আমরা বাংলাদেশে বসবাস করি। আর এই বাংলাদেশ মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্যে দিয়ে স্বার্বভৌমত্ব লাভ করেছে। বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি নারীর ভূমিকা রয়েছে অপরিসীম ও অতুলনীয়। এই মুক্তিযুদ্ধে নারীরা তাদের সাহসীকতা, বিচক্ষণতা, শ্রম, মেধা-মননশীলতা,সৃজনশীলতা দিয়ে অংশ গ্রহণ করেছিলেন। দেশের জন্য নারীরা তাদের সর্বস্ব ত্যাগ করেতেও দ্বিধা বোধ করেন নি। দেশ ও দশের জন্য নারীরা তাদের আব্রু বিসর্জন দিয়েছে।

 

 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নারীর অবদান বিশদ আলোচনা করলে দেখা যায়, স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধে নারীরা তার সব সামর্থ্য প্রয়োগ করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশ তৈরিতে। এছাড়াও নারীরা মুক্তিযুদ্ধে অত্যাধুনিক অস্ত্র প্রশিক্ষণ নিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে গেরিলা থেকে শুরু করে সম্মুখ যুদ্ধে অংশ নিয়েছে। কিন্তু আমাদের দেশের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে নারীর অবদানকে সেইভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে বলে মনে হয় না। কারণ বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নিপীড়নের অগ্নিসাক্ষী বা লাঞ্ছিত বলেই উঠে এসেছে নারীদের নাম। আর এ কারণেই হয়তো রাজনৈতিক নেতা থেকে শুরু করে স্কুল,কলেজ ও ভার্সিটির ছাত্র ছাত্রী ও শিক্ষকরা মঞ্চে উঠেই অনর্গল বলতে থাকে ৩০ লক্ষ শহীদ ও ২লাখ মা ও বোনের ইজ্জত এর বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে স্বাধীনতা। কিন্তু একটি স্বাধীন -সার্বভৌম ভূখন্ডের জন্য ক্ষুধা-দারিদ্র মুক্ত ও বৈষম্যহীন জাতি নির্মাণের জন্য নারীরা এগিয়ে এসেছে বীরদর্পে।

 

 

অস্ত্র হাতে নারী : মহান মুক্তিযুদ্ধে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এগিয়ে এসেছিল। নারীরাও হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছিল, হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে। নারীদের নিতে হয়েছিল প্রশিক্ষণ। কলকাতার বিএলএফ ক্যাম্পে ৩০০ নারীকে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছিল। তাদের মধ্যে রয়েছে : কাকন বিবি, তারামন বিবি, গীতা মজুমদার, আলেয়া বেগম,মিতিল, রওশন আরা। তারা তাদের পরিচয় গোপন রেখে নানা জায়গায় হানাদার বাহিনীদের বড় বড় ক্যাম্প এ গ্রেনেড নিক্ষেপ করতো। এছাড়াও গোপন তথ্য আদান প্রদান, অস্ত্র বহন, অস্ত্র চালনা এবং লুকিয়ে রাখার ক্ষেত্রে নারীর ভূমিকা রয়েছে অপরিসীম।

 

 

নারী সংগ্রামে: ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি বাহিনীর বিরুদ্ধে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল। দেশের মানুষদের সাহসী করে তোলার জন্য মিছিল মিটিংয়ে আয়োজন করেছিল। নারীরা মুক্তিযোদ্ধাদের উৎসাহিত করার জন্য বিভিন্ন রকমের গান ও নাটক রচনা করেছিল। নারীরা যুদ্ধে প্রেরণা যুগিয়েছে পুরুষদের মনে।

 

জনমত গঠন: মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গঠনের জন্য বাংলাদেশ এবং বাংলাদেশের বাহিরে অনেক নারীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছিল। তাদের মধ্যে রয়েছে বদরুন্নেছা আহমেদ, মতিয়া চৌধুরী এছাড়াও ভারতীয় নারী, লন্ডন প্রবাসী এবং অনেক বিদেশী নারী জনমত গঠনে কাজ করেছিল।

 

গেরিলা যুদ্ধ ও গণবাহিনী: মুক্তিযুদ্ধে নারীরা পুরুষের পাশাপাশি গেরিলা বাহিনী ও গণবাহিনীতে যোগ দিয়ে সরাসরি অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছিল। তারা শত্রুদের গাড়িতে এবং গানবোটে গ্রেনেড নিক্ষেপ করে কৃতিত্বের পরিচয় দিয়েছিল।

 

তাই তো কবিরা বলেগেছেন নারীদের বীরত্বের কথা।

 

“পৃথিবীর যা মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর, অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর।”

 

পৃথিবীর অন্যান্য দেশের ন্যায় বাংলাদেশ সুজলা, সুফলা, শস্য, শ্যামলা অনেক গৌরবময় ইতিহাস রয়েছে।তার মধ্যে সবচেয়ে বড় ইতিহাস হচ্ছে বাঙালির ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ। এই মুক্তিযুদ্ধে নারীরা অনেক আত্মত্যাগ এর বিনিময়ে দিয়ে গেছে আমাদের এই স্বাধীন সার্বভৌম দেশ। তাদের এই আত্মত্যাগের জন্য আমরা আজ অর্জন করেছি আমাদের প্রচন্ড ভালোবাসা, অহংকার ও সম্মানের লাল সবুজের পতাকা। মুক্তিযুদ্ধের ৫৩ বছর পর মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সম্পর্কে আলোচনা করতে হলে অবশ্যই এসব মহীয়সী নারীর ত্যাগ তিতিক্ষা ও অবদানের বিষয়ে আলোকপাত করা জরুরি। তাদের মধ্যে কয়েকজন উল্লেখযোগ্য নারী হলেন:

 

কাকন বিবি

যার পুরো নাম হলো কাকাত হেনিনচিতা। তিনি খাসিয়া সম্প্রদায়ের আদিবাসী ছিলেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে একজন দুঃসাহসী নারী মুক্তিযুদ্ধা ছিলেন। নারী মুক্তিযুদ্ধে কৃতিত্ব পূর্ণ অবদানের জন্য তাকে মুক্তিবেটি বা অগ্নিকন্যা বলা হয়ে থাকে। তিনি ৫ নং সেক্টরের অধিনে শত্রুবাহিনীর বিপক্ষে যুদ্ধ করেন। তিনি প্রায় ২০ টির বেশি সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। এই যুদ্ধ গুলোতে অংশ গ্রহণ করতে গিয়ে তিনি পায়ের উরুতে গুলিবিদ্ধ হন। জীবনের শেষের দিন পর্যন্ত তিনি এই ক্ষত বহন করেন।

 

তারামন বিবি

তার পুরো নাম তারাবানু।মাত্র ১৩ বছর বয়সে তিনি মুক্তিযুদ্ধে নাম লেখান এই মহীয়সী নারী। তিনি যুদ্ধের সময় ১১ নং সেক্টর এর অধীন মোহনগঞ্জ, গাইবান্ধার ফুলছড়ি সহ বহু সম্মুখ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেন। তিনি অত্যন্ত সাহসীকতা ও কৃতিত্বের সাথে গুপ্তচর বৃত্তির কার্য সম্পাদন করেন। কখনো ভিক্ষুক বা কখনো পাগলের বেশে তিনি গুপ্তচর বৃত্তির কাজ সম্পাদন করেন।

 

সিতারা বেগম

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধের অংশ গ্রহণ করা আরেক মহীয়সী নারীর নাম ক্যাপ্টেন ডা. সীতরা বেগম। শুধু রণাঙ্গনে অস্ত্র চালনা করেই নয় তার সাথে নিজের পেশাকে কাজে লাগিয়ে ও যুদ্ধে সময় শরনার্থী রোগীদের সেবাশুশ্রূষা দিয়ে দেশমাতৃকার যুদ্ধে অবদান রেখেছে এই নারী।

 

 

মুক্তিযুদ্ধের সময়ই নারীরা বুঝিয়ে দিয়েছেন যে নারীরা পারে না এমন কোন কাজ নেই। উল্লিখিত এই নারী মুক্তিযুদ্ধা ছাড়াও আরো অনেক নারী ছিল যারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ ভাবে মুক্তিযুদ্ধে অবদান রেখেছে। তারপরও আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজে কিছু পুরুষ আছে যারা নারীদের অবহেলা অবমাননা করে। তারা তাদের আধিপত্য বিস্তারের জন্য নারীদের সকল কাজে বাঁধা দিয়ে থাকে। যুদ্ধের এতো বছর পরো নারীরা আজ স্বাধীন নয়। তাদের চলতে গেলে কোনো নতুন কাজ করতে গেলে নানা রকম বাঁধার সম্মুখীন হতে হয়, কটু কথার মধ্যে দিয়ে যেতে হয়।

 

এরকম আরো ব্লগ পরতে, ক্লিক করুন

 

লেখক, 

তিথি রাণী সরকার

ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট

YSSE