মানুষের গবেষণার শেষ নেই। যতই সফল হয়, ততই আরো গভীরে ঝাঁপিয়ে পড়ে। আমিও সেই থেকে বাদ পড়ে যাই নি।
মানুষ আমাকে নিয়ে অনেক গবেষণা করেছে, এতোই গবেষণা করেছে যে আমাকে নিয়ে কিনা শাখাই তৈরী হয়ে গেল। এতো কিছু করতে গিয়ে কখনো আমার গায়ে রং মাখিয়েছে তো কখনো অ্যালকোহল এ ডুবিয়েছে। এরা কোথাও আমাকে মিথোজীবী বলে আবার কোথাও আমাকে পরজীবী বলে।
এক ওলন্দাজ বিজ্ঞানী আমাকে মানুষের সামনে উপস্থিত করেন। যদিও আমি ছিলাম সবসময়।
একটা কথা হচ্ছে , আমার এতো প্রকারভেদ আমার ভালো লাগে না। এখন দেখই না যে কত রকমের আকার- গোলাকার, দন্ডাকার, সূত্রাকার, চেইন, গুচ্ছাকার এবং কত কী!! মাঝে মাঝে আকারবিহীন, এমন বদমাশির জন্য আমাকে বহুরুপী-ও বলে।
যা হোক, আমি মাটি,পানি,বায়ু সবখানেই থাকতে পারি। আরেকটা চমৎকার গুন হচ্ছে, আমি ঠান্ডা-গরম যেকোনো আবহাওয়ায় বাচঁতে পারি।
তাপমাত্রা? – পরে বলছি।
আমি অনেক ছোট, কিন্তু ক্ষমতাবলে মানুষকে শেষ করতে পারি। একটা গোপন কথা, মানুষের দেহে কোষের তুলনায় আমার পরিমাণ ১০ গুন বেশি। তাও সবাই অবশ্যই আমাকে চিনে ফেলেছে! এখন বলুন তো, সেই ওলন্দাজ বিজ্ঞানী কিভাবে আমার উপস্থিতি পর্যবেক্ষন করেন??
এইটাই জানব এখন, সাথে আমাকে নিয়ে জানতে পারবেন আরো বিস্তারিত। চলুন তাহলে বাকি অংশ পড়ে আসি একসাথে?
কথা বলছিল ব্যাকটেরিয়া। হ্যাঁ! ব্যাকটেরিয়া, যাকে আমরা একবচনে ব্যাকটেরিয়াম নামে চিনি, একধরনের ক্ষুদ্র আণুবীক্ষণিক জীব। ওলন্দাজ বিজ্ঞানী Antony Van leeuwenhoek ১৬৭৫ খ্রিস্টাব্দে এক ফোঁটা বৃষ্টির পানির নিচে ব্যাকটেরিয়ার উপস্থিতি পর্যবেক্ষণ করেন। ব্যাকটেরিয়াদের উপর ব্যাপক গবেষণা এবং ব্যাকটেরিয়া তত্ত্ব প্রতিষ্ঠার কারণে লুই পাস্তুর কে আধুনিক ব্যাকটেরিওলজির জনক বলা হয়। জার্মান ডাক্তার রবার্ট কক ১৯০৫ সালে যক্ষ্মার (mycobacterium tuberculosis) জন্য দায়ী ব্যাকটেরিয়া আবিষ্কার করে নোবেল পুরস্কার পান।
ব্যাকটেরিয়া আদিকোষী জীব এবং এদের কোষে কোন ঝিল্লিবদ্ধ অঙ্গানু থাকে না, কেবলমাত্র রাইবোজোম থাকে। দেখতে এতটাই ক্ষুদ্রাকায় যে অণুবীক্ষণ যন্ত্র ছাড়া এদের দেখা যায় না। এই আদিকোষী জীবের উৎপত্তি ঘটেছিল প্রায় ৩৬০ কোটি বছর পূর্বে আর্কিওজোইক যুগে।
