এ-বছর আর নবান্ন নেই, বান এসেছে

এবার মাঠে হলুদ ধান ফলেনি।

সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের ‘ধান’ কবিতায় খরা মৌসুমে আক্ষেপ করতে থাকা এই করুণ আর্তনাদ এক কৃষকের। সেই আগেকার যুগের মত কৃষকের গোলা ভরা ধান, পুকুরভরা মাছ এখন আর নেই। জলবায়ু পরিবর্তন আর ন্যায্য প্রাপ্যের অভাবে সেই কৃষকের পাতেই বরঞ্চ এখন ভাত জোটে না। অনেকেই পেশা পরিবর্তন করে ঝুঁকছে অন্য পেশায়। 

কিন্তু কৃষক যদি কোনদিন ধান চাষই বন্ধ করে দেয় তবে বাঙ্গালীর পাতে ভাত জুটবে কি উপায়ে? ঈশ্বর পাটুনীর,আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে” চাওয়াটাই তখন মিথ্যে প্রমাণিত হবে।

ধান চাষের সবচেয়ে বড় অন্তরায় হল, এর বারোমাসি আবাদ হয় না। বছরে মাত্র একবারই রোপণকৃত চারা থেকে ধান ফলে। তাই ধান চাষ যেমনি সময় সাপেক্ষ তেমনিই শ্রমসাধ্য। 

এরই প্রেক্ষিতে মৌলভীবাজারের কুলাউড়ার হাজীপুর ইউনিয়নে জিন বিজ্ঞানী ড. আবেদ চৌধুরী উদ্ভাবন করেছেন বারোমাসি ধানের নতুন জাত – পঞ্চব্রীহি

এই যুগান্তকারী ধানের জাতের বিশেষত্ব হল, ফসল কাটার পর গাছটি সম্পূর্ণভাবে অপসারণ ছাড়াই একটি ধান গাছে বিভিন্ন মরশুমের জন্য চারটি অতিরিক্ত ধরনের ধান চাষ করা সম্ভব। প্রতি বছর প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যাপ্রবণ ও খরাপ্রবণ দেশগুলোর ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্য সংকট নিরসনে এটি একটি যুগান্তকারী আবিষ্কার। তাই ভবিষ্যত পৃথিবীর খাদ্য সংকট দূরীকরণে এই আবিষ্কার যে একটি মাইলফলক তা না লিখলেও চলে। 

গত ১২ অক্টোবর সন্ধ্যায় লন্ডন-বাংলা প্রেস ক্লাব আয়োজিত এক সেমিনারে ড. আবেদ এই আবিষ্কারের কথা জানিয়েছেন সাংবাদিকদের।

শুরুর কথা

কুলাউড়ার কানিহাটি গ্রামের সন্তান আবেদ চৌধুরী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কৃষি বিষয়ে উচ্চশিক্ষা শেষে চাকরি নিয়ে চলে যান অস্ট্রেলিয়ায়। সেখানকার জাতীয় গবেষণা সংস্থার প্রধান ধানবিজ্ঞানী হিসেবে ২০ বছর ধানের জিন নিয়ে গবেষণা করেছেন। 

এক পর্যায়ে তার মনে হল, দেশের মানুষের জন্যও এবার কিছু করা দরকার। ফিরে এলেন কানিহাটিতে। গড়ে তুললেন কৃষি খামার। শুরুতে তিনি উদ্ভাবন করেন ডায়াবেটিস প্রতিরোধক রঙিন ভুট্টা ও লাল রঙের চাল। 

তারপর তিনি নজর দিলেন ধানে, যে বিষয়ে তার জ্ঞান অফুরন্ত। ঋতু নির্ভরতা ধানের হাজার বছরের চরিত্র। আর ধানের এই ঋতু নির্ভরতায় তাকে এবার ভাবিয়ে তুলল। আম-কাঁঠালের মতো বছরের পর বছর টিকে থাকার সৌভাগ্য তো ধান গাছের হয় না- এমনটা রোধ করা গেলে কেমন হয়?

কিভাবে এল পঞ্চব্রীহি

সংস্কৃতে আউস ধানকে বলা হয় ‘ব্রীহি’। এই ব্রীহিকে ‘বহুব্রীহি’তে উন্নীত করার লক্ষ্যে ড. আবেদ সাহায্য নিলেন স্থানীয় কৃষকদের। আর এই পুরোটা সময় ধরে ভেবেছেন কি উপায়ে কৃষকদের কেবল সময়ই না, অর্থও বাঁচবে।

২০১০ সালে প্রথমবার কানিহটি গ্রামে ২৫ বর্গমিটার জমিতে ২০টি ধানের জাত নিয়ে গবেষনা শুরু করেন ড. আবেদ। পরের ৩ বছরে ২০টি ধানের জাত নিয়ে গবেষণায় দেখা যায় নির্দিষ্ট ধরণের এ জাত একই গাছে ৫ বার ফলন দেয়ার সক্ষমতা রাখে। স্থানীয় জাতের ধানের সাথে উন্নতমানের ধানের বীজ সংকরায়ন করে এই উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত পাওয়া যায়। দীর্ঘ সময় ধরে ব্যাপক গবেষণার পর অ-রাসায়নিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ব্যবহার করে তিনি পাঁচ ধরনের ধান গাছ আবিষ্কার করেছেন।

২০১০ সালে প্রথমবার কানিহটি গ্রামে ২৫ বর্গমিটার জমিতে ২০টি ধানের জাত নিয়ে গবেষনা শুরু করেন ড. আবেদ চৌধুরী। পরে ৩ বছরে ২০টি ধানের জাত নিয়ে গবেষণায় দেখা যায় নির্দিষ্ট ধরণের এ জাত একই গাছে ৫ বার ফলন দিতে সক্ষম। স্থানীয় জাতের ধানের সাথে উন্নতমানের ধানের বীজ সংকরায়ন করে এই উচ্চ ফলনশীল ধানের জাত পাওয়া যায়।

পঞ্চব্রীহি ধান (বোরো) চাষে প্রথম বার ১১০দিন পর ফলন আসে। পরের ফলন আসে ৪৫/৫০ দিন অন্তর। এই চারায় ১ বার বোরো, ২ বার আউশ ও ২ বার আমন ধানের ফলন পাওয়া যাবে। প্রথমবার হেক্টর প্রতি পঞ্চব্রীহি ধান উৎপাদিত হয় ৪ টন। ধানের চারা রোপণ করতে হয় প্রতি ৪ সে. মি. দূরত্বে।

একই গাছ থেকে পাঁচবার ধান বেরিয়ে আসে বলে তিনি এই ধানের নামকরণ করেছেন ‘পঞ্চব্রীহি’। বলাবাহুল্য, ‘ষষ্ঠব্রীহি’ উদ্ভাবনের জন্যও এই প্রৌঢ় উদ্ভাবক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।

 

একজন আবেদ চৌধুরী

আধুনিক জীববিজ্ঞানের প্রথম সারির গবেষকদের একজন আবেদ চৌধুরীর জন্ম ১৯৫৬ সালের ১লা ফেব্রুয়ারি মৌলভীবাজার জেলার কুলাউড়া উপজেলার হাজীপুর ইউনিয়নের কানিহাটি গ্রামে।

তিনি মৌলভীবাজার সরকারি উচ্চ বিদ্যালয় থেকে মাধ্যমিক ও নটরডেম কলেজ থেকে ১৯৭৫ সালে উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা সম্পন্ন করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রসায়ন বিভাগ থেকে পড়াশোনা শেষ করে উচ্চতর ডিগ্রী অর্জন করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের অরিগন স্টেট ইনিস্টিটিউট অফ মলিক্যুলার বায়োলজি এবং ওয়াশিংটন স্টেটের ফ্রেড হাচিনসন ক্যান্সার রিসার্চ ইনিস্টিটিউট থেকে। 

পিএইচ.ডি গবেষণাকালে ১৯৮৩ সালে তিনি রেকডি নামক জেনেটিক রিকম্বিনেশনের একটি নতুন জিন আবিষ্কার করেন।

তিনি U.S. National Institute of Health, Massachusetts Institute of Technology এবং ফ্রান্সের Ecole Normale Supérieure এর মতো স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা ও গবেষণা কাজে যুক্ত ছিলেন। বর্তমানে তিনি অস্ট্রেলিয়া জাতীয় বিজ্ঞান সংস্থায় একদল বিজ্ঞানীর সমন্বয়ে গঠিত গবেষকদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন।

তারপর কী? 

ড. আবেদকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল পঞ্চব্রীহির বাণিজ্যিক ভবিষ্যত নিয়ে। তিনি গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, নিজের এই উদ্ভাবন তিনি বাণিজ্যিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করবেন না। বরং পঞ্চব্রীহিকে পৌঁছে দিতে চান দেশের দরিদ্র কৃষকদের কাছে। তার আবিষ্কার দেশের মানুষের জীবনযাত্রার মানোন্নয়নে কাজে লাগলেই তিনি খুশি।

নতুন পঞ্চব্রীহি ধানের জাত বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চলেও এখন ছড়িয়ে দেয়ার উপযোগী হয়েছে বলেও তিনি সম্প্রতি জানিয়েছেন। চেয়েছেন সরকারের সহযোগিতা। এ ধান ৩ গুণ কম খরচেই উৎপাদন করা যাবে বলে জানান এ বিজ্ঞানী।

তার মতে, সারা দেশের কৃষকদের মধ্যে এই ধান চাষের কৌশলটি ছড়িয়ে দিলে বাংলাদেশ আগামী ৫০ বছরের জন্য তার সমগ্র জনসংখ্যার জন্য খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পারে।

ড. আবেদ চৌধুরীর মত সোনার মানুষের হাত ধরেই বাংলার কৃষকের গোলা আবার ভরে উঠুক সোনারঙা ধানে, এটাই চাওয়া।

আরও ব্লগ পরতে এখানে ক্লিক করুন।

লেখক,

দীপ্ত বিশ্বাস

ইন্টার্ন, কনটেন্ট রাইটিং বিভাগ

YSSE