চেয়েছিলেন বৈমানিক হবেন, বিশাল নীলাকাশে উড়ে বেড়াবেন। কিন্তু হলেন পর্বতারোহী,জয় করলেন  সাদা বরফে ঢাকা পৃথিবীর সর্ববৃহৎ পর্বতশৃঙ্গ মাউন্ট  এভারেস্ট।

বলছি নিশাত মজুমদারের কথা। যিনি প্রথম বাংলাদেশী নারী হিসেবে এভারেস্ট জয়ীর তালিকায় নাম লিখিয়েছেন,ঠাই পেয়েছেন ইতিহাসের পাতায়। হয়েছেন তার মতন হাজারো নারীর অনুপ্রেরণা যারা স্বপ্ন ছোঁয়ার ইচ্ছে বুকে ধারন করে কাজ করে যাচ্ছেন।

আজকের এই ব্লগে আমরা জানবো নিশাত মজুমদারের জীবন, শৈশব, এভারেস্ট জয়ের গল্প নিয়ে।  

  • পরিচিতিঃ

১৯৮১ সালে লক্ষীপুরের রামগঞ্জে জন্ম গ্রহন করেন নিশাত মজুমদার।তার  বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান মজুমদার, এবং তার মায়ের নাম আশুরা বেগম। পরিবারের চার ভাইবোনের মধ্যে নিশাত মজুমদার দ্বিতীয়।

  • শিক্ষা ও কর্মজীবনঃ 

নিশাত মজুমদার ঢাকার একটি বালিকা বিদ্যালয় থেকে ১৯৯৭ সালে মাধ্যমিক পাশ করেন। পরবর্তীতে ১৯৯৯ সালে শহীদ আনোয়ার গার্লস কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক করে ঢাকা সিটি কলেজ থেকে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্ন করেছেন। এই সময়ে তিনি হিসাববিজ্ঞানে পড়াশোনা করেছেন। 

সর্বশেষ পাওয়া তথ্যমতে তিনি বর্তমানে ঢাকা ওয়াসায় প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করছেন।

  • পর্বতারোহণের সূচনাঃ

ছোটবেলায় বৈমানিক হওয়ার স্বপ্ন দেখলেও কখনো পর্বতারোহী হওয়ার ইচ্ছে ছিল না।

কিন্তু ভাগ্যক্রমে বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং এন্ড ট্র‍্যাকিং ক্লাবের প্রতিষ্ঠাতা ইনাম আল হকের সাথে পরিচয় হয়, এবং তার হাত ধরেই প্রথমবারের মতন পর্বত আরোহনের সুযোগ হয় নিশাতের।

পরবর্তীতে এডভেঞ্চারের দেখা পান অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল অ্যাসোসিয়েশনের এক সংগঠন দলছুটের আয়োজনে রেক্সোনা চ্যালেঞ্জ প্রোগ্রামে। ক্লাইম্বিং এবং র‍্যাপলিং এর হাতেখড়ি তখনি।

২০০৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মত আয়োজিত বিশ্ব পর্বত দিবসে জুমার ক্লাইম্বিং করা একমাত্র নারী হওয়ার মাধ্যমেই পরিচয়।

পরের বছর থেকে বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাবের সব আয়োজনে নিয়মিত ছিলেন তিনি। তৎকালীন বাংলা মাউন্টেনিয়ারিং অ্যান্ড ট্রেকিং ক্লাবই ছিল দেশের একমাত্র পর্বতারোহণ ক্লাব।

  • এভারেস্ট যাত্রার হাতছানিঃ

২০০৬ সালের ৮ মার্চ বিশ্ব নারী দিবস উপলক্ষে  সাদিয়া সুলতানা শম্পার নেতৃত্বে ৮ নারী উঠলেন ক্রেওক্রাডংয়ে।যাদের মধ্যে নিশাত মজুমদার ও ছিলেন ।

 সেবছর মে মাসেই তিনি এভারেস্ট বেসক্যাম্প ট্রেকিংয়ে দ্বিতীয় নারী দলের সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন।

নিজের চোখে এভারেস্ট দেখে তিনিও স্বপ্ন দেখা শুরু করেন এভারেস্ট জয়ী হওয়ার। ফলে ২০০৭-এর মে মাসে নিশাত এক মাস ট্রেনিং নেন বিখ্যাত পর্বতারোহণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান হিমালয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ইনস্টিটিউটে। যাতে  তিনি ‘এ’ গ্রেড রেজাল্টসহ বেসিক পবর্তারোহণ কোর্সে উত্তীর্ণ হন।