ব্যাকটেরিয়ার কোষ প্রাচীরের প্রধান উপাদান মিউকো প্রোটিন। এর সাথে মুরামিক অ্যাসিড, টিকোইক এসিড থাকে। এর জেনেটিক ম্যাটেরিয়াল হল দ্বিসূত্রক, বৃত্তাকার ডিএনএ অণু, যা ব্যাকটেরিয়াল ক্রোমোজোম হিসেবে পরিচিত। ব্যাকটেরিয়া কোষের যেখানে ডিএনএ পাওয়া যায় তাকে নিউক্লিওয়েড বলা হয়।
ব্যাকটেরিয়ার শ্রেণীবিভাগ –
ক. কোষের আকৃতিগত
খ. রঞ্জনভিত্তিক
গ. ফ্লাজেলা ভিত্তিক
তাছাড়াও একটি আদর্শ ব্যাকটেরিয়াম এর গঠনে যা যা থাকে – কোষ প্রাচীর, ক্যাপসুল, ফ্লাজেলা, পিলি, প্লাজমা মেমব্রেন, মেসোজোম, প্লাসমিড, এবং ক্রোমোজোম।
ফায ভাইরাসের প্রতি খুবই সংবেদনশীল থাকে যাদেরকে আমরা ব্যাকটেরিওফায হিসেবে জানি।
ব্যাকটেরিয়ার জনন
ব্যাকটেরিয়া প্রধানত অযৌন পদ্ধতিতে জনন করে থাকে কিছু কিছু ব্যাকটেরিয়া অঙ্গ জনন পদ্ধতিও অবলম্বন করে।
বিভাজন পদ্ধতি একটি অযৌন জনন পদ্ধতি । উপযুক্ত পরিবেশ হলে এই প্রক্রিয়ায় E.coli ব্যাকটেরিয়া একদিনে ৭২ টি জেনারেশন সৃষ্টি করতে পারে। কিন্তু বাস্তবে তা সম্ভব হয় না কারণ কয়েক জেনারেশন পরেই তাদের খাবার ঘাটতি হয় এবং এদের বর্জ্য পরিবেশকে বিষাক্ত করে ফেলে, তাই দ্বি-ভজন প্রক্রিয়াটি বন্ধ হয়ে যায়।
মূলত ব্যাকটেরিয়াতে কোন যৌন জনন ঘটে না তবে বংশগতীয় বস্তু স্থানান্তরিত হয়। এই স্থানান্তর তিনভাবে হতে পারে –
- কনজুগেশন নালি পথে
- ট্রান্সফর্মেশন পদ্ধতিতে
- ট্রান্সডিকশন পদ্ধতিতে
প্রকৃত ক্রোমোজোম না থাকায় ব্যাকটেরিয়ার জননে মাইটোসিস ও মায়োসিস ঘটে না।
ব্যাকটেরিয়ার উপকারিতা
কৃষি ক্ষেত্রে, চিকিৎসা ক্ষেত্রে, শিল্পক্ষেত্রে, পদার্থ প্রস্তুতকরণ, এবং মানব জীবনে ব্যাকটেরিয়ার গুরুত্ব এবং উপকারিতা অপরিসীম। একটা করে উদাহরণ দিলেই বোঝা যাবে –
- clostridium, azotobacter, pseudomonas – এগুলো সরাসরি বায়ু হতে নাইট্রোজেন গ্রহণ করে নাইট্রোজেন যৌগ হিসেবে মাটিতে স্থাপন করে এবং এতে মাটির উর্বরতা বৃদ্ধি পায়। বাংলাদেশে মসুর ডালের মূলে নডিউল তৈরি করে rhizobium গণের তিনটি প্রজাতি – R. bangladeshense, R.bine, R.lentis.
