বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এমন অনেক চরিত্র আছে যারা তাদের স্বতন্ত্র কাব্য, গদ্য বা চিন্তার জগৎ সৃষ্টি করে অনন্য উচ্চতায় পৌঁছেছেন। তবে একই সঙ্গে পাঁচজন স্রষ্টার অবদান যখন সমকালীন সাহিত্যে জ্বলজ্বল করে ওঠে, তখন সেটি স্বর্ণযুগের সূচনা করে। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে এমনই এক যুগের প্রতীক পঞ্চপাণ্ডব।
কারা এই পঞ্চপাণ্ডব? চলুন জেনে নেওয়া যাক
পঞ্চপাণ্ডবে উল্লেখযোগ্য চমৎকার স্রষ্টারা হলেন অমিয় চক্রবর্তী(১৯০১-১৯৮৬), জীবনানন্দ দাশ(১৮৯৯-১৯৫৪), বুদ্ধদেব বসু(১৯০৮-১৯৭৪), বিষ্ণু দে(১৯০৯-১৯৮২), সুধীন্দ্রনাথ দত্ত(১৯০১-১৯৬০)।
তাঁদের অনন্য অবদান বাংলা সাহিত্যে শুধু সমৃদ্ধই নয়, বাংলা ভাষায় মাধুর্যতা এবং সাবলীল সৃষ্টি ফুটে উঠেছে।
তাঁদের প্রত্যেকের পথ আলাদা হলেও এক সুরে বাঁধা তাঁদের শিল্পকর্ম।
অমিয় চক্রবর্তী এক স্বতন্ত্র স্বর। ‘পঞ্চপাণ্ডব’ খ্যাত আধুনিক কবিদের মধ্যে তিনি সবচেয়ে দ্বন্দ্বমুখর ও বহুধাবিভক্ত। ব্যক্তিজীবনে রবীন্দ্র-সান্নিধ্য ও ত্রিশের মধ্যচেতনার দ্বৈত টানাপড়েনে অস্থির অমিয় চক্রবর্তী বরাবরাই বদলে নিয়েছেন তাঁর কবিতার ভরকেন্দ্র। কবিতার ভাব ও আঙ্গিক নিয়ে নিরীক্ষাপ্রবণ এই কবি সমকালের অন্যান্য কবিদের চেয়ে স্বতন্ত্র এবং সাবলীল।
জীবনানন্দ দাশ, নির্জনতার কবি। তিনি বাংলা কবিতায় আধুনিকতার সূচনা করেছেন। তাঁর কবিতা নির্জনতা, প্রকৃতি এবং সময়ের গভীর দর্শন বরবারই পাঠকদের মুগ্ধ করে। ‘রূপসী বাংলা’র মতো কাব্যগ্রন্থে তিনি বাংলার প্রকৃতির অসামান্য সৌন্দর্য সাবলীলভাবে তুলে ধরেছেন।
বুদ্ধদেব বসু ছিলেন আধুনিক সাহিত্যের পথিকৃৎ৷ তিনি ছিলেন একই সাথে গদ্যকর এবং আধুনিক কবি। তাঁর কবিতা এবং প্রবন্ধে ভাষার মাধুর্য এবং চিন্তার গভীরতা স্পষ্ট। ‘কবিতা’ পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে তিনি বাংলার কাব্যধারাকে এক নতুন দিকনির্দেশনা দিয়েছেন।
বিষ্ণু দে তার কাব্যে ইতিহাস, শিল্প এবং জীবনের ত্রিবেণী তৈরি করেছিলেন। তাঁর কবিতায় রোমান্টিকতা এবং বুদ্ধিবৃত্তিক দৃষ্টিভঙ্গির মেলবন্ধন দেখা মেলে। তিনি ছিলেন বহুমাত্রিক কবি যার রচনায় অতীতের ঐতিহ্য এবং ভবিষ্যতের সম্ভাবনা একত্রিত হয়েছে৷
সুধীন্দ্রনাথ দত্ত ছিলেন একজন চেতনার কবি। তাঁর কবিতায় বুদ্ধিবৃত্তিক লেখার গভীর ছাপ রয়েছে। তাঁর রচনায় শব্দচয়ন এবং গঠনশৈলীর পরিপক্বতা দেখা যায়। তিনি ছিলেন বাংলা কাব্যের ‘চেতনার কবি’ যার লেখায় জীবনের সূক্ষ্ম অনুভূতি এবং চিন্তার গভীরতা প্রকাশ পায়।
পঞ্চপাণ্ডবের সৃষ্টির সম্মিলন হয়তো শত বছরে একবার দেখা মেলে। এই পাঁচজন স্রষ্টার সৃষ্টিকর্ম একত্রে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তাঁরা প্রত্যেকে সাহিত্য কোনো না কোনো ভাবে নতুন পথের সূচনা করেছে। ফলে বাংলা সাহিত্যে তাদের অবদান অবিস্মরণীয়। অমিয় চক্রবর্তী যেখানে মানবিকতা গভীরতা তুলে ধরেছেন, জীবনানন্দ দাশ সেখানে প্রকৃতি ও নির্জনতার সুর বাজিয়েছেন৷ বুদ্ধদেব বসু যেখানে আধুনিকতাকে সঞ্জীবিত করেছেন, সেখানে বিষ্ণু দে ইতিহাসকে শিল্পে রূপান্তর করেছেন এবং সুধীন্দ্রনাথ দত্ত চেতনাকে অন্বেষণ করেছেন।
এখনকার সময়ে প্রাসঙ্গিকতা তুলে ধরতে গেলে এটাই বলা যায়, পঞ্চপাণ্ডবের সাহিত্য আজও আমাদের অনুপ্রাণিত করে৷ তাদের নতুন দিগন্তের সূচনা আমাদের নতুন কিছু সৃষ্টিতে উৎসাহিত করে। জীবনের সৌন্দর্য, সংগ্রাম, প্রেম এবং মানবতার যে চিত্র তাঁরা এঁকেছেন, তা আমাদের মনে সাহিত্যের প্রতি ভালোবাসা জাগিয়ে তোলে।
পঞ্চপাণ্ডবের অনন্য সৃষ্টি সমূহ এক চমৎকার দূরদর্শিতার বিষয় হিসেবে ধরে নিব। কেননা ওই সময়ে তাদের উপস্থিতি বর্তমান সময়কে কতটা প্রভাবিত করেছে তা সত্যি অকল্পনীয়। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে তাঁরা উজ্জ্বল নক্ষত্র হিসেবে পরিচিত হয়ে থাকবে।
শেষকথায় একটা বিষয় উল্লেখ করা যায়, সেটা হচ্ছে পঞ্চপাণ্ডব শুধু তাঁদের সময়ের জন্য নয়, বরং চিরকালীন।
সাহিত্য তাঁদের ধ্বনি আমাদের স্মরণ করিয়ে দেয় যে সাহিত্যে শুধু বিনোদন নয়, এটি আমাদের চিন্তা, সংস্কৃতি এবং সভ্যতার অন্যতম প্রভাবক। একটি গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা তাঁরা আমাদের শিখিয়ে গেছেন, সৃষ্টিশীলতা এবং মানবতা একসঙ্গে একই পথে চলতে পারে।
পঞ্চপাণ্ডবের শৈলী ও সুর বাংলার সাহিত্যকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে পৌঁছে দিয়েছে। তাঁদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে আমরা সাহিত্যের সেই ধ্বনিকে ধারণ করতে পারি, যা আমাদের চিন্তার জগৎকে আরও সমৃদ্ধ করে তোলে।
এই রকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন
লেখিকা
জেমি সাইলুক
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE