মীর শাহরুখ ইসলাম একটি পরিচিত নাম। সম্প্রতি ফোর্বস ম্যাগাজিনের ‘Forbes 30 under 30 Asia’ এর তালিকায় স্থান করে নেওয়া এই তরুণ উদ্যোক্তার সাফল্যের পেছনের যাত্রাটা কেমন ছিল? পারিবারিক বাধা আর সমাজের গৎবাঁধা নিয়মকে উপেক্ষা করে কতটুকু সফল হতে পেরেছেন তিনি? “World Youth Skills Day” উপলক্ষে YSSE ব্লগে আমরা আজ জানবো এই তরুণ উদ্যোক্তার কথা, পড়বো তার সফলতার গল্পগুলো…
বাংলাদেশের প্রথম IOT ভিত্তিক কোম্পানি বন্ডস্টেইন টেকনোলজিস লিমিটেডের (Bondstein Technologies Limited) সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং Managing Director মীর শাহরুখ ইসলাম অনুপ্রেরণার অন্য এক নাম।
২০১২ সালে প্রতিষ্ঠিত সিঙ্গুলারিটি লিমিটেডের সহ-প্রতিষ্ঠাতা এবং CEO মীর শাহরুখ ইসলাম, ২০১৫ সালে ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজির EEE ডিপার্টমেন্ট থেকে গ্র্যাজুয়েশন কমপ্লিট করেন এবং বর্তমানে স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটিতে (Stanford University) Seed Transformation প্রোগ্রামে অধ্যায়নরত আছেন। সম্প্রতি মার্কিন সাময়িকী ফোর্বস এ প্রকাশিত ‘ফোর্বস থার্টি আন্ডার থার্টি এশিয়া ২০২২‘ এর তালিকায় ইন্ডাস্ট্রি ম্যানুফ্যাকচারিং ক্যাটাগরিতে স্থান করে নিয়েছেন এই তরুণ উদ্যোক্তা।
স্বপ্নের পিছে ছোটার শুরুটা হয় মূলত ইসলামিক ইউনিভার্সিটি অব টেকনোলজিতে প্রথম বর্ষে অধ্যয়নকালে। তিনি বলেন,
“ছোটবেলা থেকেই আশেপাশে দেখতাম কত মানুষ কত নতুন উদ্ভাবন করছে। সেই থেকে একটা জিনিস কাজ করতো নিজের মাঝে যে, সবকিছুতে নতুন কী করা যায়? ২০১২ সালে আইইউটিতে ভর্তির পর আমি আবারও চেয়েছিলাম নতুন কিছু করব, সবার থেকে আলাদা উদ্ভাবনী কিছু করব। কিন্তু, নির্দিষ্ট কোন কিছু অর্জন করার কথা তখনও ভাবিনি আসলে। মূলত, নতুন কিছু করার স্পৃহা থেকেই ব্যবসা শুরু করা এবং এত দিনের পথ চলা।”
তাঁর স্বপ্নের প্রথম বাস্তবায়ন ছিল “সিঙ্গুলারিটি”। বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম বর্ষে থাকাকালীন সময়েই পড়াশোনার পাশাপাশি গাজীপুর থেকে বারিধারায় গিয়ে অফিস করতেন মীর শাহরুখ ইসলাম। অনিশ্চয়তা বুকে নিয়েও করেছেন কঠোর পরিশ্রম।
তিনি বলেন, “২০১২ সালে সমাজে তখন উদ্যোক্তা বা স্টার্ট-আপ জিনিসটা এত সহজ ছিল না। উদ্যোক্তা টার্মটা কেউ চিনতোই না। ব্যবসা জিনিসটা সবাই ভয় পেত। ছেলে ব্যবসা কেন করবে? চাকরি কেন করবে না? দেশের বাইরে কেন যাবে না? কিন্তু, আমরা চেয়েছিলাম দেশে থেকে দেশের জন্য কিছু করতে। এখন তো ব্যবসা খুলতে গেলে ফান্ড পাওয়া যায়, পরামর্শ পাওয়া যায়। তখন জিনিসগুলো ছিল একদম নন-এক্সিস্টেন্ট। সেই সময় ব্যবসা খোলা, ব্যবসা কিভাবে অপারেট করে বোঝাটাই একটা বড় কোয়েশ্চেন ছিল। তারপরও আমরা যেখানে যেখানে প্রবলেম ফেস করেছি, সেখান থেকে শিখেছি এবং পরবর্তীতে নিজেদেরকে আরো ইমপ্রুভ করেছি।”
২০১৪ সালে সিঙ্গুলারিটি আর স্পেলবাউন্ডের পার্টনারশিপে চালু করা হয় বন্ডস্টেইন (Bondstein)। তাঁরা মূলত কাজ করেন ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজির ডোমেন – আইওটি টেকনোলজি (ইন্টারনেট অব থিংস) নিয়ে। বন্ডস্টেইন (Bondstein) বর্তমানে আইওটি ক্যাটাগরিতে মার্কেট লিডার হিসেবে অবস্থান করছে। ইউনিলিভার, ওয়ার্ল্ড ব্যাংক, রবি, গ্রামীণফোন, গুগল, ফেসবুকসহ আরো অনেক কোম্পানির সাথে তাঁরা কাজ করেছেন। ২০১৫ সালে ‘Asia’s Top 100 Startup’ এর ভিতরে এটি জায়গা করে নেয়।
মীর শাহরুখ ইসলাম বলেন, “আমাদের আশেপাশের জিনিস যেমন গাড়ি, বাসা বাড়ির, জিনিসপত্র এগুলোকে কিভাবে ইন্টারনেটে কানেক্ট করা যায় এবং সেখান থেকে সুবিধা নিয়ে জীবনটাকে আরো সহজ করা যায় সেটা নিয়েই আমরা মূলত কাজ করি। আমাদের প্রথম প্রোডাক্ট ছিল ‘Track my vehicle‘। এর মাধ্যমে গাড়িকে ইন্টারনেটের সাথে কানেক্ট করা হয় এবং গাড়ির মুভমেন্ট ট্র্যাক করা হয়, গাড়ি সেফ ড্রাইভ করছে কিনা সেটাও বলে দেওয়া যায়। খুশির কথা হলো এই যে, ইউনিলিভার নামক আমাদের বাংলাদেশী কাস্টমার, প্রযুক্তিটি ব্যবহার করে ৭০% এক্সিডেন্ট কমিয়ে ফেলেছে।”
প্রশ্ন ফাঁস ঠেকাতে যখন পুরো বাংলাদেশ তোলপাড়, তখনই ২০১৬ সালে, তাদের আরেকটি প্রযুক্তি খুলে দেয় নতুন সম্ভাবনার দুয়ার। এ সম্পর্কে তিনি আমাদের বলেন, “আমাদের ইনোভেশনটা ছিল স্মার্ট বক্স। এটার মধ্যে কোয়েশ্চেনটি ক্যারি করা হবে। বক্স খুলে যদি কেউ সেটা লিক করার চেষ্টা করে, সাথে সাথেই সেন্ট্রাল কন্ট্রোল প্যানেল বুঝতে পারবে যে বক্সটি খোলা হয়েছে। এটি আমরা উদ্ভাবন করি সম্পূর্ণ দেশীয় প্রযুক্তিতে, দেশীয় ইঞ্জিনিয়ারদের দিয়ে। ২০১৬ সালে আমরা স্মার্ট বক্স প্রথম ইমপ্লিমেন্ট করি এবং এ পর্যন্ত মোট ছয় বার এমবিবিএস, ডেন্টাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আর শাহজালাল বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষায় এটি ব্যবহার করেছি। আল্লাহর রহমতে একবারও প্রশ্নপত্র লিক হয়নি।”
নতুনত্ব দিয়ে যেমন দেশের বিভিন্ন ক্ষেত্রে অবদান রেখেছেন এই উদ্যোক্তা তেমনি তার ন্যায্য স্বীকৃতিও পেয়েছেন। ২০১৭, ২০১৯ এবং ২০২০ সালে তিনবার তাঁরা ন্যাশনাল আইসিটি চ্যাম্পিয়ন হন। ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডে আইসিটি কোম্পানি অব দ্য ইয়ার পুরস্কারটিও তাদের ঝুলিতে জায়গা পায়। বুদ্ধিমত্তা এবং উদ্ভাবনী প্রযুক্তি কে কাজে লাগিয়ে সমাজে প্রযুক্তি সচেতনতা বৃদ্ধি এবং উন্নয়নে অবদান রাখার স্বীকৃতি স্বরূপ ২০১৯ সালে প্রথম বাংলাদেশী কোম্পানি হিসেবে তাঁরা Asia Pacific IOT Champion (APICTA Award) হন। কালিয়াকৈরে বসুন্ধরা হাইটেক সিটিতে বাংলাদেশের প্রথম আইওটি ভিত্তিক এসেম্বলি ইউনিট তৈরিতে চুক্তিবদ্ধও হয় এই বন্ডস্টেইনই (Bondstein)।
কিন্তু, শুধু দৈনন্দিন জীবনের সমস্যা সমাধান করেই থেমে যাননি তাঁরা; বরং জাতীয় দুর্যোগের সময়ও এগিয়ে এসেছেন এই প্রযুক্তি যোদ্ধারা। করোনা কালীন সময়ে যখন পুরো দেশের যাতায়াত ব্যবস্থা প্রায় অচল; চিকিৎসক, নার্স কিংবা চিকিৎসা প্রার্থী কেউই হাসপাতালে পৌঁছাতে পারছে না, তখনই তারা নিয়ে আসেন আরেকটি প্রযুক্তি ‘ক্র্যাক প্লাটুন’।
এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করলে তিনি বলেন,
“কোভিডের সময় আমরা দেখলাম বিভিন্ন ডাক্তার, নার্স যারা আগে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহার করে হসপিটালে যেত, তারা রাস্তায় কোনো গাড়ি না থাকার কারণে হসপিটালেই যেতে পারছে না। তখন আমরা ডাক্তার, নার্স, সুপারভাইজার – যারা মেডিকেল প্রফেশনালস আছেন তাদেরকে পিক করে হসপিটালে পৌঁছে দেওয়ার জন্য “ক্র্যাক প্লাটুন” সেবাটি চালু করি।”
তাঁদের এই উদ্যোগ বন্ডস্টেইনকে (Bondstein) COMMWARD 2021 এ ‘Best COVID 19 Response Campaign‘ এবং ‘Best Social Campaign’ এই দুই ক্যাটাগরিতে ব্রোঞ্জ পদক এনে দেয়। এছাড়াও Bangladesh Innovation Award 2022 এ ‘ক্র্যাক প্লাটুন‘ এর জন্য Social Service ক্যাটাগরিতে চ্যাম্পিয়ন হয় এবং ‘স্মার্ট বক্স’ এর জন্য 3rd Party Education Innovation ক্যাটাগরিতে honourable mention পায় বন্ডস্টেইন (Bondstein)।
ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন,
“ফ্রন্টিয়ার টেকনোলজি নিয়েই সবসময় কাজ করেছি এবং এটা নিয়েই আরো কাজ করার ইচ্ছা আছে।”
চলার পথে অনেকের কাছেই অনেক রকম সাহায্য এবং অনুপ্রেরণা পেয়েছেন মীর শাহরুখ ইসলাম। সেই মানুষগুলোর প্রতি বিশেষ করে তাঁর মেন্টরদের প্রতি তিনি জানিয়েছেন অশেষ কৃতজ্ঞতা।
কোন জিনিসটি তাঁদেরকে সবার থেকে আলাদা করছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমাদের উদ্ভাবনী শক্তি, আমরা সব সময় যে নতুন কিছু করার চেষ্টা করি সেটাই আমাদের সবার থেকে আলাদা করে। গৎবাধা সলিউশনে আমরা কখনোই আটকে থাকিনি। এটার জন্যই আমরা মার্কেটে নিজেদের একটা জায়গা করতে পেরেছি এবং এখনো সেটা ধরে রেখেছি।”
ব্যবসার স্লোগান হিসেবে তিনি সবসময় মেনে চলেন, “Innovation is the main differentiating factor”।
নতুন উদ্যোক্তাদের উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, “উদ্যোক্তা হওয়ার যাত্রাটা অনেক কষ্টের, অনেক পরিশ্রমের। কিন্তু তার মধ্যেও patience রাখতে হবে। সফলতা একদিনে আসে না। Success is a journey। সেটার জন্য ধৈর্য্য ধরে থাকতে হবে।”
বন্ডস্টেইনের (Bondstein) মূলমন্ত্র হলো, ‘Unless it’s crazy, ambitious, impossible and delusional, it’s not worth our time’। স্লোগানের মতোই উচ্চাকাঙ্ক্ষী, উদ্ভাবনী শক্তি সম্পন্ন এক তরুণ উদ্যোক্তা মীর শাহরুখ ইসলাম; যার জীবন থেকে শেখার আছে অনেক কিছুই। নতুন কিছু করার ইচ্ছা থেকেই তার সব প্রচেষ্টা, পরিশ্রম যা তাকে এনে দিয়েছে চূড়ান্ত সাফল্য। তাঁর সাক্ষাৎকারের পর থেকেই শুধু একটা কথাই কানে বাজছে, “জীবনে উত্থান পতন আসবেই, ধৈর্য্য রাখতে হবে।”
আমাদের চারপাশে আমরা অনেক সফল মানুষই তো রোজ দেখছি, অনেকের গল্প আর কাজ আমাদেরকে অনুপ্রাণিতও করে। তাঁদের মত আমরাও স্বপ্ন দেখি। কিন্তু, আমাদের মধ্যে কতজন সব ভয় কাটিয়ে নিজেদের স্বপ্ন পূরণের কাজে এগিয়ে যাই?
স্বপ্নকে শক্তি বানিয়ে সফলতার শিখরে আরোহণের এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত মীর শাহরুখ ইসলাম। তাঁর গল্প আমাদেরকে একটা কথা বারবার মনে করিয়ে দেয় যে ইচ্ছা, ধৈর্য্য আর পরিশ্রম এই তিনকে একসাথে মিলালেই সম্ভব স্বপ্নের প্রকৃত বাস্তবায়ন।
সফলতার এমন আরো গল্প এবং অসাধারণ আরো সব ব্লগ পড়তে এখানে ক্লিক করুন
Writer
Nowrose Sharmin Mou
Associate Head, Content Writing Department
YSSE