- চিকিৎসা ক্ষেত্রে, বিভিন্ন রোগের প্রতিষেধক তৈরিতে ব্যাকটেরিয়া ব্যবহার করা হয়। যেমন- ডিপথেরিয়া, হুপিংকাশি, ধনুষ্টংকার।
- শিল্পক্ষেত্রে, চা-কফি, দুগ্ধ জাত শিল্পে, পাট শিল্পে, চামড়া শিল্পে, টেস্টিং সল্ট প্রস্তুতিতে ব্যবহার করা হয়। যেমন – ব্যাসিলাস নামক প্রজাতি চামড়ার লোম ছাড়ানোর কাজে সহায়ক, পাট শিল্পের ক্লাসট্রিডিয়াম এবং ল্যাকটোব্যাসিলাস হতে মাখন, দই, পনির, ছানা তৈরিতে সাহায্য করে।
- মানব জীবনের সেলুলোজ হজমে, ভিটামিন তৈরিতে, এবং জিন প্রকৌশলে ব্যবহৃত হয়।
- Pseudomonas aeruginosa সমুদ্রের পানিতে ভাসমান তেল অপসারণে ব্যবহৃত হয়। এছাড়াও প্রকৃতির সুরক্ষায় গুরুত্বের জন্য ব্যাকটেরিয়াকে ‘প্রকৃতির ঝাড়ুদার’ বলা হয়।
ব্যাকটেরিয়ার অপকারিতা
ব্যাকটেরিয়ার সবচেয়ে বড় অপকারিতা এইটাই যে ব্যাকটেরিয়া মানবদেহে অনেক কঠিন কঠিন রোগ সৃষ্টি করতে সহায়ক। আর শুধু মানব দেহেই না উদ্ভিদের দেহেও ব্যাকটেরিয়া বিভিন্ন রোগ সৃষ্টি করে থাকে।
- ধান গাছের ব্লাইট রোগ, কমলা ও লেবু গাছে সাইপ্রাস ক্যানকার, আপেল ও আঙ্গুরে গ্রাউন গল, টমেটো ও বেগুনে ব্যাকটেরিয়াল উইল্ট – এগুলো ব্যাকটেরিয়ার কারণেই হয়ে থাকে।
- মানবদেহে যক্ষ্মা, কলেরা, টাইফয়েড, ডিপথেরিয়া, গনোরিয়া, ইউরিনারি ইনফেকশন – এগুলো ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগ।
- কলিফর্ম নামক ব্যাকটেরিয়া পানিকে পানের অযোগ্য করে।
এছাড়াও কিছু ব্যাকটেরিয়া আছে যেগুলো জৈব সন্ত্রাস, যানবাহনে দুর্ঘটনায় দায়ী, প্রতিদিনে ব্যবহার্য দ্রব্যের ক্ষতিসাধন করে এবং ইত্যাদি।
ব্যাকটেরিয়া নামক এই অনুজীবের রাজ্যের শাখা-প্রশাখা, কাজ, শ্রেণীবিভাগ অনেক বিস্তৃত।
শুরুতে করা একটি প্রশ্নের উত্তর বাদ রয়ে গেছে, তাই না?
তাপমাত্রা-
বলা হয়ে থাকে ব্যাকটেরিয়া গরম এবং ঠান্ডা উভয় তাপমাত্রায়। বাঁচতে পারে। তবে তা বৈশিষ্ট্য এবং পরিবেশের উপর নির্ভর করে। এখন কথা হচ্ছে কেন উভয় তাপমাত্রায় বাঁচতে পারে বললাম। কারণ এদের মিনিমাম তাপমাত্রা মাইনাস ১৭° সেন্টিগ্রেড এবং ম্যাক্সিমাম তাপমাত্রা ৮০° সেন্টিগ্রেড পর্যন্ত হতে পারে। অর্থাৎ, এরা -১৭° – ৮০° সেন্টিগ্রেড তাপমাত্রায় বাঁচে।
Methanopyrus নামক ব্যাকটেরিয়া ১১০°সে. তাপমাত্রায়ও টিকে থাকে, ভালো বৃদ্ধি ঘটে ৯৮°সে. তাপমাত্রায় কিন্তু তাপমাত্রা ৮৪°সে. এর কম হলে মরে যায়। Methanogens প্রতিবছর বায়ুমন্ডলে দুই বিলিয়ন টন মিথেন গ্যাস মুক্ত করে।
এমন আরো ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন।
লেখিকা,
মামশুকা ফারহাত
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE