উত্তরবঙ্গের ভাষা সচরাচর বাংলাদেশের অন্যান্য আঞ্চলিক ভাষার তুলনায় ততটা আলোচনায় আসে না। কিন্তু এই পদ্মা ও মহানন্দার পাড়ের মানুষগুলোর জীবনেও রয়েছে এক সুমিষ্ট ভাষা। এই উপভাষায় বিশেষ এক ধরনের সুর আছে। যার কারণে এটি শুনতে বেশ মিষ্টি লাগে। বরেন্দ্রী উপভাষায় কিছু বিশেষ উচ্চারণ দেখা যায়। বাংলার অন্যান্য উপভাষার তুলনায়, বরেন্দ্রী উপভাষায় কিছু শব্দের উচ্চারণ আরো সরল এবং সহজ হয়, যেখানে কিছু ধ্বনি বাদ দেয়া হয় বা পরিবর্তিত হয়। তাই এই উপভাষায় স(s) এবং শ(sh) এর সুরক্ষিত উচ্চারণ নেই। বাংলা ভাষায় “শ” উচ্চারিত হয়, তবে বরেন্দ্রী উপভাষায় “শ” কে “স” অথবা “হ” উচ্চারণ করা হয়। কিছু ক্ষেত্রে স্বরবর্ণের ব্যবহারে ভিন্নতা দেখা যায়। যেমন, “কী” বা “কি”-এর বদলে বরেন্দ্রী উপভাষায় “ক” বা “কই” ব্যবহৃত হতে পারে। এই উপভাষা ই মূলত পরিচিত বরেন্দ্রী উপভাষা নামে। এই ভাষার উদাহরণ দিতে গেলে বলা যায়:
১. “নদীতে পানি বেড়েছে আর খুব স্রোতও আছে” =লোদ্দিতে পানি বাইড়্যাছে আর খুব সোঁতও আছে
২. “আমি চলে গেলাম” = হামি চইল্যা গেনু
৩. “মা মেরেছে আমাকে”= মা ম্যারেছে আমাকে
৪. “বটি দিয়ে আম কেটে নিয়ে আয়”= বটি দিয়ে আম ক্যাটে লিয়ে আয়
৫. “যা খেয়ে আয়”=যা খ্যায়ে আয়
৬. “কেটে ফেল”=কাইটে ফেলল
বরেন্দ্রী উপভাষা হলো বাংলাদেশ এবং ভারতের পদ্মা ও মহানন্দার পাড় অঞ্চল জুড়ে বসবাসকারী মানুষদের মুখের ভাষা। বাংলাদেশের রাজশাহী বিভাগ ও ভারতের মালদা অঞ্চলে এই ভাষার ব্যবহার হয়ে আসছে। এই উপভাষাটি বরেন্দ্র অঞ্চলের মানুষের মধ্যে প্রচলিত, যা বিশেষ করে রাজশাহী, নওগাঁ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নাটোর, এবং বগুড়ার কিছু অংশে শোনা যায়। এই ভাষার যে বিশেষ সুর আছে তার কারণে ভাষাটি সমগ্র বাংলায় বেশ জনপ্রিয়।
পূর্বে এই বাংলার বরেন্দ্রী আর ভারতের রাঢ়ী এই দুই ভাষা এক বলেই মানা হত ভাষাবিদদের মধ্যে। এই দুই ভাষার মধ্যে পার্থক্যও অতি সামান্য। ধরা হয়ে থাকে পূর্বে এই দুই ভাষা একই ভাষা ছিল। পরবর্তীতে পুবের দিককার বাংলা আর বিহার অঞ্চলের বিহারীর প্রভাবে উত্তরবঙ্গের ভাষায় স্বাতন্ত্র্য কিছু প্রভাব পড়তে থাকে। এভাবেই ধীরে ধীরে বরেন্দ্রী একটি স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে পথচলা শুরু করে।
এই উপভাষার শব্দপ্রয়োগের ক্ষেত্রে এখানে কিছু স্থানীয় শব্দ ব্যবহৃত হয় যা অন্যান্য বাংলা উপভাষায় পাওয়া যায় না। যেমন, “কিংবা” বা “বাঁইচা” শব্দের ব্যবহার। এই ভাষার একটা অন্যতম বৈশিষ্ট্য বরেন্দ্র এলাকার বসবাসরত বিভিন্ন ধর্ম বর্ণের মানুষের উচ্চারণের সংমিশ্রণ। বরেন্দ্রী উপভাষার শব্দপ্রয়োগের মধ্যে এই অঞ্চলের আঞ্চলিক ইতিহাস এবং সংস্কৃতির প্রভাব স্পষ্টভাবে দেখা যায়। পূর্ববর্তী সময়ে, এই অঞ্চলে হিন্দু-মুসলিম সমাজের মিশ্রণ ছিল, যা এই উপভাষার শব্দভাণ্ডার ও প্রয়োগে প্রতিফলিত হয়েছে। পাশাপাশি, বরেন্দ্রী উপভাষার একটি বিশেষত্ব হল এর আঞ্চলিক আঙ্গিক এবং স্থানীয় রীতি-নীতি অনুযায়ী শব্দ ব্যবহারের কৌশল। শব্দভাণ্ডারে অনেক শব্দ সংস্কৃত, আরবি, উর্দু, এবং হিন্দি ভাষার প্রভাব পেয়েছে। কারণ, এই অঞ্চলে বিভিন্ন জাতি এবং সংস্কৃতির মানুষ বাস করত, যা ভাষার মধ্যে পরিবর্তন এনেছে।
বরেন্দ্রী ভাষায় নানা ধরনের লোকগীতি, কাহিনীর রীতি, এবং আঞ্চলিক সংস্কৃতির ভাষাগত চিহ্ন পাওয়া যায়, যা মানুষের ঐতিহ্যকে আরো জোরালোভাবে প্রতিফলিত করে। এদেশের চাপাইনবাবগঞ্জ জেলার ঐতিহ্যবাহী গম্ভীরা গানে এই উপভাষা ব্যবহার হয়।
বলা যায় বরেন্দ্রী উপভাষার মাধ্যমে উত্তরবঙ্গ অঞ্চলের ভাষাগত, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য উপস্থাপিত হয়ে থাকে, যা বাংলা ভাষার বৈচিত্র্যকে আরও একধাপ বাড়িয়ে দেয়। বরেন্দ্রী উপভাষার মাধ্যমে জানা যায় বাংলা ভাষার মধ্যে উত্তরবঙ্গ, বিশেষ করে রাজশাহী বিভাগের স্থানীয় বৈশিষ্ট্য কীভাবে বিকশিত হয়েছে এবং আঞ্চলিক জনগণের ভাষাগত চিহ্ন কীভাবে বিকৃত বা পরিবর্তিত হয়েছে বর্তমানের রূপে পদর্পণ করেছে।
এরকম আরো ব্লগ পড়তে, এখানে ক্লিক করুন।
লেখক
সামিহা নোশিন সম্প্রীতি
ইন্টার্ন, কনটেন্ট রাইটিং ডিপার্টমেন্ট
YSSE