন্মুক্ত।
ড. মোহাম্মদ মনজুরুল কিবরিয়া হলো আমাদের নদী রক্ষায় এক আশার প্রদীপ। তিনি তাঁর কাজের মাধ্যমে প্রাকৃতিক সম্পদের প্রতি আমাদের দায়িত্ব বারবার মনে করিয়ে দেন এবং অবিচল প্রচেষ্টায়ও যে একজনের পক্ষেও একটি বড় কোন পরিবর্তন আনা সম্ভব তার এক উজ্জল দৃষ্টান্ত তিনি।
নদী রক্ষার আন্দোলনকে টিকিয়ে রাখতে তরুণ প্রজন্ম তাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা করে যাবে- এই কথাটি ড. কিবরিয়া মনেপ্রাণে বিশ্বাস করেন। এর জন্যই তিনি তরুণদের মাঝে নদীর প্রতি ভালোবাসা ও দায়িত্ববোধ জাগিয়ে তোলার চেষ্টা করে গিয়েছেন। তিনি তরুণদের উদ্দেশ্যে বলেছেন, “তোমরা যদি নদীকে রক্ষা করো, নদী তোমাদের ভবিষ্যৎ রক্ষা করবে।”
এই রকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন
লেখিকা,
কাজী মিরানা মঈনুদ্দিন
ইন্টার্ন
কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE