প্রবাদ আছে- শিক্ষা জাতির মেরুদণ্ড। প্রতিটি মানুষের জীবনে শিক্ষা ব্যবস্থা শুরু হয় শৈশব থেকে। শৈশব হলো প্রথম ধাপ যা দ্বারা শুরু হয় নিত্যনতুন শিখার পথসমূহ। শিশু কাল থেকে আমাদের যাত্রা শুরু হয় বিদ্যালয় যাওয়ার। বিদ্যালয় হলো এমন এক পরিবেশ যেখানে শিক্ষার্থীদের কাটাতে হয় বেশকিছু সময়। যদি এই পরিবেশটা মনমুগ্ধকর না হয় তবে শিক্ষার্থীদের বেড়ে উঠা থমকে যায়। কেননা তারা এই পরিবেশে শিখতে পারে নিত্যনতুন সকল অভিনব পদ্ধতি। কেমন হয় যদি পড়াশোনার মাঝে নতুন নতুন সম্ভাবনাময়, আনন্দময় এবং পরিবেশবান্ধব কিছু দিক উন্মোচন করা যায়?
চলুন দেখেনিই এই দিকসমূহ।
বিদ্যালয় পাঠদানের ক্ষেত্রে শিক্ষকদের মূল উদ্দেশ্য থাকে শ্রেণিকক্ষের সকল শিক্ষার্থী যেনো তাদের পাঠদানের সঠিক জ্ঞানটুকু অর্জন করতে পারে।এখন এই জ্ঞান চর্চায় যদি ভিন্নতা অবলম্বন করা যায় তবে আমাদের কোমলমতি শিশুরা তাদের পড়াশোনায় বেশি আগ্রহী হয়ে উঠবে।শ্রেণিকক্ষে পড়ানোর সময় বেশ কিছু সমস্যার মুখোমুখি হন শিক্ষকরা। এই সমস্যাগুলোর মধ্যে কিছু সমস্যা এমন থাকে যা প্রাইমারি স্কুল থেকে আরম্ভ করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত- অর্থাৎ, সমস্ত স্তরেই দেখতে পাওয়া যায়।
আমাদের প্রথাগত পড়ানোর পদ্ধতিতে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই শিক্ষকগণ পড়িয়ে যান, আর ছাত্র-ছাত্রীরা শুনে যায়। ক্লাসে মাঝেমধ্যে মাস্টারমশাই একটি বা দু’টি ছোট প্রশ্ন করেন এবং সেখানে ছাত্রছাত্রীরা হয় হাত তোলে (যদি হ্যাঁ বা না জাতীয় বা মাল্টিপল চয়েস উত্তর হয়), অথবা মাস্টারমশাই এক-দু’জন ছাত্রছাত্রীকে সেই প্রশ্নের উত্তর দিতে বলেন।
এই প্রথাগত পদ্ধতিতে ক্লাসের কত অংশ ছাত্রছাত্রী আসলে আলোচ্য বিষয় বুঝতে পারল, সেই তথ্য পাওয়া খুব মুশকিল। এর কারণ হিসাবে কয়েকটি বিষয় তুলে ধরা যায়ঃ
১। যে প্রশ্নের উত্তর হাত তুলে দেওয়া যায়, সেখানে অনেক সময় একজন অন্যজনের উত্তরে প্রভাবিত হতে পারে। ধরা যাক, কোন একটা বক্তব্য রেখে মাস্টারমশাই ছাত্র-ছাত্রীদের জিজ্ঞেস করলেন এই বক্তব্যটা সঠিক না বেঠিক? সঠিক মনে হলে ছাত্র-ছাত্রীদের হাত তুলতে নির্দেশ দিলেন তিনি। এক্ষেত্রে, যদি ক্লাসের ‘সেরা’ ছাত্রছাত্রীদের কয়েকজন বা ক্লাসের একটি বড় অংশ হাত তোলে, তাহলে সম্ভবত অনেক ছাত্র-ছাত্রীই তাদের দ্বারা প্রভাবিত হবে। ভাবনা চিন্তা না করেই ক্লাসের বাকি অংশের সাথে তাল মেলাবে। অর্থাৎ, মাষ্টার মশাইয়ের পক্ষে ক্লাসের ঠিক কত অংশ ছাত্র-ছাত্রী নিজে থেকে বক্তব্যটা বুঝতে পেরেছে, সেই তথ্য জোগাড় করা মুশকিলের।
২। হাত তুলে উত্তর দেওয়া যায় এমন প্রশ্নের বদলে যদি মাস্টারমশাই প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা করেন, তাহলে প্রায়শই দেখা যায়, মনস্তাত্তিক কারণেই ক্লাসের বেশ কিছু ছাত্র-ছাত্রী সেই আলোচনায় অংশ নেবে না। অনেকে ক্লাসের পড়া মোটামুটি বুঝতে পারলেও আত্মপ্রত্যয়ের অভাবে ভোগে। এক্ষেত্রে, কারোর যদি অটিজম বা অন্য কোন লার্নিং ডিসএবিলিটি থাকে, তার প্রভাব পড়ে।
অথচ, ক্লাসের কত অংশ ছাত্র-ছাত্রী কোন একটা আলোচ্য বিষয়ের মূল বক্তব্য বুঝেছে, সেই তথ্য না জানতে পারার ফল সুদূরপ্রসারী। এমনটা প্রায়ই হয়ে থাকে, যে, মাস্টারমশাই এক আলোচনা থেকে চলে গিয়েছেন অন্য আলোচনায়, কিন্তু ক্লাসের একটা বড় অংশ ভুল বুঝেছে, বা তাদের কাছে সব ‘ঘেঁটে গেছে’। অনেক সময়ই কোন কন্সেপ্ট-এর গোড়ার জায়গা পরিষ্কার না হলে সেই বিষয়ে সঠিক ধারণা তৈরি করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়। ছাত্রছাত্রীরা বাধ্য হয় বই-এর লাইন বা নোট মুখস্ত করতে।
অনেক সময়ই কোন কন্সেপ্ট-এর গোড়ার জায়গা পরিষ্কার না হলে সেই বিষয়ে সঠিক ধারণা তৈরি করা প্রায় অসম্ভব হয়ে যায়।
শিক্ষা প্রদানের বিভিন্ন কৌশলের মধ্যে “Card Method” হল একটি পদ্ধতি যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা গ্রহণের পর তাদের বিষয় ভিত্তিক ধারণার তাৎক্ষণিক মূল্যায়ন করতে পারে এবং শিক্ষকও তাঁর পাঠদান সঠিক হয়েছে কিনা যাচাই করতে পারবেন। এরই ধারাবাহিকতা হিসাবে সার বিপ্লব দাস “Card Method” বিভিন্ন শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের পাঠদানের সময় প্রয়োগ করেছেন। স্যার যে ভাবে এই পদ্ধতি শ্রেণিকক্ষে প্রয়োগ করে থাকেন, সে পদ্ধতির ধাপগুলি নিম্নে বর্ণনা করা হলো-
প্রথম ধাপ:
শিক্ষার্থীদের নিকট প্রথমে বিষয় ভিত্তিক ধারণা তৈরীর উদ্দেশ্যে বক্তৃতা (Lecture method) ও প্রতিপাদন(Demonstration method) পদ্ধতির সাহায্য দিয়ে থাকেন ।যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীরা পাঠ গ্রহণে উৎসাহী হয়। যদিও কিছু সংখ্যক শিক্ষার্থী কোনোটিতেই সঠিকভাবে মনোনিবেশ করতে পারেনা।এই সকল শিক্ষার্থীদের শিক্ষাগ্রহণে উৎসাহিত করতে, শিক্ষা প্রদানের দিন বা পরবর্তী ক্লাসে তাৎক্ষণিক মূল্যায়নের জন্য 4 টি কার্ড তৈরি করতে বলা হয়। কার্ড গুলির রং যথাক্রমে লাল, সবুজ, নীল ও সাদা ।কার্ড গুলির আকৃতি হাতের তালুর থেকে কিছুটা ছোট হয়।
দ্বিতীয় ধাপ:
শিক্ষার্থীদের পাঠদানের পর মূল্যায়নের জন্য 4 টি কার্ড কাছে রাখতে বলা হয়। পিছিয়ে থাকা শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করতে প্রথমে সহজ প্রশ্ন (MCQ) করা হয়। প্রতিটি কার্ড ( বর্ণ অনুযায়ী) এর জন্য একটি করে সম্ভাব্য উত্তর বোর্ডে লিখে দেওয়া হয় ।অবশেষে শিক্ষার্থীদের সম্ভাব্য উত্তর যুক্ত কার্ড – এর বর্ণ দেখাতে বলা হয়। শিক্ষক মহাশয় বিভিন্ন বর্ণের কার্ড- এর সংখ্যা গণনা করে বোর্ডে লিখে রাখবেন। উদাহরণ স্বরূপ শ্রেণিকক্ষের ব্ল্যাকবোর্ডের চিত্র নিম্নে তুলে ধরা হলো-
- বিষয়: ভৌত বিজ্ঞান
- একক: আলো
- উপএকক: সংকট কোণ ও অভ্যন্তরীণ পূর্ণ প্রতিফলন
প্রশ্ন: আলোক রশ্মি সংকট কোনে আপতিত হলে প্রতিসরণ কোণ কেমন হয়?