কিন্তু একবারেই কোনো অভিযাত্রী এভারেস্ট চূড়ায় উঠতে পারেন না। এজন্য তাকে ছোট-বড় আরো কিছু পাহাড়-পর্বতে আরোহণ করার মাধ্যমে নিজেকে উপযোগী করে তুলতে হয়। 

তাই এভারেস্ট অভিযানের প্রস্তুতি হিসেবে পরের বছরের মে মাসে হিমালয়ের সিঙ্গুচুলি পর্বতশৃঙ্গে (২১ হাজার ৩২৮ ফুট) ওঠেন।

একই বছরের সেপ্টেম্বরে তিনি ভারতের উত্তর কাশীর গঙ্গোত্রী হিমালয়ের গঙ্গোত্রী-১ পর্বতশৃঙ্গে (২১ হাজার ফুট) বাংলাদেশ-ভারত যৌথ অভিযানে অংশ নেন। নিশাত ২০০৯ সালের এপ্রিলে পৃথিবীর ৫ম উচ্চতম শৃঙ্গ মাকালুতে (২৭ হাজার ৮৬৫ ফুট) ভারত-বাংলাদেশ যৌথ অভিযানে অংশ নেন।

  • এভারেস্ট যাত্রার গল্পঃ

২০১২ সালের ৬ এপ্রিল এভারেস্টের উদ্যেশ্যে ঢাকা থেকে নেপালের রাজধানী কাঠমান্ডু তে  যান নিশাত মজুমদার। কাঠমান্ডুতে প্রয়োজনীয় কিছু কেনাকাটা শেষে  ৯ এপ্রিল সেখান থেকে  লুকনা পৌঁছান।

এভারেস্টে আরোহণ করার ১৪ টি পথ থাকলেও প্রধান পথ দুটি।যার একটি  নেপালের আর দ্বিতীয়টি হলো তিব্বতের দিক থেকে।

তিব্বতের পথ নেপালের তুলনায় সহজ, কারন সেখান থেকে বেস ক্যাম্প পর্যন্ত গাড়িতে যাওয়া যায়।তবে নেপালের দিকটা অনেক বিখ্যাত কারন এই পথ ধরেই একসময় তেনজিং ও হিলারি উঠেছিলেন।তাই  নিশাত মজুমদাররাও নেপালের দিক থেকে যাত্রা শুরু করেন।

দীর্ঘ আট দিন ট্র্যাকিং করে বেস ক্যাম্পে পৌঁছান তারা।তারপর শুরু হয় সেই কাংখিত যাত্রা।

তারপর এক এক করে বিভিন্ন ক্যাম্প পাড় হয়ে ১৯ মে শনিবার নেপালের স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে ৯টায় তিনি ২৯ হাজার ২৯ ফুট (৮,৮৪৮ মিটার) উচ্চতার মাউন্ট এভারেস্টে আরোহণ করেন।

  • এভারেস্ট জয়ঃ

প্রায় একমাস চারদিনের অভিযান শেষে ১৯ মে রোজ শনিবার স্থানীয় সময় সকাল সাড়ে নয়টায় প্রায় ২৯ হাজার ২৯ ফুট উচ্চতার মাউন্ট এভারেস্ট এ পৌছান। 

গড়েন ইতিহাস। লেখেন প্রথম বাংলাদেশী নারীর এভারেস্ট জয়ের গল্প। 

সমাজের বিভিন্ন বাধ্যবাধকতা পার করে পরিবারের সাপোর্ট সাথে নিয়ে যে কোন কিছু জয় করা সম্ভব তার অন্যতম দৃষ্টান্ত নিশাত মজুমদার।

তিনি শুধুমাত্র ইতিহাসের পাতায়ই স্থান পাননি, বরং নারী বলেই নিজেকে দূর্বল অসহায় ভাবার যে কোন কারন কারন নেই, তার একটি শিক্ষা সবাইকে দিয়ে গেছেন। শেকড় থেকে শেখরে নারীদের জয়গান ছুটুক সর্বত্র। 

এমন আরো সাফল্যগাথা গল্প পড়তে ক্লিক করুন।

লেখক

আব্দুল্লাহ আর রাফী

ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট

YSSE