তৃতীয় ধাপ:
শিক্ষক মহাশয় শিক্ষার্থীদের নিকট সঠিক উত্তরটি বলবেন এবং কারণ ব্যাখ্যা করবেন।
…..এই পদ্ধতি প্রয়োগের ক্ষেত্রে কিছু সুবিধা ও অসুবিধা রয়েছে তা নিম্নে আলোচনা করা হল-
সুবিধা
১. এই পদ্ধতি শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক মনস্তাত্ত্বিক সম্মত হয়।
২. আত্মপ্রত্যয়, স্বাধীন চিন্তা করার ক্ষমতা প্রভৃতি মানসিক বৃত্তি গুলির বিকাশ ঘটে ।
৩. প্রতিটি শিক্ষার্থী এক্ষেত্রে আলোচনায় অংশগ্রহণ করে।ফলে এগিয়ে থাকা ও পিছিয়ে থাকা উভয় প্রকার শিক্ষার্থীর পাঠগ্রহণে উৎসাহ বাড়ে।
৪. এই পদ্ধতিতে শিক্ষার্থীদের তাৎক্ষণিক মূল্যায়নের সাথে সাথে, শিক্ষক ও তাঁর পাঠদান সঠিক হয়েছে কিনা যাচাই করতে পারবেন ।
৫. শিক্ষার্থীরা খেলার ছলে নিজের অজান্তেই প্রশ্ন ও উত্তর পর্বে অংশগ্রহণ করবে।
অসুবিধা
বেশি সংখ্যক শিক্ষার্থী শিক্ষাদানের ক্ষেত্রে এই পদ্ধতিতে তাৎক্ষণিক মূল্যায়ন করা সম্ভব নয় । কারণ অল্প সময়ে এতগুলি কার্ড গণনা করা, মূল্যায়ন ও কারণ বিশ্লেষণ করা একজন শিক্ষকের পক্ষে সম্ভব নয়।
এই কার্ড পদ্ধতি এর জন্য শিক্ষা ব্যবস্থায় বিশেষ পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়।
এক্ষেত্রে সমস্যা সমাধানে প্রতি বর্ণের কার্ডের জন্য একজন করে শিক্ষার্থীকে কার্ড গণনার কাজে ব্যবহার করা যেতে পারে ।এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর প্রশ্ন পর্বে অংশগ্রহণের সাথে সাথে নেতৃত্ব দানের ক্ষমতা তৈরি হবে।
এই পদ্ধতির বিভিন্ন অসুবিধে থাকা সত্বেও আধুনিক বিজ্ঞান সম্মত পদ্ধতি গুলির মধ্যে অন্যতম এবং বিজ্ঞান ও অন্যান্য বিষয় শিক্ষায় তাৎক্ষণিক মূল্যায়নের এটি একটি আদর্শ পদ্ধতি।
এরকম আরো ব্লগ পড়তে, ক্লিক করুন।
লেখিকা
মোরশেদা বেগম
ইন্টার্ন, কন্টেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE